• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০১৯, ০৫:০৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৪, ২০১৯, ০৫:০৫ পিএম

দুই মৃত্যুর ফাঁদে জনভোগান্তি

দুই মৃত্যুর ফাঁদে জনভোগান্তি

 এবার ডেঙ্গুর মহামারি রূপ নিয়ে যা ঘটে গেল তা একেবারেই অবাঞ্ছিত, অপ্রত্যাশিত। এখনো তার জের মেটেনি। এখনো থেকে থেকে এখানে- সেখানে ডেঙ্গুর জোর প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ঢাকায় সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা তো বহু আলোচিত। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে স্মরণ করছেন এই বলে যে, আজ এই পরিস্থিতিতে আমরা তাকে ‘মিস’ করছি। বাস্তবিকই তাই। তিনি ছিলেন উদ্যোগী কর্মিষ্ঠ পুরুষ।

সম্প্রতি দুই মৃত্যুর ফাঁদে আটকা পড়েছে শুধু ঢাকার বাসিন্দারাই নয়, গোটা দেশবাসী। একদিকে সাময়িক ঈদ উৎসবে বাড়ি যাওয়া ও আসার পথে যানবাহন চালকের স্বেচ্ছাচারের বলি মানুষ- নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে। প্রধানত রাজধানী ঢাকা মহানগরে কর্মরত মানুষ, বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমান ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা এই দুটি উৎসব উপলক্ষে অপেক্ষায় থাকে গ্রামের বা শহুরে বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করবে।

সেই আকাঙ্ক্ষা মিটাতে গিয়ে যাদের প্রাণ যায় প্রধানত সড়কে-মহাসড়কে বেসামাল যানবাহন পরিচালনায়, একে কি দুর্ঘটনা বলে জায়েজ করা যাবে? আমি তা মনে করি না। দুর্ঘটনা যে হয় না তা নয়, তবে তার সংজ্ঞা আলাদা। অতি দ্রুত গতিতে সব রকম ড্রাইভিং রীতিনীতি ভঙ্গ করে অন্য গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে অঘটন ঘটানো, ছোট যানকে আঘাত করে পিষে ফেলা- এগুলো দুর্ঘটনা নয়, ইচ্ছাকৃত ঘটানো অঘটন। এবং এ কারণে মৃত্যু হত্যাকা- হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য। এগুলো হত্যার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপ্রিয় সত্যগুলো না মানে চালক বা তার মালিক, না মানে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ। কারণ মানতে গেলে নিজের অপরাধ প্রমাণিত হয়ে যায়। আর পরিবহন খাতের বাস-ট্রাকের মালিক-চালক সিন্ডিকেট এমনই শক্তিশালী চক্র যে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে উদাসীন বা নির্বিকার। তারা এ জাতীয় পরিবহন খাতের অপরাধগুলোকে দুর্ঘটনা বলে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত।

তাই বলে উদাসীনতা দিয়ে কি অপরাধ মুছে ফেলা যায়? যায় না। কিন্তু আমাদের, অর্থাৎ লেখক বা কলামিস্টদের ক্ষমতা এত সীমাবদ্ধ যে তাদের দিয়ে কোনো সদিচ্ছার ফয়সালা হয় না। হতে পারে না। তাই প্রতিবারের মতো এবারো বাংলাদেশে ‘ঈদযাত্রায় সড়কে ঝরল ২২৪ প্রাণ’। এ ছাড়া ঝরেছে কিছু প্রাণ রেলপথে এবং নৌপথে।

বাস বা ট্রাক যদি মোটরসাইকেল আরোহীকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে তাকে মেরে ফেলে তাহলে একে কি আমরা দুর্ঘটনা বলব, না কি গাড়ি চালকের দায়িত্বহীন বা বেপরোয়া পরিচালনার পরিণাম বলব, সে ক্ষেত্রে ঘটনা বিশ্লেষণে দায় দেখা যায় বাস চালকের। যদি মোটরসাইকেল চালকের বেপরোয়া চালনা দায়ী হয় তাহলে সেই মৃত্যু হবে দুর্ঘটনাজনিত, এর দায় আমরা গাড়ি বা বাস চালকের ওপর চাপাব না।

