• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯, ০৪:১৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯, ০৪:১৩ পিএম

নদী যখন জীবন্ত সত্তা

নদী যখন জীবন্ত সত্তা


নদীকে জীবন্ত সত্তা আখ্যায়িত করে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। নদীর যে জীবন আছে তার একটা স্বীকৃতি। নদীমাতৃক দেশে এই রায় মাইলফলক হয়ে থাকবে। ‘নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ বহুল আলোচিত একথার সার্থক বাস্তবায়নের উদ্যোগ এবারে দেখা যেতে পারে। সাধারণ জনগন আশা করে কৃষি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সমাজ ও সভ্যতা সবদিক বিবেচনা করে নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা ব্রতী হবেন। যদিও হাইকোর্টের এমন ঐতিহাসিক রায় এই প্রথম নয়। অতীতেও নদী রক্ষায় হাইকোর্টের এমন উদ্যোগ সাধারণ জনগণ দেখেছে। কিন্তু সেই রায়কে সংশ্লিষ্টরা খুব একটা সম্মান দিয়েছে এমন নমুনা জাতির সামনে নেই। তাই বর্তমানের নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা সংশ্লিষ্টদের কতটা উৎসাহিত করবে, কতটা আন্তরিক করতে পারবে তা আগামীই বলতে পারবে। প্রকৃত অর্থে আমাদের নদীর কোন মালিকানা নেই। সবাই নদীকে তার প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে মাত্র। ব্যবহারকারীদের নদী রক্ষায় কোনো দায় আছে বলে মনে হয়না। সরকার নদী রক্ষা কমিশন গঠন করে নদী রক্ষার দায়িত্ব প্রদান করলেও সেটা একটা অর্থব প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনো প্রমাণ রেখে চলেছে। সেইজন্য আমাদের নদী রক্ষার উদ্যোগ অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সচল থাকলে সাধারণ মানুষ আশ্চর্য হবে না। 

বাংলাদেশে নদী রক্ষায় প্রায় ১৫টা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট আছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী শাসনের দায়িত্ব পালন করে। পরিবেশ অধিদপ্তর নদীর পানি দূষণ রোধ করার দায়িত্ব পালন করে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে জেলা প্রশাসক নদীর বিভিন্ন অংশ বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ নদীকে নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। অথচ নদীর পানির মালিক পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, তলদেশের মালিক ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পাড়ের মালিক নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। যে কোনো উন্নয়ন কাজের জন্য সবাইকে পরিকল্পনা ও অর্থ মন্ত্রনালয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। নদী দখলমুক্ত রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা প্রকট। এই সমন্বয়হীনতাই নদী রক্ষায় প্রধান বাঁধা। সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনটুকু কোনোভাবে মিটিয়ে দায় শেষ করে ফেলে।

অন্যদের কোনো অসুবিধা আছে কিনা তা দেখার দায় অনুভব করে না। এই সমন্বয়হীনতার মধ্যেই নদী রক্ষার খেলা চলছে। সবাই নদী রক্ষা করতে চায় কিন্তু নিজেদের স্বার্থে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। কেউ কোনো উদ্যোগও নিতে চায় না।  নদীমাতৃক বাংলাদেশর নদীর জীবন সংকটাপন্ন। উজানের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, দখল হয়ে যাচ্ছে। উৎসে পানি পাওয়া যাচ্ছে না, সমুদ্রের লবণ পানি শুধু নদী দিয়ে মূল ভূখণ্ডের ভিতরে আসছে না বরং ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে প্রবেশ করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়ছে, জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে।  লোনাপানি বৃদ্ধির ফলে জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফসল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, মাছের উৎপাদন কমছে, সেচকার্য ব্যাহত হচ্ছে, নাব্যতা সংকটাপন্ন, নৌপথ অচল হয়ে পড়ছে, মানুষের জীবন-জীবিকা বদলে যাচ্ছে, পরিবেশ বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নমূখী, বনায়ন হুমকির মুখে, আর্সেনিক সমস্যার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটার পর একটা আঘাত হানছে, মরুকরণের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা জেঁকে বসছে। নদীর সংকটাপন্ন জীবনের ফলে জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর  এমন অনেক প্রভাব পড়ছে। 

সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা আখ্যায়িত করে নদী রক্ষায় সরকারকে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বলেছে। হাইকোর্টের রায় বর্তমান সরকার কতটা আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়ন করবে,  ধারণ করবে তাই এখন দেখার বিষয়। সরকার দেশের ৫৩ টি নদী খনন করে ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল করার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ২০১২ সালের জুলাই মাসে যা শেষ হবে ২০২৫ সালের জুন মাসে। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। এই প্রকল্প কতটা আন্তরিকতার সাথে সংস্থা দুটো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা জানি না তবে হাইকোর্টের রায় সরকারকে প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো উদ্যোগী করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করুক সেটাই কাম্য। 

মহাজোট সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় হাইকোর্টকে নদী রক্ষায় হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে। হাইকোর্টের নির্দেশে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পুলিশ মোতায়েন করেও কোনো উপকার পাওয়া যায়নি। দখলদারদের তালিকায় সরকারি- বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জেটি, ডকইয়ার্ড, বসত বাড়ি, মসজিদ, মন্দির আছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার কারণে দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রমে অপশক্তির প্রভাবসহ রাজনৈতিক চাপও লক্ষণীয়। ধর্মভীরু বাঙালির জন্য স্পর্শকাতর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ কঠিন হয়ে পড়ে। সি এস ম্যাপ অনুযায়ী দখলকৃত এলাকার স্থাপনার অনেকে নিজেদের বৈধ মালিক বলে দাবি করে আইনের আশ্রয় নিয়ে থাকে। তাই দখলদার উচ্ছেদ প্রক্রিয়া যে গতি পাওয়ার কথা তা কোনদিনই পায়নি। বরং উচ্ছেদের পর তা আবার দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এসেছে।

