• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯, ০৩:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৯, ১০:৪৫ এএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (১১)

মোশতাক কেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে পারেননি

মোশতাক কেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে পারেননি

ইতিপূর্বে আমরা আমাদের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণাদি ও দলিল-দস্তাবেজ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের  মাধ্যমে দেখিয়েছি যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের পেছনে যে আন্তর্জাতিক চক্রটি কাজ করেছে তাদের প্রধান ছিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। এর পরই ছিল পাকিস্তান ও পশ্চিম এশিয়ার দু-একটি মুসলিম দেশ। এই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল সৌদি আরব। এরা বাংলাদেশে তাদের ক্রীতদাসদের মাধ্যমে ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক, সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের পালের হাওয়াকে অন্য পথে ঘুরিয়ে দেয়া। অর্থাৎ বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে পরিচালিত করা, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিবর্তে পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনা প্রতিষ্ঠা করা। এসবের পাশাপাশি বাংলাদেশকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক করা, তাদের তাঁবেদারে পরিণত করা, তাদের বাজারে রূপান্তরিত করা, তাদের লুটপাটের চারণভূমিতে পরিণত করা। কিন্তু চক্রান্তকারীদের এ উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়নি।

১৫ আগস্ট বিয়োগান্ত ঘটনার পর সকালে ঘাতক ডালিম বেতারে ঘোষণা দেয় যে, ‘মুজিবকে’ হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাকের অধীনে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। ডালিম আরো বলে, ‘দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে এবং এখন থেকে বাংলাদেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে রূপান্তরিত হবে।’ ডালিমের ঘোষণা অনুযায়ী সেদিন অনেকেই বিশ্বাস করেছিল যে, বাংলাদেশ এখন একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র। কিন্তু খন্দকার মোশতাক এ ব্যাপারে কৌশলী ভূমিকা পালন করেন। একটি বিশেষ কারণে খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি পরিবর্তন করতে চাননি। তিনি অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে এই বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে তার ভাষণে আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করেন এবং ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে শেষ করেন। এভাবেই মোশতাক সবাইকে বোকা বানান।

খন্দকার মোশতাকের ওই দিনের ভাষণে দেশের অনেকেই ধরে নেন যে বাংলাদেশে ইসলামি শাসন কায়েম হয়েছে। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এতে বিভ্রান্ত হন। ডালিমের ঘোষণা শুনে এ দেশের ‍মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী আশান্বিত হয়ে উঠেছিল এই ভেবে যে বাংলাদেশে ইসলামি প্রজাতন্ত্র কায়েম হয়েছে। কিন্তু মোশতাকের ভাষণের পর তাদের আশা ভঙ্গ হয়। আসল কারণটা তাহলে কী ছিল? এ সম্পর্কে জানতে চেয়ে লন্ডনস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনে শত শত মানুষ ফোন করে। ডেপুটি হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরীর কাছে অনেকেই জানতে চান, দেশে ইসলামি প্রজাতন্ত্র কায়েম হয়েছে কি না? আর না হয়ে থাকলে ‘মুজিব’কে সপরিবারে হত্যা করা হলো কেন?

মোশতাকের কূটচালে শুধু বাংলাদেশিরাই নন - পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের মানুষও বিভ্রান্ত হয়েছিল। বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার ব্যাপারে খন্দকার মোশতাক মূলত ভারতের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর (২০ আগস্ট) শ্রী সমর সেন মোশতাকের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে  ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান জানান। এ ঘটনার প্রায় তিন মাস পরই সমর সেন অপহরণ প্রচেষ্টার শিকার হন। এসব বিষয়ে শ্রী সেন তাঁর  জীবদ্দশায় খুব একটা মুখ খোলেননি। শ্রী সমর সেন ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ১৯৯৮ সালের ২১ নভেম্বর ভারতের ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় তিনি ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনাবলি নিয়ে কথা বলেন। শ্রী সেনের মৃত্যুর পর ২০১১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কোলকাতার ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর তৎকালীন সম্পাদক মানস ঘোষ এক নিবন্ধে খন্দকার মোশতাক আহমদের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে পঁচাত্তরের একটি নাটকীয় পরিস্থিতির বিবরণ দিয়েছেন।

