• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০১৯, ০২:১১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৬, ২০১৯, ০২:১১ পিএম

শিক্ষার গ্রেড উন্নয়নে দায় কার

শিক্ষার গ্রেড উন্নয়নে দায় কার

বাংলাদেশের শিক্ষার ক্রমবর্ধমান অধঃপতন নিয়ে আজকাল সংবাদপত্রে প্রচুর লেখাজোখা হচ্ছে। শিক্ষার মানের নিম্নগতি যে অব্যাহত আছে, তা নিয়ে সংশয় থাকে না যখন খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০০০ সাল থেকে তার বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কথাটির ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এমনকি কতিপয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদপত্র কেনাবেচার কথাও বলা হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের মান্যবর রাষ্ট্রপতি স্বয়ং বারংবার বলে আসছেন সে কথা এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। তার কারণে যে বিষয়টির ওপর সাধারণত জোর পড়ে তা হলো, শিক্ষার বাজারজাতকরণ। শিক্ষা আজ একটি পণ্য; স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নামক বাজারে তা কিনতে হয়। 

অর্থনীতির সরবরাহ ও চাহিদার সেই চিরন্তন নীতির ফলে সে পণ্যের মূল্য বাড়তে বাড়তে আজ আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। এই বাজারজাতকরণের প্রথম খসড়াটা নেমে আসে ১৯৯২ সালে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মাধ্যমে কতিপয় ধনী ব্যবসায়ীর হাতে উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। সরকার বদলের পর জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নামের আড়ালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। মঞ্জুরি কমিশনের রিপোর্টেও এগুলোকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলেই উল্লেখ করা হয়। এসব 'পাবলিক' বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেখানে শিক্ষকরা নন, স্টেকহোল্ডার বা রাজনীতিবিদরাই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষকদের ভূমিকা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে।

 ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংক ও মঞ্জুরি কমিশনের যৌথ উদ্যোগে যে ২০ বছরের কৌশলপত্র রচিত হয়েছিল, সেটাই আজ উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর শিক্ষকদের বড় বেশি প্রভাবের কারণেই শিক্ষার এই অন্তর্জলি যাত্রা, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। সরকার নিয়োজিত উপাচার্যরা সেখানে আজ এক দানবীয় শক্তি নিয়ে উপস্থিত। স্বাধীনচেতা শিক্ষকরা সেখানে আজ নানাভাবে পর্যুদস্ত। ২০ বছরের কৌশলপত্র রচনার জন্য ১৭ সদস্যের যে স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং কমিটি (এসপিসি) গঠন করা হয়, সেখানে মাত্র একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বাকি সবাই হয় সরকারি কর্মকর্তা, না হয় বড় ব্যবসায়ী। সরকারের অন্য কোনো বিভাগ, যেমন সেনাবাহিনী বা সিভিল সার্ভিসের জন্য যখন কোনো কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক রাখা হয় না সঙ্গত কারণেই। 

কারণ ওইসব সার্ভিস সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খুব কমই ধারণা আছে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যেসব কমিটি গঠিত হয়, সেখানে বাইরের ওইসব ক্যাডারের লোকজন থাকবেন কেন? তারা তাদের ক্যাডারের বড় গুণী-পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তারা কী জানেন? যাক সে কথা। যে যাই বলুক, বাংলাদেশের শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তার গুণগত মানের কিছুতেই উন্নতি করা যাচ্ছে না। সরকারের নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও এ কথা সত্যি। কিন্তু কেন? এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়ী করছেন। অনেকে কিছু কাঠামোগত সংস্কারের সুপারিশ করছেন; অনেকে আবার পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই ঢেলে সাজাবার পরামর্শ দিচ্ছেন।

 তবে মোটামুটি সবাই একটা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে ভুল করছেন না। তা হলো, শিক্ষার এই গুণগত মানের অধঃপতনের মূলে রয়েছে শিক্ষার বাজারজাতকরণ। বিশ্ববিদ্যালয় আজ পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের শক্তি দ্বারা; শিক্ষকদের দ্বারা নয়। তাই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে আজ আর শিক্ষালয় বলা যায় না। দোকান বা বাজার বলাই শ্রেয়। এ কথায় অনেকে আপত্তি করতে পারেন। কিন্তু কথাটা যে কত বড় সত্য, তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এটা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়। এটা বিশ্বজনীন সমস্যা। বাজার অর্থনীতি প্রতিটি দেশের শিক্ষার মানের অবনয়ন ঘটিয়ে চলেছে, সে খবর আমরা খুব কমই জানি। ইংল্যান্ডের বিশ্ববিখ্যাত এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একটি রিপোর্ট পড়ে এই লেখাটি লিখতে উৎসাহী হলাম। কারণ সেখানে উচ্চশিক্ষার যে অধোগতি এবং তার যে কারণের কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষার ক্রমাবনতির যথেষ্ট মিল আছে।


দুই.

