• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০১৯, ০৫:৩১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৮, ২০১৯, ০৫:৩১ পিএম

অতিক্রান্ত উৎসব : জেগে ওঠার নতুন ডাক

অতিক্রান্ত উৎসব : জেগে ওঠার নতুন ডাক

দেশে ঈদ উৎসব পালিত হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। সমালোচকদের কি ভালো লেগেছে এই নির্বিঘ্ন উৎসব? অস্বীকার করি না, কিছু দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি। মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নাই। সেই মানুষ যখন জান দিতে বাধ্য হয় কিংবা তার প্রাণ বেঘোরে যায়, তখন স্বজনদের কান্নার বিকল্প থাকে না। কিন্তু দুনিয়ার সব দেশে যে কোনো উৎসবের সময়ই এমন হয়।

উন্নত দেশগুলোতে শুধু উৎসবের সময়বলে কথা না, লং উইকেন্ড বা সপ্তাহান্তের ছুটিতেও গাড়ি চালানো বা ভ্রমণের জন্য নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। জরিমানার
পরিমাণ ঠিক করা হয় দ্বিগুণ, তিনগুণ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ক্যামেরা নিয়ে গোপনে ওত পেতে থাকে পুলিশ। স্পিড যত বাড়বে, ফাইনও বাড়বে তত। আমাদের দেশ জনবহুল। এত মানুষ আর এমন ঘনবসতির দেশে নিয়ম-কানুন থাকলেও এর প্রয়োগ অত সহজ কিছু না। অথচ এমন কড়াকড়ির পরও উন্নত দেশে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয় না। কিন্তু এবার আমরা কী দেখলাম? সদিচ্ছা আর নিয়ম মানলে তা কোনোভাবেই মাত্রা অতিক্রম করে না।

আরো একটা ব্যাপার চোখ-মনকে আরাম দিয়েছে এবার। গেল বছরও সামাজিক মিডিয়া ছিল কোরবানির পশুর ছবি আর রক্তে সয়লাব।বিদেশি মিডিয়ায় রক্তাক্ত ঢাকার রাজপথের ছবি দিয়ে শিরোনামও করত এরা। এবার এমন কিছু দেখিনি। মানুষ চাইলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। সঙ্গে যদি থাকে সরকারি আর সামাজিক উদ্যোগ। এত ভালো কিছুর পরও অনিয়ন্ত্রিত ছিল নেতাদের মুখ। তারা এমন সব কথা বলেন, যাতে মানুষ হতভম্ব হতে বাধ্য হয়। একজন ওপরতলার মানুষ যখন বলেন, ঈদের পরে যান চলাচল নিয়মে ফিরে আসবে বা
সময়মতো চলবে, তখন কি এটা ঠাট্টা মনে করা অনুচিত? উৎসবের সময় টাইমিং বা সময় ঠিক রাখতে পারার নামই তো সার্থকতা। সাধারণ সময়ে বা বাদবাকি সময়ে মানুষের কম ভিড় , বাড়তি চাপ থাকে না। তখন তো গাড়ি নিয়ম মাফিক চলবেই। কিন্তু যে কোনো উৎসব বা সামাজিক ব্যস্ততার সময় মানুষ কী চায়? বিশেষত ঈদ, পূজা—এগুলো স্পর্শকাতর ও ধর্মীয় বিষয়। পড়ি-মরি করে মানুষ বাড়ি ছুটবে—এটাই স্বাভাবিক। সারা বছর তারা ধৈর্য ধরে থাকে আপনজনের সঙ্গে মিলিত হবে বলে। মা-বাবা, ভাইবোনের মতো নিকটাত্মীয়ও থাকেন এই তালিকায়। কী করে তারা এই দায়িত্ব, এই ভালোবাসার বন্ধন থেকে দূরে থাকবেন? তাই তাদের এই আবেগ নিয়ে ঠাট্টা না করাই মঙ্গলের।

