• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৯, ০৫:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৯, ০৫:৪১ পিএম

‘৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা

‘৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা

১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস। শিক্ষার অধিকার আদায়ে ঐ দিন ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেটে জীবন দিতে হয়েছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতাদের । সামরিক শাসক ফিল্ডমার্শাল আয়ুবখানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা হয়েছিল।   যে শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবয়বে মানাসই ছিলনা- অপ্রাসঙ্গিক ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা সংকোচন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছরের শেষে পরীক্ষা ব্যবস্থা , ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাশ কোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধি প্রস্তাবনা অন্যতম।

এগুলি বাতিলের দাবিতে ‘৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট আহবান করা হয়েছিল।গড়ে তুলেছিলো দুর্বার আন্দোলন। সেই ধর্মঘট পালনকালেই  ছাত্পুর মিছিলে গুলি করে পুলিশী এই হত্যাকান্ডের সূচনা হয়। আন্দোলনের তীব্রতায় বেগতিক হয়ে  আয়ুব খান শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করেছিল। কিন্তু ‘৬২ শিক্ষা  আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে মুক্তির অন্বেষায় চলে যেতে হবে বহুদূর। শিক্ষা ততোদিনে  সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসাবে পৃথিবীর দেশে দেশে গৃহিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা পত্রের ২৬ ধারায় নাগরিকের জন্য শিক্ষা লাভের অধিকার ঘোষণা করা হয়েছে। অন্ততপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমুলক শিক্ষা সাধারণ ভাবে সহজলভ্য থাকবে, এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমভাবে উপযুক্ত থাকবে। এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণের পর জাতিসংঘ সকল সদস্য রাষ্ট্রকে ঘোষণা পত্রের বিষয়বস্তু প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য আহবান জানায়।

সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে সবারই দায়িত্ব বর্তায় এগুলি বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সেটা কার্যকর হয়নি। বরং ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান প্রথমেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বাংলা ভাষা ধংসের চক্রান্ত করে ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে উর্দূর কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশী হামলায় ৭ জন বামপন্থী রাজনীতিককে হত্যা ও ৩২জনকে আহত করে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি  বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে গুলি বর্ষনের মাধ্যমে হত্যা করে সালাম, বরকত, রফিক, সফিক ও জব্বারকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ৯২ এর ‘ক’ ধারা জারির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। 

 স্বাধীন পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত একটি সংবিধান পর্যন্ত প্রণয়ন সম্ভব হয়নি বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের স্বার্থ বিরোধী  নানা কালাকানুন জারি করতে থাকে পাকিস্তানের  শাসকেরা, শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিকশিত  মানবতার পরিবর্তে পুলিশী রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়া হিসেবে  ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়।  এসমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের  সচেতন এবং  রাজনৈতিক মহলে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবেই ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটেছিল। 
 ১৯৪৭ সালে বৃটিশশাসন মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও পাকিস্তানে বৃটিশদের মতই পুঁজিবাদী  তথা ধনিক বনিক নির্ভর লুটেরা অর্থনীতির পথ অনুসরণ  করে। ১৯৫৬ সালের গৃহিত সংবিধানে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রগতিশীলতা অবরুদ্ধ হয়, বাঙ্গালি সংস্কৃতিও বাংলাভাষাকে  ধংসের চক্রান্ত হয়।  সব মিলে বাঙ্গালিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সামরিক শাসন বলবৎ থাকায় সভা সমাবেশ মিছিল মিটিং বন্ধ হয়ে যায়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি সীমিত  পরিসরে প্রভাতফেরী অনুষ্ঠিত হতো ? ১৯৬২ সালে ১লা ফেব্রুয়ারী ছাত্র-ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্র নেতাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। 

  শিক্ষা  কি? কেন এবং কিভাবে এটা প্রদান করা যায় সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভোগবাদী সমাজে মুনাফা ভিত্তিক এবং পুঁজিবাদী সমাজে যেভাবে  সব কিছুকে পন্য ভাবা হচ্ছে এবং টাকা দিলে পন্যের মত সবই পাওয়া যায় এমন প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। শিক্ষাকে এখনও অধিকাংশ দেশেই সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার হিসেবে  স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই বিবেচনায় শিক্ষার দর্শন নির্ধারিত হলে  শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার কথা নয়। এ জন্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়ন এর বিষয়েও ভাবনার উন্নতি হওয়া দরকার। ব্যক্তির দেহ ও মনের সকল ক্ষমতা বিকশিত, বিবর্তিত মার্জিত করে, তাকে বর্তমান ও ভবিষৎ এর জীবন যাপনের  জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান নৈপুন্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলার ব্যবস্থাদির নাম যদি শিক্ষা হয়, তাহলে মানবতাবাদী এবং কল্যানমুলক রাষ্ট হলে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন,  ও ব্যবস্থাপনা এমন হবে, যেখানে সবার জন্য একই ধরনের  অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা হওয়া দরকার। পৃথিবীর  যে সমস্ত দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি আর অর্থনীতিতে  এগিয়েছে, তাদের শিক্ষার ইতিহাস   এমনটাই।

