• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০১৯, ০৫:১০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৬, ২০১৯, ০৫:১৪ পিএম

  ভারত-পাকিস্তান বাহাস এবং কূটনীতির স্বার্থবাদী খেলা!    

  ভারত-পাকিস্তান বাহাস এবং কূটনীতির স্বার্থবাদী খেলা!    

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪ তম অধিবেশনে সরকার প্রধানদের বক্তব্যে প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তান আবারও মুখোমুখি হল। এ নিয়ে সঙ্গত কারণে বিশ্বমিডিয়া কৌতুহল দেখানোয় বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে জোর আলোচনা চলছে। আর বিষয়টি নিয়ে পক্ষসমূহের আলোচনায় নতুন তেমন কিছু নেই বরং আছে গতানুগতিক বৈরীতার আস্ফালন। কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবতায় পাক-ভারতের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে কেবল বিরোধিতার কারনে বিরোধিতা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।

প্রতিবেশী এই দুটি দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু সেই '৪৭-এ দেশভাগের সময়। মনে রাখা দরকার, দেশভাগ যে সাম্প্রদায়িকতার বিষক্রিয়ার (দ্বি-জাতিতত্ত্ব) হয়েছিল তার দগদগে ঘা দিনে দিনে শুধু বেড়েছে বৈ কমেনি। যার সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হলো- এই বাহাস। সাধারণ পরিষদের মত বিশ্বমঞ্চেও কিন্তু তাঁরা রাখঢাক করতে পারলো না, বিশেষ করে পাকিস্থান!

কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্বকে ভারত বরাবরই অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উদ্যোগকে থামিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে-দেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এর ভালো-মন্দ আমরা ছাড়া আর কে ভাল বুঝবে? কিন্তু অন্যদিকে পাকিস্তান, বরাবরই চেষ্টা করেছে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে কৌশলগত সুবিধা আদায় করতে। দুই দেশের পরস্পর বিরোধী কৌশল আর তাদের সাথে বহিঃবিশ্বের দ্বি ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক এবং স্বার্থের প্রভাবও সমস্যাটিতে সময়ে সময়ে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করছে। ফলে সেই সকল প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা করা সঙ্গত হবে। কারণ, পাক-ভারত সম্পর্কের মাত্রা এবং অবস্থান নিয়ে আমাদের সরাসরি কিছু করার না থাকলেও সেটা যে দক্ষিণ-এশিয়ার সব মানুষকে ছুঁয়ে যা তা কী অস্বীকার করার জো আছে?

কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থান তার অভ্যন্তরীণ ও বিদেশনীতির সাথে পরস্পর বিরোধী হলেও সাতাশ তারিখে দেয়া পাক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যথেষ্ট সত্যতা রয়েছে। সরকার প্রধান হিসেবে সাধারণ পরিষদে প্রথমবার বক্তব্য দিয়েই ইমরান খান তার দেশের জনগণের চোখে হিরোও বনে গিয়েছেন, এ নিয়ে মিডিয়ায় বেশি বেশি প্রচারনা অন্তত সে কথাই বলছে। দীর্ঘ পঞ্চাশ মিনিটের বক্তব্যে খান সাহেব মোটাদাগে চারটি বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন যার মধ্যে সর্বশেষে এবং সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ (তাঁর ভাষায়) কাশ্মীর ইস্যুতে বেশী সময় কথা বলেছেন। তাঁর ভাষণটির রেপিড এনালিসিস করলে দেখা যায়, সেখানে ফ্যাক্টস-ফিগারস আছে, আবেগ আছে, আছে কূটনৈতিক চাতুর্য, আছে অতিরঞ্জণ এবং কূটনৈতিক অভব্যতাও। 

পুরো সময়টা জুড়ে তাঁর কথায় কাশ্মীরিদের প্রতি তাঁর (দেশের) আবেগ, মানবিকতা এবং তজ্জনিত রক্তক্ষরণও কম নেই বলে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বার বার একটি কথা বলছেন - তিনি এখানে এসেছেনই কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি বিশ্বসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। বক্তব্যে তিনি কাশ্মীরের বিদ্যমান বাস্তবতা অর্থাৎ লাগাতার কারফিউ, ৮০ লক্ষ মানুষের ৫৫ দিন ধরে বন্দীদশা, শিশু-বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষের অসহায়ত্ব, ১৩ হাজার যুবকের নিরুদ্দেশ হওয়া  ইত্যাদি অনেক আবেগঘন ভাষায় তুলে ধরেছেন। তিনি আরও বলেছেন-ভারত কীভাবে ৮০ লক্ষ মানুষের জন্য ৯ লক্ষ সেনা মোতায়েন করেছে, বলেছেন সাম্প্রদায়িক বিজেপি'র রাজনৈতিক দর্শন এবং আরএসএস'র ঘরে নরেন্দ্র মোদীর বেড়ে ওঠার কথাও।

