• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০১৯, ০২:৫৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২১, ২০১৯, ০২:৫৪ পিএম

সবুজ আন্দোলন ও প্রতিবেশগত সংকট

সবুজ আন্দোলন ও প্রতিবেশগত সংকট

আমাদের দেশে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিরূপণ করা হয়েছে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে। সেই আইনে প্রথম দেশের আটটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরো চারটি এলাকা সংযোজন করা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই জলাভূমি। এলাকাগুলো যথাক্রমে—সুন্দরবন, কক্সবাজার, টেকনাফ পেনিনসুলা, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়া হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড়, ঢাকা বেষ্টিত বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধিত ধারা ৫-এর বিভিন্ন উপধারায় বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে। ব্যাখ্যা দেওয়া আছে—কেন এই ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যার যত্সামান্য তথ্য নিম্নে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম আমরা।

প্রথমে সুন্দরবনের কথায় আসা যাক। এই বন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি আমাদের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। এ ধরনের শ্বাপদসংকুল বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। যেমন দুর্গম, তেমনি জীববৈচিত্র্যে ঠাসা এ বন। আমাদের এই জাতীয় বনটি বিভিন্ন কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন বিধায় এর চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে অবাধে মৎস্য আহরণ, গাছগাছালি কর্তন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে।

সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়া হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড় মিঠা পানির জলাশয়। এতদ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, জলজ উদ্ভিদ, পরিযায়ী পাখি স্থানীয় লোকদের অত্যাচারের কারণে অস্তিত্বসংকটে পড়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এই হাওর-বাঁওড়গুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

কক্সবাজার-টেকনাফের পেনিনসুলা বন্যপ্রাণীর প্রজননক্ষেত্র এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের নিরাপদ চারণভূমি বিধায় এ দুইটি অঞ্চলকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।

সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপের গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্যের আধিক্যের কারণে এ দুইটি দ্বীপ সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়ছে। এখানে দুর্লভ অলিভ রিডলি কাছিমের প্রজননস্থল। এছাড়াও সোনাদিয়া দ্বীপে বিপন্ন প্রজাতির পাখি চামচঠুটোঁ বাটানের আবাসস্থল। অপরদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে দুর্লভ জীববৈচিত্র্য ছাড়াও পরিবেশগত কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশেষ করে এ দ্বীপ পর্যটক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। যেমন: পলিথিন, পানীয় কৌটাসহ নানান আবর্জনা ফেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অপরদিকে পর্যটকদের রাত্রিযাপন কিংবা আয়েসের জন্য বেশ কিছু হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। এতে করে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে সেন্টমার্টিন ভাঙনের কবলে পড়ে, বিষয়টি গোচরীভূত হতেই সরকার রাত্রিযাপনে নিষেধাজ্ঞাসহ দ্বীপটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়।

অপরদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক অসনীয় মাত্রায় দূষণের কবলে পড়ে। কলকারখানা নির্গত অপরিশোধিত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, পলিথিন ও গৃহস্থালির আবর্জনায় জলাশয়ের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জলের রঙে পরিবর্তন এসেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও মাছ মারা যাচ্ছে; স্থান বদল করছে। এসব প্রতিবেশগত কারণে জলাশয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, ফলে সরকার সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এগুলোকে।

দেশে এ ধরনের আরো কিছু সংকটাপন্ন এলাকা রয়েছে। তার মধ্যে চলনবিল অন্যতম। আমরা আশাবাদী বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সেটিও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হবে একদিন। এখানে বলে নেওয়া আবশ্যক, সরকার বিভিন্ন সংকটাপন্ন এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়; আমাদের ঘাড়েও বর্তায়। কারণ এ পরিবেশটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। বেঁচে থাকতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। বলে নেওয়া ভালো, আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গে এই সার্কেলটি বিশেষভাবে যুক্ত। সুতরাং আমরা জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করি উদ্দাম গতিতে। আমরা জানি, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে একটি মাধ্যমের প্রয়োজন। আর সেই উত্কৃষ্ট মাধ্যমটি হচ্ছে ‘সবুজ আন্দোলন’। আসুন, আমরা সবুজ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সবুজ বাঁচিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করি। পাশাপাশি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরি। নিজের উদ্যোগে প্রচার-প্রচরণায় অংশ নিয়ে দেশটাকে সজীব করি। এ বিষয়ে কাজ করতে আমাদের যুব সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আসুন, ফেসবুকে সময় না কাটিয়ে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ তথা সবুজবিশ্ব গড়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে নিন।

লেখক : পরিবেশবিদ ও বন্যপ্রাণী বিশারদ