• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯, ০৬:৫০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯, ০৬:৫০ পিএম

ফুটপাতেও নিরাপদ নয় জীবন

ফুটপাতেও  নিরাপদ নয় জীবন

পরিবহন খাতের চরম নৈরাজ্য এখনো চলমান। শুধু চলমানই নয়, এর বহুমাত্রিক বিস্তার ঘটছে। রাজপথে, সড়কে, মহাসড়কে নিয়মিত প্রাণহানি ঘটছে নারী-পুরুষ-শিশু কেউ বাদ যাচ্ছে না। ঈদ উপলক্ষে মহাসড়ক হয়ে ওঠে মৃত্যু উপত্যকা, বহু পরিবারের কান্নার স্রোতধারায়। এই ঘাতক নৈরাজ্যের প্রতিকার নেই, প্রতিরোধ নেই। এ যেন জীবনের এক চলমান প্রক্রিয়া। যা আমাদের জীবনের অংশ!

বছর কয় আগে মৃত্যুর এ কাফেলা নিয়ে কত মানববন্ধন, কত প্রতিবাদ, এমনকি ছাত্রছাত্রীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দাবিতে আন্দোলন হলো। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এক সময় দাবি উঠেছিল নৌপরিবহনমন্ত্রীর পদত্যাগের, পদচ্যুতির। পরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ওই মন্ত্রী মন্ত্রীপদ থেকে বাদ পড়েও পরিবহন নেতৃত্বের নায়ক থেকে গেছেন। কিন্তু সমস্যা শুধু পরিবহন খাতের নায়কই নন, বড় সমস্যা ওই খাতের মালিক-চালক সিন্ডিকেট রাজনীতি মুনাফাবাজি নেপথ্যে নায়ক কতটা জড়িত তা আমাদের জানা নেই। বহুজনের লেখায়ও অভিযোগ সিন্ডিকেট নিয়ে, দাবি সিন্ডিকেট ভাঙার। দরকার সরকারের সুহস্তক্ষেপ।

সমস্যা মাত্র গুটিকয়, তা বহু আলোচিত। লেখকদের ভাষায় সড়কে রাজপথে লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলা বন্ধ হোক। হচ্ছে না। দাবি মালিক-চালক অশুভ চুক্তি বন্ধ করে চালকের নিয়মতান্ত্রিক চাকরির প্রথা চালু হোক। তা হচ্ছে কি? দাবি লাইসেন্সবিহীন বাস বা চালক থেকে সড়ক-রাজপথ মুক্ত হোক। হচ্ছে কি? এমনই সংশ্লিষ্ট একাধিক সমস্যা পরিবহন খাতকে মৃত্যুদূত তৈরিতে সাহায্য করছে। প্রতিকার চোখে পড়ছে না।এ পর্যন্ত গত কয়েক বছরের বহু ঘটনা, বহু ট্র্যাজিক মৃত্যু এর প্রমাণ দেবে যেগুলোকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো দৈনিকেও অসচেতনভাবে লেখা হয় দুর্ঘটনায় মৃত্যু। আসলে এগুলোর অধিকাংশ দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু নয়, সোজা সরল ভাষায় হত্যাকাণ্ড। ইদানিং সংঘটিত বেশ কয়েকটি ঘটনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে এক কথায় নৈরাজ্য এ নিবার্য মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী।

ক্ষেত্রবিশেষে যানবাহন চালকের স্বীকারোক্তি, হেলপার নামক ভয়ঙ্কর তরুণ বা যুবকটির স্বীকারোক্তি প্রমাণ করছে, দুর্ঘটনা নয়, পুরো দায় প্রধানত যানবাহন মালিকের, অংশত যানবাহন চালকের আর হেলপার সাহেব তো কখনো হত্যাকাণ্ডের নায়ক। ধাক্কা দিয়ে যাত্রীকে নিচে ফেলে দিয়ে মারার ক্ষেত্রে তার তুলনা নেই। আর তিনি যখন চালকের আসনে বসেন, লাইসেন্সবিহীন অবস্থায় স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখেন তখন তিনি সম্রাট, বেপরোয়া বাস, ট্রাক চালানোর ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে আমরা শুধু দুচারটে ট্র্যাজিক উদাহরণ তুলে ধরব সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে। প্রশ্ন রাখব ওই সব ট্র্যাজেডির কী ক্ষতিপূরণ? আর সে ক্ষতিপূরণ কে করবে। চালক না বাস মালিক? আর পরোক্ষ দায় তো নিঃসন্দেহে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের, যাদের সহৃদয়তায় ঘটনাগুলো ঘটতে পারছে।