গত ১২ জুলাই, ২০১৯ দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার আন্তর্জাতিক সংস্করণে ডেভিড ইয়ারোর 'লেকচারার্স আর নট টু ব্লেম ফর ইউনিভার্সিটি গ্রেড ইনফ্লেশান- দি গভর্নমেন্ট ইজ' নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। লেখাটির নামের নিচে মূল সিদ্ধান্তটি এক লাইনে তুলে ধরা হয়েছে- 'বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বাজারজাতকরণের ফলেই প্রথম শ্রেণি পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা জোয়ারের জলের মতো বেড়ে চলেছে।' শুরুতেই লেখক বলছেন যে আবারও প্রথম শ্রেণি পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষারোপ করা হচ্ছে। 'বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা'র শিক্ষা সচিব ড্যামেন হিন্দস্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রের '৮০ শতাংশ' বৃদ্ধির কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে তার সম্পূর্ণ দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি একে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অসাধু কর্মকাণ্ড' বলে মন্তব্য করেছেন।

 গত বছরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে যা বলেছিলেন, এটা তারই বর্ধিত রূপ। গত বছর তিনি বলেছিলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় যে ডিগ্রি দেয়, তার মান সংরক্ষণের সব দায়দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের।' ইয়ারো বলছেন, 'এই অভিযোগ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর শামিল।' হিন্দস্‌ সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শাস্তির ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। ইয়ারোর মতে, গ্রেডের এই অস্বাভাবিক স্ফীতির জন্য সরকারের নয়া উদারনৈতিক দর্শন ও শিক্ষার বাজারজাতকরণই দায়ী। গত ২০ বছর ধরে সরকার এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। সেই থেকে সরকার শিক্ষার আর্থিক মূল্যের বিষয়টি ছাত্রদের সামনে তুলে ধরছে। সরকার ১৯৯৮ সালে ছাত্রদের বেতন নির্ধারণ করে এবং ২০১০ সালে তা তিন গুণ বৃদ্ধি করে। শিক্ষার পেছনে অর্থ খরচ ভবিষ্যৎ গড়ার পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরে। যেমনটি ১৯৬২ সালে শরিফ কমিশন করেছিল- 'উচ্চমূল্য দিয়ে উচ্চশিক্ষা কিনতে হবে।' সরকার বেতন বৃদ্ধিকে ভবিষ্যতে উন্নত শ্রমবাজারে ঢোকার পথ হিসেবে গণ্য করার শামিল বলে প্রচার করে। বর্ধিত বেতন ভবিষ্যতে সুদে-আসলে তুলে আনার স্বপ্ন দেখায়। এই বৃহত্তর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছাত্ররা শিক্ষাকে একটি ব্যক্তিগত বাজারি পণ্য হিসেবে দেখতে শেখে- ছাত্ররা ক্রেতা এবং শিক্ষকরা বিক্রেতা।

তিন. 
কেন এত প্রথম বিভাগে পাস? উচ্চশিক্ষর এত উচ্চমূল্য নির্ধারণের সঙ্গে প্রথম বিভাগ প্রাপ্তির একটা সম্পর্ক আছে। বাবার শেষ জমিটুকু কিংবা মায়ের কোনো গহনা বিক্রি করে পড়তে আসা ছাত্রদের যদি প্রথম বিভাগ না দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। তাই প্রথম বিভাগ দিয়ে তাদের মনে শান্তি আনা যায়। তেমনি আগামীতে ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে আকর্ষণ করা যায়। ছাত্ররা প্রথম বিভাগ আশা করে এবং তাদের সে আশ্বাসও দেওয়া হয়, যদি তারা সুনির্দিষ্ট নির্দেশাবলি মেনে চলে। শিক্ষা আজ ছাত্রদের ছাপিয়ে যাওয়া বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈপুণ্য হারিয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষাবিদ শিক্ষার এই অধঃপতিত অবস্থা লক্ষ্য করে নৈরাজ্যে ভোগেন। তারা ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঝুঁকি নিতে সব সময় অনুপ্রাণিত করেন। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সরকারের ' ক্রেতার চাহিদার অর্থনৈতিক' ভাবাদর্শ দ্বারা উজ্জীবিত জাগতিক উৎসাহের কাছে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।’

শিক্ষাব্যবস্থায় বাজারের নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুপ্রবেশের ফলে সরকারের শতভাগ ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হয়নি। শিক্ষার হর্তাকর্তাদের এমন ব্যক্তিগত উদ্যোগ। গত ৩০ বছরের এসব রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল আমাদের টেবিলের ওপরেই আছে। দেখা যায় যে, তা বিপরীত ফলই প্রসব করেছে। উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটেনি; অবনয়ন অব্যাহত আছে। বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের শিক্ষার মান নিচে নামানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। কেন? আমলাতান্ত্রিক উপায়ে শিক্ষাকে বাহারি প্রতিযোগিতায় টেনে এনে ছাত্রদের মেকি ক্রেতায় পরিণত করেছে। তাই হিন্দসের উচিত ছিল গ্রেড উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের দোষারোপ করার আগে এই পরস্পরবিরোধী দর্শনের প্রতি মনোযোগ দেওয়া।

চার.
 ৪০ বছর আগে ফিনল্যান্ড শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে কীভাবে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলল, তা আমাদের পথ দেখাতে পারে। সেখানে মেধা যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ১৬ বছর বয়সে মাত্র একবারই পরীক্ষা দিতে হয়। শিক্ষা শতভাগ ফ্রি। শিক্ষকরা প্রতিদিন মাত্র ৪ ঘণ্টা ক্লাসে থাকেন। ২০০৮ সালে ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের বেতন ছিল ২৯ হাজার ডলার, আর যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬ হাজার ডলার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্ররা অনেক বেশি শিক্ষালাভ করে। ভালো ও মন্দ ছাত্রের মধ্যে পার্থক্য সামান্য। তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাই সংস্কারের মাধ্যমে ফিনল্যান্ড শিক্ষাকে বাজারি পণ্যে পরিণত করেনি। সব দায়িত্ব রাষ্ট্র নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। এসব উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।

   লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়