কিন্তু যেসব প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, লাইসেন্সবিহীন চালক দিব্যি ভারী যানবাহন চালাচ্ছে, ফিটনেস সার্টিফিকেটবিহীন লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন রাস্তায় চলছে। ফিটনেসের অভাবে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটে তবে সে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর দায় তো গাড়ির তথা যানবাহনের মালিকের। শাস্তিটা তারই প্রাপ্য।

এক কথায়, পরিহন খাতে এসব অনিয়ম, নৈরাজ্যিক অনাচার ও অনৈতিকতার পরিণামে সড়কে নিয়মিত মৃত্যু এবং বিশেষ করে ঈদযাত্রায় বহুসংখ্যক নিরীহ গৃহমুখী মানুষের মৃত্যু শুধু ঈদ উৎসব কান্নায় পরিণত করে না, কখনো গোটা পরিবারটিকে অর্থনৈতিকভাবে অসহায় ও এতিম করে ফেলে।
এর দায় তো পরিবহন খাতের হর্তাকর্তা বিধাতার। এটা প্রত্যক্ষ দায়। পরোক্ষ দায় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের, তাদের দায়িত্ব পালনের উদাসীনতায়। যেসব হতভাগ্য পরিবারে সর্বনাশ নেমে এলো, তাদের ক্ষতি পূরণ করবে কারা? নিঃসন্দেহে প্রাথমিকভাবে পরিবহন খাতের কর্তারা তথা বাস-ট্রাকের মালিকরা এবং ক্ষেত্রবিশেষে যানবাহনের চালক।

কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে কি? অর্থাৎ হচ্ছে কি এসব ট্র্যাজিক মৃত্যুর বিচার এবং পারিবারিক ক্ষতি পূরণ? কে বা কারা এর নিশ্চয়তা বিধান করবে? যাত্রীসেবা বা সুরক্ষা সমিতির মতো জাতীয় সংগঠন প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী তত্ত্ব-তালাশ সহকারে কর্তব্যকর্ম করে থাকে। আমি এ বিষয়ে একজন সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছিলাম, জবাবে তার তীর্যক তীক্ষè হালকা হাসি আমাকে বুঝিয়ে দেয় যে ফলাফল নেতিবাচক।

সে ক্ষেত্রে আমরা একমাত্র উচ্চ আদালতেরই শরণাপন্ন হতে পারি। কোনো আইনজীবী স্বেচ্ছায় এ কাজে এগিয়ে আসতে পারেন। অথবা উচ্চ আদালত স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংগঠনকে। প্রকৃতপক্ষে এ ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতের এগিয়ে আসা ভিন্ন এ ট্র্যাজিক মৃত্যুর কাফেলা বন্ধ হবে না। দীর্ঘদিন থেকে এ বিষয় নিয়ে অনেক লেখালেখি, ছোট-বড় প্রতিবাদ, মানববন্ধন ইত্যাদি অনেক হয়েছে। কিন্তু কিছুতে কিছু হয়নি। নিশ্চয়ই ঘটনা লক্ষ করেছেন উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা। এবার তাদেরই দায় গ্রহণে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

দুই.
ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ করেছি, মহামারিরূপে দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এবং বেশ কিছু সংখ্যক মৃত্যু এবং ডেঙ্গু দমনে ও এডিস মশক নিধনে দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতার যেসব প্রতিবেদন ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে বেরিয়েছে, সেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই সম্ভবত ‘দুই সিটির কার্যক্রমে অসন্তোষ হাইকোর্টের’। হাইকোর্টের বক্তব্য স্পষ্ট। তাদের মতে, ‘দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যথাসময়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেননি, এটা নিলে হয়তো এ রকম পরিণতি হতো না।’