দুই.
দিন কয় আগে সংবাদপত্রে একটি খবর দেখে চমকে উঠি, ফুটপাতে দাঁড়ানো কৃষ্ণা রায় চৌধুরী বাসের ধাক্কায় একটি পা হারালেন। সংক্ষিপ্ত খবরটি হলো ‘রাজধানীর বাংলামোটরে গত মঙ্গলবার ফুটপাতে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় আহত কৃষ্ণা রায়ের বাঁ পা হাঁটুর ওপর পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে। … দায়ী ট্রান্সপোর্ট বাসের চালক, সহকারী ও মালিককে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ… হতাশ কৃষ্ণার পরিবার।’


কৃষ্ণা রায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের অর্থ বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক। তা সত্ত্বেও ঘটনার তদন্তে অবহেলা লক্ষ করে পরিবার সুবিচারের আশায় উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কারণ কৃষ্ণার জীবন তো পঙ্গুত্বে পর্যবসিত হলো। আর পূর্বোক্ত সংবাদে লক্ষণীয় শব্দটি হলো ‘বেপরোয়া’ চালানো একে কি দুর্ঘটনা বলা যায়? আমি বরাবর এ জাতীয় ঘটনায় সাংবাদিক বন্ধুদের ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটি সতর্কভাবে ব্যবহারের অনুরোধ করে থাকি। কারণ তাদের প্রতিবেদনও কখনো আদালতে তথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে বা হতে পারে। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ওই বাসের চালক দাবি করে যে বাসটিতে সমস্যা ছিল। এ দাবি সঠিক হলে একাধিক সূত্র এ ক্ষেত্রে দায়ী। যেমন যারা এ বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়েছেন, দ্বিতীয়ত, বাসের মালিক এবং ঘটনা জানা সত্তে¡ও চালক এমন গাড়ি চালাতে গেল কেন কিংবা যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে চালায়নি কেন যার ফলে বাসটি ফুটপাতে উঠে একজন মানুষের জীবন পঙ্গু করে দিল। কোনো ক্ষতিপূরণ তো তার জন্য ক্ষতিপূরণ নয়।


এখানেই ঘটনা শেষ নয়। আরেকটি সংবাদে প্রকাশ, ‘ভারী যানের লাইসেন্স ছিল না মোরশেদের।’ শুধু ভারী যানই নয়, এ প্রতিবেদনে প্রকাশ, ‘কৃষ্ণা রায়কে চাপা দেয়ার দিনই মো. মোরশেদ প্রথম বাসের চালকের আসনে। আর ওই দিনই সড়ক থেকে বাসটি তুলে দেয় ফুটপাতে।’বিশদ বিবরণে না যেয়ে এতেই বোঝা যায়, ইনি বাসের চালকের আসনে বসার উপযুক্ত নন। তার অপরাধ বিবিধ প্রথমত, লাইসেন্স ছাড়া বাস চালানো। দ্বিতীয়ত, অদক্ষতা নিয়ে ভারী যান চালানো। এ দুই অপরাধের কতটা সুবিচার হবে আমরা জানি না কতটা শাস্তি হবে মূল দুই অপরাধীর চালক ও মালিকের, তৃতীয়ত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তার, তাও জানি না।একটি ঘটনার বিশদ বিবরণ দেয়ার উদ্দেশ্য শুরুতে প্রদত্ত আমাদের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ। কারণ পরবর্তী ঘটনাগুলো আমরা শুধু সূত্রাকারে তুলে ধরব যেগুলো আরো ট্র্যাজিক যেগুলোর কোনো ক্ষতিপূরণই হয় না। মৃত মানুষকে তো কেউ ফিরিয়ে আনতে পারে না। বেপরোয়া বাস চালিয়ে চাপা দিয়ে যাদের হত্যা করা হলো এবং হচ্ছে তার জন্য দায়ীদের কী বিচার হবে, বা হয়ে থাকে? এ প্রশ্নের জবাব দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক, একই সঙ্গে নেতিবাচক।