মানস ঘোষ তার নিবন্ধে বলেছেন, ‘১৫ আগস্টে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় ছিলেন না। ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন গাড়িতে চেপে কোলকাতা হয়ে ১৬ আগস্ট ঢাকায় পৌঁছান। তিনি কমিশনে তার সহকর্মী এবং ঢাকার বন্ধুদের সঙ্গে অনেকগুলো বৈঠক সেরে ১৮ আগস্ট বঙ্গভবনে যান। গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষমাণ ফটো সাংবাদিকদের সামনে তাকে সহাস্য দেখা যায়। এটা উপস্থিত কর্মকর্তাদের বিস্মিত করে। এরপর একখণ্ড কাগজ হাতে সমর সেনকে সরাসরি খন্দকার মোশতাকের কাছে দেখা যায়। মোশতাক দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন তার কূটনৈতিক নোট পড়ে শোনান। এই নোট শোনার পর খন্দকার মোশতাক বিমর্ষ মুখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন।’

এই কূটনৈতিক নোটে লেখা ছিল : ‘যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোনো দেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করা হয়, তাহলে ভারতের কাছে থাকা বৈধ চুক্তির আওতায় ভারতের সেনাবাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’ এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, খন্দকার মোশতাক এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা পাকিস্তানি কায়দায় দেশ পরিচালিত করলেও ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানের কারণে তারা বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেনি।

উল্লেখ্য, মানস ঘোষ তার নিবন্ধে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে শ্রী সমর সেনের সাক্ষাৎকারের তারিখ ১৮ আগস্ট উল্লেখ করেছেন, যা সঠিক নয়। শ্রী সেন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন ২০ আগস্ট, বুধবার।

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতি
পঁচাত্তরের ২০ আগস্ট শ্রী সমর সেন খন্দকার মোশতাকের সাক্ষাতের পর পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদের সঙ্গেও দেখা করেন। ওইদিনই বিকেলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের চার্জ-দ্য-অ্যাফেয়ার্স বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কায়রোর দৈনিক আল আহরাম পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের কূটনৈতিক অব্স্থান স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশ ও অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে সকল আদর্শের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে সকল আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে কাজ করতে হবে।’ অর্থাৎ বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না এবং পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো প্রকার কনফেডারেশন করা যাবে না।

হেনরি বাইরোডের রিপোর্ট
১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড তাদের পররাষ্ট্র দফতরকে বাংলাদেশের ঘটনাবলি বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠান। এই হেনরি বাইরোড ছিলেন পদমর্যাদার দিক থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। কূটনৈতিক পেশায় যোগদানের জন্য তিনি সামরিক চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাইরোড তার প্রতিবেদনে লেখেন :

১.
পাকিস্তানিরা ঢাকার নতুন সরকাকে আবেগাপ্লুত হয়ে স্বীকৃতি ও সমর্থন দেয়ার নেপথ্যে বড় কারণ ছিল বাংলাদেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র হয়ে যাওয়ার বিষয়টি। এ কারণেই ঢাকার অভ্যুত্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করার চেষ্টা জটিল ও বিভ্রান্তিকর। কারণ বাংলাদেশের পুনর্নামকরণের খবর দেশটির সরকারি কর্মকর্তা, সংবাদপত্র ও জনমতে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। অথচ ১৮ আগস্ট সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথমেই বিবেচনায় নিয়েছে যে খবরটি হয়তো তথ্যভিত্তিক নয়। এটি ছিল ভুট্টোর ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি’ দেয়ার আড়াই দিন পরের ঘটনা। ২০ আগস্ট সকাল থেকে পাকিস্তানের সংবাদপত্র এ বিষয়টি কোনোমতে উল্লেখ করতে শুরু করেছে।

২.
বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের প্রতি পাকিস্তানের সংবাদপত্র ও জনগণের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল আবেগঘন এবং জোরালোভাবে ইতিবাচক। সব সংবাদপত্র বাংলাদেশের ঘটনাবলি যথেষ্ট ফলাও করে প্রচার করে। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি দৃশ্যত মুসলিম বৃত্তে ঢুকে পড়েছে ধরে নিয়েই পাকিস্তানে স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান এবং মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে দ্রুততার সঙ্গে দেয়া ভুট্টোর উদ্যোগ অগ্রণী পদক্ষেপ বিবেচনায় প্রশংসিত হয়।

৩.
বাংলাদেশের নতুন সরকারের বিরুদ্ধে ভারত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা তাদের রয়েছে। পাকিস্তানিরা ব্যাপকভাবে এবং সন্তুষ্টির সঙ্গেই বিবেচনা করে যে, বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থানের ফলে ভারত একটা বড় রকমের আঘাত পেয়েছে। সম্ভাব্য ভারতীয় অভিযানের বিষয়টি বিভিন্ন সংবাদপত্রে যেমন ছাপা হচ্ছে, তেমনি এ নিয়ে অন্যত্রও আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। সাংবাদিক এবং অন্যরা ঘরোয়াভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে ভারত আকস্মিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নিয়ে বসতে পারে। একইসঙ্গে পাকিস্তানে এমন ধারণাও ব্যাপক যে ভারত এই মুহূর্তে নিজস্ব সমস্যা মোকাবিলা করছে। আর ইসলামি দেশগুলোর কাছ থেকে বাঙালিরা ইতিমধ্যেই সমর্থন পেয়েছে। ফলে সেই ধরনের হস্তক্ষেপ এলে সৌদি আরবের মতো ইসলামি দেশগুলোর কাছ থেকে তা প্রতিহত করার ব্যাপারে সহায়তা মিলতে পারে।

ফ্রন্টলাইনকে যা বলেন শ্রী সেন
১৯৯৮ সালের ২১ নভেম্বর ভারতের ফ্রন্টলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে শ্রী সমর সেনের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাংবাদিক সুকুমার মুরলিধরন। সাক্ষাৎকারে শ্রী সেন বলেন, ‘ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্তি আমার পছন্দ অনুযায়ীই হয়েছিল। আমার আগ্রহের কারণ, বাংলাদেশে নবযুগের সূচনার সাক্ষী হয়ে থাকা। কিন্তু বাংলাদেশে আসার পর তিনটি চরম উদ্বেগজনক বিষয় আমার চোখে ধরা পড়ে। অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশটিকে তছনছ করে দিয়েছিল। যুদ্ধের কারণে জনগণ চরম দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত যোগ হয়ে অবস্থা আরও খারাপ করে তোলে।’

‘দ্বিতীয় যে ধাক্কাটি আমি খেলাম তা রাজনৈতিক। সেখানে যেমন ব্যাপক আকারে ভারতের প্রতি প্রীতি বিরাজ করছিল, তেমনি বিপুল বিদ্বেষও কাজ করছিল। কারণগুলো অবশ্য পরে বোঝা যায়। পাকিস্তানপন্থীরা প্রচার চালাচ্ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থে নয়, ভারতের স্বার্থেই প্ররোচিত হয়ে কাজ করেছিল। ভারত যা করেছে তা নিতান্ত তার আপন স্বার্থেই করেছে। আমি পরে বুঝতে পারি, এ ধরনের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও গণমাধ্যমে নিয়োজিত পাকিস্তানপন্থীরা। তাদের অনেকে তখনো এসব জায়গায় ঘাপটি মেরে ছিল।’

‘এসব কিছুর সঙ্গে যুক্ত হলো পাকিস্তানের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের অভিঘাত। ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে তাঁর বাংলাদেশে আসা ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মোহভঙ্গ ঘটারই আলামত, ভারতের প্রতি ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ যদি সত্য নাও হয়। এসবই হলো নেতিবাচক দিক। আর ইতিবাচক দিক এই যে, শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোগীদের মধ্যে ভারতের প্রতি ঘনিষ্ঠ মৈত্রীর বোধ ছিল। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তাঁরা বরং খুশিই ছিলেন। সুতরাং বুঝতে পারি যে, সমস্যা যা তা রয়েছে দৃশ্যপটের আড়ালে। কিন্তু তা যে কত মারাত্মক গভীরে চলে গেছে, তা আমরা বুঝতেই পারিনি। তাই ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ঘটনাবলি আমাদের জন্য ছিল ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙার মতো ব্যাপার।’