 সে কারণে সাধারণ মানুষ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাব মনে করে উচ্ছেদকে নতুন পত্তন দেয়ার কৌশল হিসেবে দেখে। সরকারি ব্যয়ে উচ্ছেদের পরপরই নতুন করে নতুন একজন স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করে। একসময় শুধু রাজধানীতেই আড়াই হাজারের বেশি জন বালি ও মাটি ফেলে ভরাট করে নদী দখলের নমুনা জাতির সামনে আছে।  বর্তমান সময়ে দেশব্যাপী নদীকে দখল মুক্ত করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এ উদ্যোগ পথ হারিয়ে ফেলবে কিনা জানিনা। তবে সরকারি ব্যয়ে উচ্ছেদ বন্ধ করা প্রয়োজন। দখলদারদের কাছ থেকে অর্থদন্ডসহ সমুদয় ব্যয় আদায়ের কার্যক্রম শুরু করা জরুরি। জনগণের অর্থ এমন কাজে ব্যয় করার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। সাধারণ মানুষ আশা করে অবিলম্বে সরকারি নির্দেশ জারী করে ব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করা হবে। 

সম্প্রতি সময়ে দেশব্যাপী নদীকে দখলদার মুক্ত করার সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে। সর্বত্র মানুষ নদীকে দখলমুক্ত করতে সোচ্চার। কিন্তু আমাদের ভাবনায় থাকা প্রয়োজন নদী দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় দখল হয়েছে। আমাদের দেশে এখনো অনেক প্রবীন আছেন যারা নদীগুলোর প্রমত্তা রূপ দেখেছে। কিন্তু তা এখন আর নেই। একশ বছর আগের সিএস ম্যাপ দেখলেই পরিবর্তন সকলের কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে। পর্যায়ক্রমিকভাবে যারা সি এস ম্যাপ পরিবর্তন করে দখলে সহযোগিতা করে দেশ ও জাতিকে বঞ্চিত করেছে তাদের কোনো দায় নেই? একাজে সংশ্লিষ্টদের আইনের আশ্রয়ে আনা প্রয়োজন। আজ নদী খনন করতে গিয়ে অতীতের প্রমত্তা নদীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক জায়গায় খাল খননের মতো করে দায়িত্ব শেষ করতে হচ্ছে। এখানে প্রমত্তা ভৈরব নদ খনন উল্লেখ্য। এক সময় জেলা প্রশাসকরা নদীর জমি বিভিন্ন কাজে বরাদ্দ দিয়ে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সহায়ক শক্তি ছিল। অস্থায়ী বরাদ্দে স্থায়ী স্থাপনা কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো না । বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাব দখলের সহায়ক শক্তি। তাই সাধারণ মানুষ দখলদার দেখতে পায় না। আর দখলদাররা নিজেদের মালিক দাবী করে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। 

নদীকে জীবন্ত সত্তা বিবেচনায় নিলে দূষণ রোধ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন শিল্প, হাসপাতাল ও পয়ো:বর্জ্যরে ভারে নদী দূষণ হচ্ছে। অপরিশোধিত বিষাক্ত তরল বর্জ্যরে পাশাপাশি কঠিন বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। শিল্প-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য শোধন ছাড়াই নদীতে মিশ্রিত হয়। এতে নদী যে মাছ শুন্য হয়ে পড়ছে তাই নয় জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং জন স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে গড়ে না উঠার কারণে, নদীর পাড়ের শিল্প-কারখানার তদারকির ব্যবস্থার গাফিলতি , নৌযান বর্জ্য সব মিশছে গিয়ে নদীতে। নদীর প্রবাহ স্থিত হওয়ার কারণে নদীর উপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তাতে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের প্রকোপ সবচাইতে বেশি হবে। বিশ্বে নদী পথ ধরে যেমন সভ্যতা এসেছে আবার নদীর সাথে সাথে সভ্যতার বিলোপও লক্ষ্য করা যায়। তাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নদী রক্ষায় সরকার আন্তরিক হবে। 

মহাজোট সরকার নদী রক্ষা কমিশন গঠন করে তার আন্তরিকতা প্রকাশ করেছে।  নদীর সিমানা নির্ধারণ, দখলমুক্তি, দূষণরোধ, আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা প্রাপ্তি, বহতা রূপ দেয়া ইত্যাদিতে কোনো ভুমিকা নেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।  নদী শাসন, নদী বরাদ্দ, নৌপথ ব্যবস্থাপনায় কমিশন । নীরব সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল কমিশন নদীর মালিকানা গ্রহণ করে সার্বিক ভাবে নদী রক্ষায় ব্রতী হবে। কমিশনের প্রধান দেশের উত্তরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের এক নদী রক্ষার আন্দোলনে দুই মাসের মধ্যে দখলদারদের তালিকা প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আজো তা প্রকাশ করেননি। জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা না থাকলে যা হয়। 
সবাই নিজের মনে করে নদী ভরাট করছে, বেড়ি বাঁধ দিচ্ছে, দূষণ করছে, দখল করছে, নৌযান চালাচ্ছে। নদীর মালিকানার দাবিদার হয়ে একটা সমন্বিত পরিকল্পনাই নদীকে জীবন্তা সত্তা হিসেবে জাতির সামনে দাঁড় করতে পারে। 

    লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনষ্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)