কৃষ্ণা রায়ের ঘটনা ফয়সালা হতে না হতে সংবাদ শিরোনাম : ‘ফের ফুটপাতে বাস, প্রাণ গেল কর্মজীবী নারীর।’ সাংবাদিকের ভাষায় কৃষ্ণার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ‘মহাখালীতে বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারালো ফারহানা নাজ (২৮) নামের আরেক কর্মজীবী মহিলা।’ বয়স তো মাত্র ২৮ বছর। সামনে দীর্ঘ জীবন রেখে এই যুবতি নারী প্রাণ হারালেন নিঃসন্দেহে অসতর্ক বাসচালকের কেরামতিতে। কে তার জীবনটা ফিরিয়ে দেবে, বা দিতে পারবে? একই সময় ‘তুরাগে বাস চাপায় সঙ্গীত পরিচালক পারভেজ রবের মৃত্যু।’ এ খবরটি অন্যত্র ভিন্ন শিরোনামে পরিবেশিত যেখানে রয়েছে ‘বেপরোয়া বাসের ধাক্কা’ শব্দ তিনটি। এই সঙ্গে আরো কয়েকটি দুঃখজনক মৃত্যুর ঘটনা পরিবেশিত। যেমন, ‘গাজীপুরে সিআইডির পরিদর্শক ও ঝালকাঠিতে এক কারারক্ষী নিহত।’ ‘রাজধানীসহ ১০ জেলায় নিহত ১৪ জন।’ একটি শিরোনামে ক্ষুব্ধ মায়ের অস্বাভাবিক আর্তি : ‘স্বামীর জন্য শোক করব/ নাকি ছেলেকে বাঁচাব’। ‘বাবার মৃত্যুর তিনদিনের মাথায় একই কোম্পানির (সুপ্রভাত-ভিক্টর) বাস চাপায় ছেলে আহত। বন্ধু নিহত।’ ‘ভিক্টর ক্লাসিক’ পরিবহনের বাসের চাপায় তিনদিনের মধ্যে একই পরিবারে শোকাবহ পরিস্থিতি। এ ঘটনাগুলো মাত্র দু’তিনটে দৈনিক পত্রিকা থেকে সংগৃহীত। বিশদ পাঠে হয়তো আরো বহু ঘটনার সন্ধান মিলবে। বহু ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়।

তিন.
দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে, সড়কে, মহাসড়কে চলছে এই বীভৎস মৃত্যুর খেলা। স্টিয়ারিং-হাতে অসতর্ক ড্রাইভার, বেপরোয়া ড্রাইভার, কখনো মাদকাসক্ত ড্রাইভার, আর কখনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা গোলযোগ সম্পন্ন যানবাহন। অর্থ ও মুনাফা। সেই টানে কখনো বেপরোয়া যান চালনা, কখনো অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মৃত্যুকে ডেকে আনা, ক্বচিৎ চালক বা হেলপারের। হেলপার চালকের চেয়েও এক কাঠি সরেস। এতই তাদের ক্ষমতার দাপট (সম্ভবত সিন্ডিকেটের দৌলতে) যে যাত্রীর সঙ্গে সামান্য কথা কাটাকাটি বা তর্ক ব্যস ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে মানুষটির প্রাণ নিতে বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধে না হেলপারগোষ্ঠীর। তারা আবার ড্রাইভার বা মালিক মহোদয়দের কল্যাণে চালক। ব্যস, আর কথা নেই, মৃত্যু তার হাত ধরে হেসেখেলে বেড়ায়। সবচেয়ে বড় নাগরিক দুর্ভাগ্য যে ফুটপাতের আশ্রয় নিয়েও রক্ষা নেই পথচারীর বা বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীর। বর্তমান কয়েকটি ঘটনা তার প্রমাণ। বছর দুই আগে আমার স্নেহভাজন এক তরুণ সাংবাদিক ফুটপাতে আক্রান্ত হয়েও কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে গেছেন। তবে কোমরে ব্যথা ও পায়ের ব্যথা সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে এই তরুণের।

স্বভাবতই আমাদের প্রশ্ন : রাজধানী ঢাকার ফুটপাতেও কি আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই? সড়ক-মহাসড়ক বা রাজপথের নিরাপত্তা তো অনেকদিন হলো উধাও। সতর্ক পথচারী ফুটপাত আশ্রয় করে চলতে শুরু করেছেন আজকাল নিরাপত্তার কথা ভেবে। সেখানেও তার জন্য অপেক্ষা করে আছে পঙ্গুত্ব বা মৃত্যু।
আমাদের প্রশাসন কী জবাব দেবে, কী করবে এখন মানুষ? কোন পথ ধরে চলবে? তাদের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব কি কারো নেই? এত যে লেখালেখি, এত যে আলোচনা তাতেও প্রশাসনের মনে হবে না, নিরাপদ সড়ক যাত্রা, ফুটপাতে নিরাপদে হাঁটা নিশ্চিত করতে সুব্যবস্থা গ্রহণের কথা? বহু কথিত ও সমালোচিত মালিক-চালক সিন্ডিকেট কুব্যবস্থা ভেঙে সুব্যবস্থা চালুর কথা মনে হবে না সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের? এভাবেই দিনের পর দিন মানুষের মৃত্যুর দায় বহন করবেন তারা?

 লেখক : গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।