শুধু মুসলিম জনগোষ্ঠী নয়, পৃথিবীর যেকোন অংশের আর্তমানবতার জন্য কারও কিছু করার আকাঙ্ক্ষাতো এপ্রিসিয়েট করার মত বিষয়। আর সেটা কোনো সরকার প্রধান যখন করেন তখন সেটা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু পৃথিবীর তাবৎ ছিন্নমূল মানুষ, শরণার্থী, আটকে পড়া, আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘু নানান জাতিগোষ্ঠীর কষ্টে খান সাহেব বা তাঁর দেশকে তো পাশে দাঁড়াতে দেখি না? বাইরের কথা বাদ দিলেও পাকিস্তানের দখলকৃত আজাদ কাশ্মীরের মানুষ কী স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে?

 বেলুচিস্তান এবং মহাজীরদের স্বাধীনতার দাবীকে তাঁর দেশ কীভাবে দমন করছে তা তো কারও অজানা নয়! '৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর দেশ কী নির্মমতায় ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম লুটেছিল তা তো তাঁর বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়? সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে বাঙ্গালী নিধনের ভয়াবহ ''অপারেশন সার্চলাইট' কিভাবে তাঁর দেশ বিশ্বসমাজের কাছে আড়াল করতে চেয়েছিল তা আজও মানুষ ভোলেনি। এই তো সেদিন ওয়াশিংটন পোষ্ট-এর সাংবাদিক জামাল খাসোগীকে তুরস্কে সৌদী দূতাবাসে হত্যার ঘটনায় সারাবিশ্ব যখন সেদেশের শাসকদের সমালোচনায় মুখর ঠিক তখন খান সাহেব ক্রাউন প্রিন্স সালমানের আমন্ত্রণে জেদ্দা সফর করেন। এবারও সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে তাঁর দল সৌদী আরব হয়ে রাজপরিবারের নিজস্ব চার্টার্ড ফ্লাইটে নিউইয়র্ক পোঁছান।

কিন্তু পাকিস্থানের পক্ষে সৌদী সমর্থন ধরে রাখতেই কাশ্মীরিদের জন্য মায়াকান্না করা এই ইমরান খান কিন্তু ইয়েমেনে সৌদী নেতৃত্বাধীন সর্বাত্মক যুদ্ধ আর নিরীহ মানুষদের হত্যার বিরোধীতা করছেন না। ইউনিসেফ-এর হিসাব মতে সেখানে প্রায় ৭০ লক্ষ শিশু বিদ্যালয় ছাড়া হয়েছে। আর শত শত অসামরিক মানুষ প্রতিদিন হতাহত হচ্ছে এবং দেশটি স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মধ্যে পতিত হয়েছে। অপরদিকে গত দু'বছর আগে প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গা মায়ানমার সেনানেতৃত্বে চালানো জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও তাঁর দেশ কোনও মন্তব্য করেনি। ইত্যাকার সব হিসেবে নিলে কাশ্মীরিদের প্রতি মায়াকান্না-কে নিঃশর্ত ভাবার কোন কারন নেই।

অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদী একই অধিবেশনে পাক প্রধানমন্ত্রীর মতো আক্রমণাত্মক না হলেও প্রতিবেশীর প্রতি তাঁর দেশের বিদ্বেষ ঠিকই প্রকাশ করেছেন। যদিও মোদীর বক্তব্যের ভাষা ছিল অনেক বেশী কূটনীতিকসূলভ। মোদী'র বক্তব্য পাক প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে তুলনামূলক বিচারে কতো ভাল হয়েছে তা নিয়ে ভারত ও তার বাইরে অনেকে সরব হয়েছেন। বিশেষ করে প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদী'র প্রদেয় বক্তব্যের যে প্রশংসা করেছে তা প্রণিধানযোগ্য।

কিন্তু নরেন্দ্র মোদী'র বক্তব্যে কী ছিল, যার জন্য এত ধন্য ধন্য প্রশংসা হচ্ছে? মোদী তাঁর বক্তব্যে স্বামী বিবেকান্দের ভাষণ থেকে কোড করেছেন। তিনি শিকাগো বিশ্বসভায় স্বামীজী'র দেয়া বক্তব্য থেকে বলেছেন-''সম্প্রীতি এবং শান্তিই (হারমনি এন্ড পিস) মানব ধর্ম''। উক্ত উদ্ধৃতির  মধ্যমে ভারত প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববাসীর জন্য সম্প্রীতি আর শান্তির আশাবাদ রেখে কথা শেষ করেছেন।