আমাদের শাসন ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা আমরা নিজদের ভুলত্রুটি স্বীকার করতে চাই না। স্বীকার করলে ব্যবস্থা নেয়ার দায়টা আরো ভালোভাবে কাঁধে চাপে, সে জন্যই কি দায়দায়িত্বের ব্যর্থতা অস্বীকার এবং যথারীতি তা অন্যের কাঁধে চাপানো। চাপানো এমন কারো বা কিছুর ওপর যে প্রতিবাদ করতে অক্ষম।
যেমন ওষুধের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যকারিতা কিংবা এডিস মশার ওষুধের প্রতি সহনশীলতা বৃদ্ধি (রেজিসট্যান্স) ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বভাবতই হাইকোর্ট যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন এই বলে যে, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বছরের পর বছর একই ওষুধ ছিটানো হয়েছে। অথচ ওই ওষুধে কাজ হচ্ছে না। তারা এটাও বোঝে না, একটি ওষুধ বারবার ব্যবহার করলে তা সহনীয় হয়ে যায়।’

আমাদের আরো সমস্যা ডেঙ্গু বা মশক নিধন সম্পর্কে বিচারপতিরা যা বোঝেন, সংশ্লিষ্টরা তা বোঝেন না। আদালত আরো বলেছেন, ‘নিজেরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে জনগণের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে।’

সংবাদ মাধ্যমের হিসাবে পঞ্চাশ হাজার লোক যদি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং চিকিৎসা নিয়ে থাকে, তাতে শুধু কী পরিমাণ পারিবারিক ক্ষতি তাতে হয়েছে, হিসাবটা সেখানেই শেষ নয়, মনে রাখতে হবে তাতে কী পরিমাণ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। তাতে সরকারের ক্ষতির পরিমাণও খুব একটা কম হবে না।

তিন.
এক সময় এ দেশে বিদেশি স্বার্থের শাসন প্রচলিত ছিল। তখন রোগ মহামারি ও দুর্ভিক্ষে লাখো-কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। স্বদেশি শাসনামলে তার কোনো শতাংশ অনাচারই কাম্য নয়। কাম্য নয় উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা বা দুর্নীতির অনুপ্রবেশ। এবার ডেঙ্গুর মহামারি রূপ নিয়ে যা ঘটে গেল তা একেবারেই অবাঞ্ছিত, অপ্রত্যাশিত।

এখনো তার জের মেটেনি। এখনো থেকে থেকে এখানে-সেখানে ডেঙ্গুর জোর প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ঢাকায় সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা তো বহু আলোচিত। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে স্মরণ করছেন এই বলে যে, আজ এই পরিস্থিতিতে আমরা তাকে ‘মিস’ করছি। বাস্তবিকই তাই। তিনি ছিলেন উদ্যোগী কর্মিষ্ঠ পুরুষ।

সম্প্রতি বাস্তবিক দুই মৃত্যুর ঘটনা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ কর্তব্যের ভুবনে কতটা দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ যে নির্বাহী বিভাগকে ডিঙিয়ে বিচার বিভাগকে কথা বলতে হয়, দিকনির্দেশনা দিতে হয়। একটি গণতন্ত্রী দেশে তা যে খাতেই হোক জবাবদিহিমূলক সুশাসন এভাবে চলে না।

মহানগর ঢাকার জনসংখ্যা শোনা যায় দুই কোটিরও অধিক। অর্থাৎ গোটা জনসংখ্যার আট ভাগের একাংশ। সংখ্যাটা অবহেলার নয়। মেয়রদ্বয়ের কাঁধে কত বড় দায়িত্ব, তারা কি ভেবে দেখেছেন? আমার মনে পড়ছে তাদের নির্বাচনী ঘোষণার কথা, ঢাকাকে তিলোত্তমা বানানোর প্রতিশ্রুতির কথা। সেসব বোধহয় তাদের স্মরণেও নেই।
লেখক :  গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।