শিক্ষার দর্শন হিসেবে ভাববাদ, যুক্তি, দর্শন সর্বশেষে বিজ্ঞানই অন্যতম মাধ্যম। এই ধারাবাহিকতাকে  উপেক্ষা করে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করলে  শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যুগের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে কি?  ১৮৩৫ সালে বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে লর্ড মেকলেকে দিয়ে  সেই শিক্ষানীতি দেওয়া হয়েছিল, যা অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ও হিসাব নিকাশ করার মত একটি জাতি সৃষ্টি ছাড়া সৃজনশীল ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহনকারী বা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মত চেতনাবোধ ঐ শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়নি। ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সংবিধান (১৯৫৯) গৃহীত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চারমূলনীতি জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আলোকে এবং সংবিধানের ১৭ এর খ ধারার আলোকে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় বাজেটে জিজিপির প্রাথমিক ভাবে ৫% এবং পর্যায়ক্রমে ইউনেস্কোকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭% করার প্রস্তাব করা হয়েছিল।

তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু একবারে ৩৫১৭০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেছিলেন,তার কন্যা বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর আমলে আরো ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল সরকারি করা হয়েছে,যদিও এখনও ৪ হাজারের মত প্রাইমারি স্কুল বেসরকারি রয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস সেই সাথে শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আবার সাম্প্রদায়িক করা হয়েছিল, এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। সংবিধানে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের (তিনধারার) শিক্ষা বহাল রয়েছে। শিক্ষায় অর্থায়ন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভুত বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি বাদে সবগুলোতে দলীয়করণের ভূত চেপে বসেছে, ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার লোক অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ফলে শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

সৃজনশীল এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এ+ আর গোল্ডেনের সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ব-বিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে নুন্যতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারে না।  আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। বেসরকারিভাবে গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকরা শিক্ষা ব্যবসা শুরু করে শিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মত যার টাকা আছে সেই সেটা কিনতে পারবে। এটি জীবন দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক, তবে এটাই এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে। ২০১০ সালে বর্তমান সরকার একটি শিক্ষানীতি দিয়েছিল, যেখানে শিক্ষার দর্শনে মুক্তিযদ্ধের চেতনা ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিধান যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, সাথে সাথে ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রেই কোন ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি বরং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির ক্ষমতাশীল আমলে শিক্ষা কারিকুলামে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়েছে।

আগে-পিছের শিক্ষার একাডেমিক ও কারিকুলামগত স্বীকৃতি না থাকলেও কওমী মাদ্রাসার শেষ পর্যায়ের কোর্সকে শেষ পর্যায়ের শিক্ষাকে মাস্টাসের মর্যাদা শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল সৃষ্টি করেছে।মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই শিক্ষাকে কোন ভাবেই সমর্থন করা যায় না। বিজ্ঞান যুক্তি আধুনিক সমাজে শিক্ষার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত মানবিকতা, সৃজনশীলতা, যৌক্তিকতা ও উৎপাদনশীল। ‘৬২এর শিক্ষা আন্দোলনকে দমন করতে তখনকার শাসক, পুলিশ ব্যবহার করেছিল আর আজকের ছাত্র আন্দোলনকে  দমন করতে শাসকমহল পুলিশ ও দলীয়  লাঠিয়াল ও হেলমেট বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মত একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন দমন করতে  যেভাবে হামলা গ্রেফতারের  ব্যবস্হা করেছিলো সেটা এ সরকারের কাছ থেকে কেউ আশা করেনি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড  খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই যখন দুর্নীতি অনিয়মের ভূত ঢোকে তখন কারো করার কিছুই থাকে না, ভর্তি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় তখন শিক্ষার করুণ অবস্হা বুঝতে আর কোন বিষয়ের খোঁজ করার প্রয়োজন নেই। তবে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ব-বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি  (বাকবিশিসি)।