‘এটা পরিষ্কার যে, ওই সমস্যাপূর্ণ বছরগুলোতে শেখ মুজিব রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে এক রাখতে পারেননি। অন্যদিকে তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতির পিতা হিসেবে তিনি যেকোনো কিছু করতে পারেন। কিন্তু সেটা ছিল নিষ্ফল আশা। তাই অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির দশায় সেনাবাহিনীর মধ্যে সহিংসতা ও অসন্তোষ বাড়তে থাকে। আর তিনি ভাবতে থাকেন, ওরা তো সবাই আমারই সন্তান, আমিই ওদের আবার একত্র করব।’

‘সবকিছুর পর, সেটা ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের সময়। এর প্রভাবও পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বাংলাদেশকে নিজ নিজ বলয়ে নেয়ার জন্য সচেষ্ট ছিল। আমার ধারণা, আখেরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবই ছিল বেশি। কারণ, তারা সেখানে প্রচুর টাকা ঢেলেছিল এবং তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল বেশি দক্ষ। পাকিস্তানপন্থী মহল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অর্জন করে।’

‘এসব কিছু মিলে দুটি প্রবণতা দেখা যেতে থাকে। একটি এই যে, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ক্রমশ খোলামেলা রূপ ধারণ করে। দেশটির যাবতীয় সমস্যা, বিপর্যয় ও ঘাটতির জন্য ভারতকে দায়ী করা হতে থাকে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা শেখ মুজিবের প্রতি বিমুখ হন এবং তাঁর একচ্ছত্র অবস্থান ক্ষয়ে যেতে থাকে।’

‘এ অবস্থায়ই সেনাবাহিনীর ওই মেজররা নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়ে ফেলেন। যতই বিরুদ্ধাচরণ করুক, শেখ মুজিব বাঙালি মাত্রেই তাঁর সন্তান ভাবতেন এবং বিশ্বাস করতেন। নিজের মর্মান্তিক মৃত্যু সেই শিথিলতার চূড়ান্ত প্রতিফল হয়ে এল।’

‘আমরা বাংলাদেশের ভেতরকার সব পক্ষের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতাম। মুজিববিরোধীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলতাম। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রাখার ব্যাপারটি শেখ মুজিব ভালো চোখে দেখতেন না। তিনি আমাদেরকে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে বলেছিলেন। আমরা তা-ই করেছিলাম। আর পরিণামে অভ্যুত্থানের আগে আমরা বুঝতেই পারিনি যে, পরিস্থিতি কী পরিমাণ খারাপ হয়ে গেছে।’

‘আমেরিকানরা ছাড়া অন্যদেরও এ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। আমি এটা জোর দিয়েই বলছি। গবেষক লরেন্স লিফশুলজ এ বিষয়ে একটি বই লিখেছেন। ভারতের প্রতি তাঁর বিশেষ সহানুভূতি থাকার কথা নয়। তিনি আমাদের দৃষ্টিকোণের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না এবং তা বোঝার গরজও করতেন না। কিন্তু শেখ মুজিব হত্যার সঙ্গে মার্কিনদের যোগসাজশ প্রমাণে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, ওই অভ্যুত্থান সংঘটিত করায় আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। তাঁর এই সন্দেহের যথোপযুক্ত প্রমাণ তিনি তাঁর বইয়ে দিয়েছেন।’

‘এই হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখে যাওয়া ও অপেক্ষা করার পন্থা নিই। তবে একইসঙ্গে নতুন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গেও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের এই কৌশল ভারত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই পছন্দ করতে পারেননি। তখন আমাদের চালচলন এমন হলো যে, আমরা সব পথই খোলা রাখলাম। আমরা বাস্তবিক পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করলাম।’

‘যদি বিপর্যয় নাও হয়, এক অর্থে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বেলায় বিরাট ক্ষতি। সভ্য সমাজের রাজনৈতিক রীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবেও আমি মনে করি, দৃশ্যপট থেকে শেখ মুজিবের বিদায় এক বিপর্যয়কর ঘটনা। এর পরের মাসগুলোতে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের এক চক্রের মধ্য দিয়ে যেতে হয়...’

তথ্য সূত্র :  
দৈনিক ইত্তেফাক (২১ আগস্ট ও ২৭ আগস্ট)
মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড -মিজানুর রহমান খান
ফ্রন্ট লাইন : ২১ নভেম্বর ১৯৯৮

 

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

[ বি.দ্র : পরবর্তী পর্ব প্রকাশ হবে আগামী ২ অক্টোবর, বুধবার। ] 

আরও পড়ুন