• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০১৯, ০৫:৩২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৮, ২০১৯, ০৫:৩২ পিএম

প্রসঙ্গ মান-সম্মান

প্রসঙ্গ মান-সম্মান

 স্বভাবতই শিক্ষার মান বাড়ছে না। বিশ্ব জরিপে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই সম্মানজনক উল্লেখ নেই। ওই জরিপ কীভাবে তৈরি হয়, তথ্য সরবরাহে ঘাটতি ছিল কিনা, এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু এই সত্য কেউ অস্বীকার করবেন না যে মান উঠছে না, নামছেই এবং সেটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু শিক্ষার মান কিছুতেই বাড়বে না যদি শিক্ষার মান-সম্মান বাড়ানো না যায়।

গুণ নির্ভর করে মানের ওপর। বাংলা ভাষায় মানের অর্থ একটা নয়, একাধিক; একটা অর্থ মাত্রা, আরেকটা অর্থ সম্মান। মাত্রা অর্থে মানের সঙ্গে সম্মান অর্থে মানের খুবই নিকটাত্মীয়তা। যে বস্তুর মানসম্মান বেশি তার মাত্রাও উঁচু হবে এমনটা প্রত্যাশিত। সম্মান কমলে মানও কমবে। অন্য ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষাক্ষেত্রেও এটা সত্য। বাংলাদেশে শিক্ষার মানও শিক্ষার সম্মানের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত।

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। গল্প নয় সত্য ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাতেই রোকেয়া হলের সামনে এক অধ্যাপক রাস্তা পার হচ্ছিলেন। দ্রুতগামী একটি মোটর গাড়ি তাকে প্রায় চাপা দিয়ে ফেলছিল; কিন্তু দেয়নি, গাড়িটি থেমে গেছে। ভেতর থেকে আরোহী বের হয়ে এসে অধ্যাপককে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, ‘বন্ধু, তোমার কাছে আমি কত যে ঋণী তা তুমি জানো না।’ তারপর তিনি ঋণের কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এবং সংক্ষেপে জানালেন। বললেন, ‘তুমি সাহায্য করেছিলে বলেই আমি দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়েছিলাম, আরো বেশি যে সাহায্য করোনি তার জন্যও আমি বিশেষভাবে ঋণী, কারণ সেটা করলে আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রান্তিক অবস্থানে না গিয়ে কিছুটা উঁচুতে থাকতাম, মাস্টার হতাম কলেজে, জীবন হতো অধঃপতিত। দ্বিতীয় শ্রেণিতে নিচু স্থান পেয়ে ইপিসিএস দিলাম, পেলাম কাস্টমস, তাতে দেখো আমার দাপট। আর খোদা না করুন যদি তোমার মতো ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যেতাম, তাহলে আমার দশাও তোমার দশাই হতো।’ তারপর হাসাহাসি করে পরস্পরের পিঠ চাপড়িয়ে তারা বিদায় নিয়েছিলেন।

এটা পাকিস্তান আমলের ঘটনা। সে রাষ্ট্রটি ছিল ঘৃণিত, আমরা স্বপ্ন দেখতাম মুক্তির; মুক্তি আমরা পেয়েছি বলেও প্রচার আছে, তবে শিক্ষার মানমর্যাদা কী বেড়েছে, নাকি কমেছে? মানতেই হবে সত্য তো এটা যে মানসম্মান বৃদ্ধি পায়নি, হ্রাস পেয়েছে। তবে শিক্ষার মান জিনিসটা কেবল যে শিক্ষার মানসম্মানের ওপর ভর করে থাকে তা নয়, দেশের মানসম্মানের বৃদ্ধির ওপরও শিক্ষার মানের ওপরে ওঠাটা নির্ভর করে। এরা পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। পানি যেমন একই স্তরে থাকাটা পছন্দ করে শিক্ষার মানও তেমনি দেশের মানসম্মানের স্তরেই রয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধের কারণে দেশের মানসম্মান বেড়েছিল, তারপর সেটা ক্রমাগত নেমেছে। এই লেখা লিখতে লিখতেই খবর পড়লাম বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ দেশগুলোর একটি; অথচ এখন এখানে কোনো যুদ্ধ নেই, পরিবেশ শান্ত এবং উন্নতির ধারা অব্যাহত। সম্প্রতি খবরের কাগজে শিরোনাম পড়েছি বায়ুদূষণে মৃত্যুর ঝুঁকিতে বাংলাদেশের স্থান এখন শীর্ষে। আরো জানা গেল যে, বাংলাদেশে গত দশ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে পঁচিশ হাজার মানুষ। এটা সরকারি হিসাব, বেসরকারি হিসাব বলবে সংখ্যা আরো অধিক, আহতের সংখ্যা হিসাব করা নিশ্চয়ই কঠিন। ওদিকে ঘরে-বাইরে পথে-ঘাটে যেভাবে গণধর্ষণ, শিশুধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা, এমনকি মৃত নারীকে ধর্ষণের সব খবর পাওয়া যায় তাতেও একটা সত্যেরই সমর্থন মেলে। সেটা হলো, জীবনের নিরাপত্তার উন্নতি ঘটেনি, বরঞ্চ অবনতিই পরিস্ফুট; ওদিকে অভাবের দরুন আত্মহত্যার ঘটনাও বাড়তির দিকেই। নিরাপত্তাহীনতা যে শিক্ষার জন্য অনুকূল নয় সেটা তো জানা কথা। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিল, তখন দেশের শিক্ষার চর্চা সম্ভব ছিল না।
শিক্ষার মান আর শিক্ষকের সম্মান, এরাও অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশে শিক্ষকদের সম্মান কতটা বেড়েছে তা কোনো লুকানো ব্যাপার নয়। ইউএনও গেছেন পরীক্ষা কেন্দ্রে, তার পরিচয় জানতে চেয়েছেন কর্তব্যরত শিক্ষক। এই অপরাধে শিক্ষকের কঠিন শাস্তি হয়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে রক্ষা পেয়েছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে মাফ চেয়ে। পরে জানা গেছে সেই প্রশাসক এবং ওই শিক্ষক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে, একই সময়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলেন; একজন গেছেন প্রশাসনে, অপরজন শিক্ষায়, দুজনের বন্ধুত্ব থাকার কথা, কিন্তু অবস্থা এমন যে এখন শিক্ষককে নতজানু হতে হয় প্রশাসকের কাছে। এ জাতীয় খবর পত্রপত্রিকায় অহরহ আসছে।

