• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০১৯, ০৬:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২০, ২০১৯, ০৬:০৮ পিএম

তামাক কোম্পানিকে দেয়া সকল সুবিধা বন্ধ করতে হবে 

তামাক কোম্পানিকে দেয়া সকল সুবিধা বন্ধ করতে হবে 

তামাক কোম্পানিকে দেয়া সমুদয় সুবিধা বন্ধ বা সীমিত করতে পারলে দেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ দ্রুত সম্ভব হবে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ বিএটিবি ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫টি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বিএটিবি-কে ‘জনস্বার্থে’ বিভিন্ন মেয়াদে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর (১) ধারা ০৬, ০৯, ১০০, ১০২, ১০৪, ১০৫ ও ১১৪ (১) এর বিধানের প্রয়োগ হতে শর্তসাপেক্ষে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। মূলত শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করানোর জন্যই এই প্রজ্ঞাপনগুলো জারি করা হয়। 

এই অব্যাহতির সুবিধা নিয়ে কোম্পানিটি শ্রমিকদের দৈনিক শ্রমঘণ্টা ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১০ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ছুটি দেড় দিনের পরিবর্তে ১ দিন নির্ধারণ করেছে। তামাক কোম্পানিকে এ ধরনের অব্যাহতি প্রদান এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ গাইডলাইনের ৭.১ এর সাথে সাংঘর্ষিক, যেখানে তামাক কোম্পানিকে সকল অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা প্রদান করা থেকে সরকারকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম পারিশ্রমিক প্রদান ও অতিরিক্ত সময় কাজ করানো উল্লেখযোগ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর আর্টিকেল ৫.৩ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তামাক কোম্পানিকে তামাকজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে আরোপিত অপ্রক্রিয়াজাত ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রদান থেকে অব্যাহতি ও প্রদান করেছে। 

তা ছাড়া, তামাক কোম্পানির সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ, কোম্পানিগুলোকে পুরস্কার এবং পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি তামাক কোম্পানিকে তাদের ব্যবসা প্রসারে প্রলুব্ধ করছে। তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থতায় দেশে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। আমারা জানি তামাক হচ্ছে একটি সর্বগ্রাসী পণ্য। তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সেবন সকল পর্যায়েই জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এজন্য উন্নত দেশগুলো তামাকের উপর উচ্চহারে করারোপ, সিগারেটের প্যাকেটে ছবি ও সতর্কবাণীসহ কঠোর আইন প্রণয়ন করায় সেখানে তামাক সেবনের হার কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষার স্বার্থেও উন্নত দেশগুলো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় তামাক চাষ কমে যাচ্ছে।

অপরদিকে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসন বেড়ে যাচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী সকল তামাকপণ্যের প্যাকেটের উপরে অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ জায়গা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোসহ অন্যান্য তামাক কোম্পানিগুলো প্যাকেটের নিচের ৫০ শতাংশে এ সতর্কবার্তা সংযোজন করছে। বিগত ২০১০ সাল থেকে তামাক চাষে ভর্তুকিকৃত সার ব্যবহার সরকার নিষিদ্ধ করলেও রংপুর, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, বান্দরবানসহ দেশের প্রায় সব জায়গায় তামাক চাষে এখনও ভর্তুকির সার ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া অপ্রক্রিয়াজাত তামাকের ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) মওকুফও অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে এই বিষয়টি পাস হয়েছে। অপ্রক্রিয়াজাত তামাকের রফতানি শুল্ক তুলে দেয়ার পাশপাপাশি প্রক্রিয়াজাত তামাকপণ্য রফতানি উৎসাহিত করতে শূন্য শতাংশ রফতানি শুল্ক অব্যাহত রাখা হয়েছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাক নিয়ন্ত্রণের যে কয়টি পদ্ধতির কথা বলেছেন, এর মধ্যে কর বৃদ্ধি অন্যতম। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থাকতে সরকারকে অবশ্যই আর্টিক্যাল ৫.৩ এর নির্দেশনা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর আর্টিকেল ৫.৩ এর সকল শর্ত পূরণের জন্য তামাক কোম্পানির সঙ্গে সরকারের সকল যোগাযোগের নথি প্রকাশ করা, তামাক কোম্পানির সঙ্গে যেকোনো আলোচনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আচরণবিধির প্রণয়ন করা, তামাক কোম্পানির কাছ থেকে যেকোনো অনুদান কিংবা উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ করা জরুরি। অবিলম্বে আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুযায়ী তামাক কোম্পানির সকল সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কার্যক্রম নিষিদ্ধ, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব এড়াতে সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দকে তামাক কোম্পানির পদ থেকে ইস্তফা, রপ্তানি শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতিসহ তামাক কোম্পানিকে প্রদত্ত সকল সুবিধা প্রত্যাহার, তামাক চাষে ভর্তুকিকৃত সার ব্যবহার নিষিদ্ধ ও তামাক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ বা আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়নের উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে সরকারকে নিতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১ এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) এ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর মদ ও ভেজষের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে। 

আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-র আর্টিকেল-৬ নং ধারায় তামাক ব্যবহার হ্রাসে কর বৃদ্ধির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবছর তামাক কোম্পানিগুলো ভ্রান্ত প্রচারণার মাধ্যমে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের বিভ্রান্ত করে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির বিরোধিতা করে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতি রক্ষায় বিড়ি-সিগারেটসহ সকল ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের উপর সুনির্দ্দিষ্টহারে কর বৃদ্ধি প্রয়োজন। এজন্য জনপ্রতিনিধিদের সংসদে বলিষ্ঠ ভূমিকা ও পালন করতে হবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনলে তবেই নিয়ন্ত্রণে আসবে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের প্রসারতা। এর ফলে দেশে ধূমপায়ী ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমবে। 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন