• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯, ০৬:৫৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯, ০৬:৫৯ পিএম

গ্যাং স্টারদের নিবৃত্ত করাতে হবে

গ্যাং স্টারদের নিবৃত্ত করাতে হবে

বেশ কিছুদিন ধরে খেয়াল করছিলাম পাড়া-মহল্লার মোড়ে একদল আড্ডা দেয়া ছেলেদের সংখ্যা বাড়ছে। এরা সবাই এক শ্রেণির নয়। বিভিন্ন বিভিন্ন  পরিবার থেকে আসা। বস্তিবাসী উচ্চবিত্ত সব মিলেই এরা দল বেঁধে চলে, আড্ডা দেয়, সিনিয়রদের দেখলে শূন্যে ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে বোঝাতে চায় এরা সিগারেট খাচ্ছে। কেউ কেউ স্কুল বা কলেজের ছাত্র। তবে পাশ-ফেলের জটিলতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায় না।

পাড়ায়-মহল্লায় শুরু হয়েছে গ্যাং কালচার। ভয়াবহ এদের দৌরাত্ম্য। এখানে বরগুনার ঘটনার উল্লেখ করা যায়। নয়ন বন্ড নামে এক ছেলে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে বন্ড বাহিনী গড়ে তোলে। অপরাধের মধ্য দিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে এলাকার নেতৃত্বাস্থানীয়দের নজরে চলে নয়ন। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে এলাকার রাজনৈতিক মহলের। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গেও নয়নের উঠাবসা ছিল চোখে পড়ার মত। নিষিদ্ধ মাদকের জগতে ঢুকে সে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। বছরখানেক ধরে জেলার প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে নয়নের ওঠবস শুরু হয়ে এক সময় সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মাদকের টাকার জন্য নয়নের এমন অপরাধ দিন দিন বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অভিযোগে পাঁচটি মামলা হয়। ভুক্তভোগীরা তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে নয়নের বিষয়ে অভিযোগ করতে শুরু করেন। নয়নও তখন রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজতে শুরু করেন। একপর্যায়ে সে ক্ষমতাসীনদের হাত ধরে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাধর হয়ে উঠে এমন শক্তি অর্জন করেন তিনি যে মুহূর্তে একটি ছেলেকে কুপিয়ে মারতেও তাকে দ্বিধা করতে হয়নি। ‘০০৭ লাইসেন্স’ একটি বিখ্যাত হলিউড সিনেমা সিরিজ। সিনেমার মৌলিক গল্প অনুযায়ী ০০৭ হচ্ছে মানুষ হত্যার লাইসেন্স। এতে যিনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন, তার নাম জেমস বন্ড। এই ছবি দেখে নয়ন বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। এর পর নিজেকে ‘০০৭ লাইসেন্স’ সিনেমার নায়ক ভাবতে শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজের নামের সঙ্গে নিজেই যুক্ত করে দেন ‘বন্ড’ শব্দটি এবং একই সঙ্গে গড়ে তোলেন ০০৭ নামের সন্ত্রাসী বাহিনী।  ঢাকার বাহিনীগুলোর নাম দেখেও মনে হয় এরাও একইভাবে বাহিনীর নাম রেখেছে। নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ, বিগবস, সিটিজে বয়েজ  এ ধরনের নামে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য বাহিনী। এসব গ্রুপের সদস্যদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৩ থেকে ২০-এর মধ্যে। কোন রকমে কয়েকজন তরুণ সংগঠিত হলেই তারা প্রতিযোগী একটি গ্রুপ সহজেই পেয়ে যায়। এরপর প্রতিযোগিতা করে উঠে যাওয়া। এরা সংগঠিত হলেই পৃষ্ঠপোষক পাওয়া সহজ। এলাকার পলিটিক্যাল বড় ভাইদের সব ধরনের সহযোগিতায় বেড়ে ওঠে কিশোর গ্যাং। এরা সহজেই নেশার লাগাম পেয়ে যায়। অল্প সময়ে তারা এলাকার ত্রাস হয়ে ওঠে।  কিন্তু ভাবাও যাবে না, কীভাবে এসব ছেলেরা ভয়ংকর হয়ে উঠছে। নেশাসক্ত হয়ে পড়ছে,   জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে। পরিবারের চোখে যখন বিষয়টি ধরা পড়ে তখন ছেলেটির আর ফেরার পথ থাকে না। যারা মনে করেছেন এটা শুধু ঢাকায় তাদের জন্য বলছি এটা যে শুধু বিভাগীয় শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সেটা নয়ন বন্ডের বাহিনীর দিকে তাকালেই টের পাওয়া যাবে গ্রাম-গ্রামান্তরে এসব বাহিনী জায়গা করে নিয়েছে। পরিবারের কারো বোঝার আগেই সে হয়ে উঠে ভয়ংকর কোন বাহিনীর সদস্যকে অপরাধী বা মাদক সেবনকারী কিংবা কোন মাদক ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী কোন পলিটিক্যাল দাদার হাতিয়ার। সমাজের শান্তি বিনষ্টকারী এই সব গ্যাং স্টাররা এখন শহর নগরের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়ায় । দুর্বার গতিতে ছুটে চলে তাদের বাইক । তাদের যা ইচ্ছা তাই করতে চায় তারা। নেশা, টাকা হোন্ডা, অপরাধ, পছন্দের মানুষ যা চাই সব যেন নাগালের মধ্যে পেতে চায় তারা। এভাবে বিনষ্ট হচ্ছে আমাদের স্বপ্নের সন্তানেরা। পতঙ্গ যেভাবে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেভাবেই যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে এরা। সামাজিক পচনের শিকার এসব তরুণেরা। আমাদের আশা-স্বপ্ন যাদের ঘিরে তাদের মধ্যে সর্বনাশের বীজ বপন করছে কারা? তাদের জন্য গ্যাং স্টারদের দৌরাত্ম্য কমছে না। ফলে জনমনে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- কী হচ্ছে এসব? এভাবেই কি চলতেই থাকবে? না তাদের এভাবে চলতে দেয়া যাবে না। এজন্য সব অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরুরি, বড় ধরনের একটি সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এটা কোনমতেই রোধ করা সম্ভব না। এটা একটু এদিক-ওদিক হলে একটি প্রজন্ম ধ্বংস হবে। আমাদের স্বপ্ন যাদের নিয়ে তাদের এই সর্বনাশের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই।

কিশোর-তরুণদের এভাবে বখে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে এই গ্যাং কালচার তৈরি হতে দেখা গেছে, যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় জুভেনাইল সাব-কালচার। অনেক সময় বঞ্চনা থেকে কিশোরদের মধ্যে এমন দল গড়ে ওঠে। আবার কোথাও কোথাও বীরত্ব দেখাতেও ছেলেরা “মাস্তানি”তে যুক্ত হয়। পাড়ায়-মহল্লায় আগেও এমনটা হতো। এখন সেটার সহিংস রূপ দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, খেলার মাঠে বা ছোটখাটো ঘটনায় কিশোরদের মধ্যে ঝগড়া হয়। কিন্তু সেটা যাতে সহিংসতার দিকে না যায়, সে ব্যাপারে এলাকার মুরব্বি ও অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিশোর-তরুণদের গঠনমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

 


 

আরও পড়ুন