আর যদি এমন হয় যে বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ডেকে আনেন স্থানীয় এমপি (যিনি নির্বাচিত হয়েছেন ভোট না পেয়েও) এবং কল্পিত এক অপরাধে শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করান এবং পরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থায় ওই শিক্ষক যদি কান্নাভেজা কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন তাকে নিয়ে হৈচৈ না করাটাই ভালো, কারণ তিনি একজন দুর্দশাগ্রস্ত পিতা ঘরে যার তিনটি বিবাহযোগ্যা কন্যা সন্তান বর্তমান, তাহলে শিক্ষার মান ওপরের দিকে উঠবে কীভাবে? এসব ঘটনাকে ব্যতিক্রমী বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বিভিন্ন মাত্রায় এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে, অতিমাত্রায় হলেই খবর হয়, নইলে চাপা থাকে। পার্থক্যটা আসলে পরিমাণেরই, গুণের নয়। ওদিকে শিক্ষকরা যে বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করেন, রাস্তায় নামেন, পুলিশের হাতে মার খান, অনশন করেন, এমনকি দুয়েকজনকে মৃত্যুবরণও করতে হয়, এসবও বাস্তব সত্য। এমনটা হলে তো শিক্ষার মান বাড়বে না। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে দেখতে চায় বীর হিসেবে, যে বীরের খোঁজ তারা অন্যত্র পায় না। শিক্ষকদের সামাজিক দীনতা শিক্ষার্থীদের ভেতরে ভেতরে খুবই হতাশ করে।

স্বভাবতই শিক্ষার মান বাড়ছে না। বিশ্ব জরিপে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই সম্মানজনক উল্লেখ নেই। ওই জরিপ কীভাবে তৈরি হয়, তথ্য সরবরাহে ঘাটতি ছিল কিনা, এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু এই সত্য কেউ অস্বীকার করবেন না যে মান উঠছে না, নামছেই এবং সেটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু শিক্ষার মান কিছুতেই বাড়বে না যদি শিক্ষার মানসম্মান বাড়ানো না যায়। বাংলাদেশে এখন মান বাড়ছে একটা জিনিসেরই, সেটা হলো টাকা। টাকায় সব কিছুই কেনা যায়, কেনা যায় শিক্ষাও।

কেবল কেনা যায় না, টাকা না থাকলে শিক্ষাকে আয়ত্তে আনা অসম্ভব। যে জন্য হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রাথমিক স্তরেই ঝরে পড়ে, তারপরও ছিটকে পড়ে যাওয়া সংখ্যা বাড়তেই থাকে। যাদের টাকা নেই, তাদের শিক্ষাও নেই, মানসম্মত শিক্ষার কথা দূরে থাক। একটি গল্প চালু আছে; ঈশপের আধুনিক গল্প, যাতে আমাদের বর্তমান অবস্থাটা সুন্দরভাবে ধরা পড়ে। হাতি যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে, বেড়াবে। রোজই যায় আর রোজই দেখা যায় অন্যরা সরে দাঁড়ায়, সম্মান করে, কিন্তু একটি ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে হাতির গায়ে লাথি মারে। বেচারা হাতি আর কী করে, ব্যাঙের সঙ্গে তো লড়াই চলে না। কিন্তু অন্যদের কৌতূহল বাগ মানে না, তারা জানতে চায় ব্যাঙ কী করে এমন সাহসী হলো যে সে হাতিকে লাথি মারে। গোয়েন্দা তদন্তে প্রকাশ পেল যে ব্যাঙটি যেখানে বসে থাকে তার নিচে একটা পুরনো টাকা আছে পোঁতা; তার গরমেই ব্যাঙের অমন সাহস ও দম্ভ।

সাধারণ ব্যাঙ নয়, যে ব্যাঙ টাকার গরমে তপ্ত সে-ই শুধু পারে হাতিকে ওইভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে। এই গল্পের গরম ব্যাঙ ও নরম হাতির সম্পর্কটা বহুক্ষেত্রেই সত্য, সত্য সে বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রও। জ্ঞান এখানে বেশ কুণ্ঠিত অবস্থায় আছে, টাকা ও টাকাওয়ালাদের দাপটে। ধানের ব্যাপারটা তো আর গল্প নয়। বাজারে জ্ঞানের ও ধানের একই অবস্থা এবং তারা পরস্পর সম্পর্কিত এই দিক থেকে যে উভয়েই টাকার কারণে অবমূল্যায়িত এবং টাকার দ্বারা শাসিত। উন্মুক্ত বাজার টাকা চেনে, কোনটা ধান আর কোনটা জ্ঞান তা তার জানার দরকার নেই এবং বাজারের পক্ষে এটা তো কোনো বিবেচনার বিষয় নয় যে ধান ছাড়া দেশের মানুষ প্রাণে মরবে, জ্ঞান ছাড়া মরবে মনে।

   লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।