নরেন্দ্র মোদী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মতো বৈশ্বিক মঞ্চে যে ভাষায় কথা বলেছেন, যে গেশ্চার দেখিয়েছেন তা সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু সুশীল-শালীন বচন এবং এক্সপ্রেশন দিয়েই তো সব চিড়া ভেজানো যায় না। শান্তি আর সম্প্রীতি'র মতো আপ্তবাক্য কী শুধু শব্দগত বিষয়? শব্দ দুটির অন্তর্গত ব্যঞ্জণা এবং স্বামীজী যে অর্থে ব্যবহার করেছেন তা কী শুধু বুলি আউড়িয়েই পাওয়া যাবে? রাজনীতির পাশাখেলায় এধরণের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে সময়ে সময়ে সুবিধা নিলেও নেতৃবৃন্দ তার অন্তর্গত অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেন কী?

না, করেন নি! করলে তো ভারত প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যায় মিয়ানমারকে দায়ী করে দ্রুততম সময়ে সমাধানের জন্য চাপ দিতেন। শান্তি-সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী হলে তো শুধু মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিতেন না। নরেন্দ্র মোদীই ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি ২০১৭ সালে প্রথম ইসরাইল সফর করে তার দেশের বিশেষ সমর্থনের অঙ্গীকার করেন। এখানে বলে রাখা ভাল- ইন্ডিয়া ইসরাইলের নিকট থেকে যে পরিমান অস্ত্র-সমর প্রযুক্তি ক্রয় করে তা পরিমানের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর থেকে বেশী ক্রয় করে কেবল রাশিয়ার কাছ থেকে। ফলে ইন্ডিয়ার সাথে ইসরাইলের সম্পর্ককে কূটনৈতিক ভাষায় একান্ত সরল আখ্যা দেয়া যায় না।

 নিজদেশে কুড়ি কোটির উপরে মুসলিম জনগণের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে আমলে না নিয়ে হতভাগ্য আর নিষ্পেষিত প্যালেস্টাইনীদের বিরুদ্ধ শিবিরকে শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছেন। ইয়েমেন ও সিরিয়ার ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ইস্যুতেও ভারত স্পিকটি নট। '৪৭ এর দেশভাগের সময় গোয়া, হায়দারাবাদ, সিকিম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, ত্রিপুরা ইত্যাদি স্ব-শাসিত অঞ্চলকে ভারত অঙ্গীভূত করে নেটিজেনদের মতামতকে উপেক্ষা করেই। সে সকল অঞ্চলে পরবর্তিতে গড়ে ওঠা স্বাধীকার আন্দোলনের দাবীকেও বন্দুকের নল দিয়ে দমন করছে আর স্বাধীনতাকামী  যোদ্ধাদের কপালে জুটছে বিচ্ছিন্নতাবাদী/আতঙ্কবাদী'র তকমা! এতো এতো মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে পায়ে পিষ্ট করে কীসের সম্প্রীতি আর শান্তির কথা বলছেন নরেন্দ্র মোদী?

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছেন কাশ্মীর প্রসঙ্গে নিজ নিজ দেশের পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিশ্ব জনমতকে  প্রভাবিত করতে। আধুনিক কূটনীতির পরিভাষায় এসবই হয়তো ঠিক কিন্তু নৈতিক বিচারে, মানুষের অধিকারের পক্ষে ইনসাফ কায়েম করতে প্রতিবেশী দেশ দুটির চলমান প্রচেষ্টাকে প্রশ্ন করা কী অসংগত হবে? এমন একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতায় নেপথ্য কলকাঠি নাড়ছে আরও অনেকেই। পাক প্রধানমন্ত্রী যতই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে মধ্যস্থতার আবেদন জানাক, যুক্তরাষ্ট্র তা কোনোদিনও করবে না। কারন, তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে হু হু করে এগিয়ে আসা চীনকে সায়েস্তা করতে ভারতে পাশে পাওয়া একান্ত প্রয়োজন যা ট্রাম্প ও মোদীর চেয়ে কে ভাল বুঝবে! আর ভারতকে কেন্দ্র করে যে কোন বাহাসে  ঐতিহাসিক কারনেই আরেক পরাশক্তি রাশিয়াকে পাশে পাবে না পাকিস্থান।

উপর্যুক্ত বাস্তবতায় ভারতকে প্রতিপক্ষের চেয়ে ঢের শক্তিশালী মনে হলেও কৌতুহলী পাঠক মনে রাখুন শত্রু ভাবাপন্ন দেশ দুটিই কিন্তু আনবিক শক্তিতে বলীয়ান। ক্ষুদ্র স্বার্থ আর উগ্র জাতীয়তাবাদের উস্কানিতে ন্যুনতম লড়াইও এ অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় কোন মানুষই প্রত্যাশা করে না।

 লেখক : মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মী