ডেঙ্গুর মতো একটি ভয়াবহ রোগ ঘুরে বেড়ানোর পরও আমাদের মানুষজন সাহস আর মনোবল হারায়নি। ডেঙ্গু মানুষকে যেমন কাহিল করেছে, তেমনি মানুষকে বিরক্ত করেছে ডেঙ্গু নিয়ে প্রলাপ। যারা মানুষকে ভরসা দেবেন, যাদের কথায় মানুষ সাহস পাবে, তারা যদি আবোল-তাবোল বকেন, তাহলে কষ্টের সীমা থাকে না। এসব রাজনৈতিক প্রহসন আর কত দিন? আমরা সবাই জানি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা যে দেশের কান্ডারি, তার কপালে আর যা-ই থাক, ভোগান্তি নেই। পরিশ্রম আর মনোবলের অনন্য নজির তিনি। একটা বিষয় খেয়াল করার মতো, প্রধানমন্ত্রী যখন দেশে থাকেন না, তখনই উলটাপালটা কথার ঢল বয়ে যায়। কেন যে তারা কথা বলার সময় এত বেপরোয়া, এই যেমন বলা হলো এদিকের মশা ওদিকে যায়, ওদিকের মশা এদিকে আসে বলে সামলানো যাচ্ছে না। কিংবা উন্নতি হলে ডেঙ্গু আরো বাড়বে—এসব কি স্বাভাবিক কথা? না সুস্থ ভাবনা?

তারপরও মানুষ সামলে নিয়েছে। ঈদের আনন্দ ম্লান হতে দেয়নি তারা। নিরাপত্তা আর সংহতির প্রশ্নে সজাগ বলেই বড়ো কোনো ধরনের ঘটনা ঘটেনি। ছোটো-বড়ো কোনো ঘটনাই দেখা যায়নি। রাত-দিন সরকার আর দেশের মুণ্ডুপাত করা সমালোচক বিরোধীরা এবার মুখ খোলারও টাইম পায়নি। কিন্তু আমাদের মন খারাপ কেড়েছে একটি শিশু, যার নাম তুবা।

তুবা এবারের ঈদে ১৯টি জামা ও ৯ জোড়া জুতা পেয়েছে। গেলবার পেয়েছিল দুটি। কিন্তু গতবার তার মনে যে আনন্দ আর ফুর্তি ছিল, এবার তা ছিল না। কারণ সে তার মাকে পায়নি। মনে আছে, কী হয়েছিল তার মায়ের? বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যাপারে খবর নিতে স্কুলে গিয়েছিলেন মা। ব্যস! ছেলেধরার অপবাদে সেই মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে আমাদের সমাজের একটি অংশ। সেই মা কোনোভাবেই এই নৃশংসতা ঠেকাতে পারেনি। সবচেয়ে বিষাদের ব্যাপার, অজস্র মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখেছে। ভিডিও করেছে। সামাজিক মাধ্যমে
পোস্ট করে লাইক পেয়েছে। নাম কুড়িয়েছে, কিন্তু একজনও এগিয়ে আসেনি। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে দেশে। একাধিকবার। প্রকাশ্য রাজপথে কুপিয়ে মারা মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে পারেনি কেউ। অথচ এই লেখা যখন লিখছি, সিডনি শহরের মূল কেন্দ্রে এক উন্মাদ যুবক ছুরি হাতে মানুষকে হত্যা করতে নেমেছিল।

এক নারীকে প্রাণে মেরে ফেলা যুবকটি যখন রক্তের নেশায় উন্মাদের মতো ছুটছিল, তখন রাজপথে দেখতে থাকা কয়েকজন থেমে থাকেনি। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে আক্রমণ করে। পরাস্ত করে ফেলে দেয় রাজপথে, যাতে আর কাউকে ছুরিকাহত করতে না পারে সে। সাহস আর মনোবল থাকলেই খুনি পরাজিত হতে বাধ্য। কেন আমরা তা ভুলে গেছি? এ কি
অসম বায়বীয় জগতের প্রভাব? অদৃশ্য অপশক্তিই কি কেড়ে নিচ্ছে মানুষের সাহস ও মনোযোগ? এখনই এর বিরুদ্ধে সজাগ হতে হবে। জাগতে হবে, জাগাতে হবে মানুষকে। সামাজিক সংগঠনগুলো আজ মৃত। নাই শিশু-কিশোরদের সংগঠন। এ সবই সমাজের ভিত্তি। কেবল রাজনীতি সবকিছু করতে পারে না। করেও না। আমরা কি তা ভুলে গেছি?

তুবার মাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি বলে ঈদের আনন্দে এক ফোঁটা দুঃখ জেগে রইল সবার মনে। ভবিষ্যতে এমন কিছু যাতে না ঘটে, সেই প্রতিজ্ঞা থাকলে উত্সব আরো আনন্দময় ও শান্তির হবে। এটাই বাংলাদেশ। এই আমাদের জাতির পরিচয়সূত্র।

 লেখক : সিডনী প্রবাসী