• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০১৯, ০৫:৫৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৩০, ২০১৯, ০৫:৫৪ পিএম

জীবন তবু শুধু হেমন্ত নিয়ে নয় 

জীবন তবু শুধু হেমন্ত নিয়ে নয় 

বহুকাল হলো অগ্রহায়ণের আগে হেমন্তের কথা মনে পড়ে না। কারণ অগ্রহায়ণের আগে ধূলিধূসর শহরগুলোতে হেমন্তের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। গোটা নগরই ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে ভার্টিক্যাল স্লাম। কার্তিক মাসেরও প্রথমার্ধ প্রায় শেষ। এই শহরের কোনো একটি লেকের ধারে কিংবা ডোবার পাশে একটি পানিকাওড় বা লাল চেগার দেখা মিলল না। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ষড়ঋতুর ক্যালেন্ডার থেকে মুছেই যাচ্ছে প্রায় হেমন্ত। সমস্যাটি একই সঙ্গে দৈশিক ও বৈশ্বিক। এই শতকেরই ত্রিশ-চল্লিশের দশকে লেখা জীবনানন্দ দাশের গল্প-উপন্যাসগুলোতে দেখি কার্তিকের শুরুতে হেমন্ত হাজির হচ্ছে তার সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

বাছুরের গায়ের রং বদলে গিয়ে ক্রমে সোনালি হয়ে মিশে যাচ্ছে খড়ের রঙের সঙ্গে। শজনেগাছের সবুজ পাতা হলুদ হয়ে উঠেছে। অশ্বত্থের খড়খড়ে ডালে বসে নিশ্চিন্তে কার্তিকের নরম রোদ পোহাচ্ছে দাঁড়কাক। ভাঙা দরদালানের কোটরের ফাঁকে মানুষের সঙ্গে খুরুল্লে প্যাঁচাও পাচ্ছে আগুনের স্নিগ্ধ আঁচ। শীতে টিকতে না পেরে সাঁকোরখোড়া ধানখেত থেকে উঠে টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছে ভোঁদড়, হুতুম। হেমন্তের এইসব ধ্রুপদি দৃশ্য এখন প্রায় অবিশ্বাস্য। ‘প্রেম অপ্রেমের কবিতায়’ জীবনানন্দ লিখছেন, তবুও হেমন্তকাল এসে পড়ে পৃথিবীতে। ঠিক তাই। ডিজেল পেট্রোলের ধোঁয়া, হাইড্রোলিক এবং সাইরেন হর্নের এই কাঠখোট্টা শহরেও হেমন্ত ঠিকই এসে পড়ে একদিন। যদিও এখন পর্যন্ত কেবল ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে আসা আর ভোরের হাওয়ায় শিরশিরানিটুকু ছাড়া তেমন করে নজরে পড়ছে না হেমন্ত। বিষণ্ন হতশ্রী এই শহরের যত্নহীন বিধ্বস্ত গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে বিশাল বিশাল দালানের মধ্যে হেমন্তের পায়ের আওয়াজ না-পাওয়ারই কথা। তবে নগরের সামান্য দূরে যে বিশাল বাংলা, গাছপালা, টিলা, খাল, খাত, নদীনালা, জলাভূমি, ঝিলের কিনার, হোগলা, শরবন সেখানে ঠিকই হেমন্ত এসে গেছে। টিলার ঘাসগুলো মরে খড়।

অনেক গাছ পাতা ঝরাচ্ছে, ডালপালা খসে গেছে কারো কারো। মাসখানেক আগেও যেসব বিল-ঝিল ছিল টলটলে জলে ভরা সেগুলোতে এখন ধীরে ধীরে জমছে কচুরিপানা। জলাভূমির জল শুকিয়ে জেগেছে লম্বা জলজ ঘাস। কোথাও সামান্য জল কোথাও সবুজ ঘাস। সেখানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে বক, হাঁস, ডাহুক। ভাবতে খারাপ লাগে এই সুন্দর দৃশ্যটির পাশেই হয়তো কোথাও ওত পেতে আছে কোনো এয়ারগান। তিরবিদ্ধ ক্রৌঞ্চের পাশে স্ত্রী ক্রৌঞ্চের বিলাপ দেখে রচিত হয়েছিল এই পৃথিবীর প্রথম কবিতা। মহামুনি বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে সঙ্গে নিয়ে তমসাতীর্থে স্নানে যাওয়ার পথে তিরবিদ্ধ স্ত্রী ক্রৌঞ্চকে দেখে সেই যে লিখেছিলেন, ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ, শাশ্বতীঃ সমাঃ। যত্ ক্রৌঞ্চমিথুনা...’—বেদনার সেই বিহ্বলতা আজও আছে। পাখিদের জন্য এখনো নিরাপদ নয় এই ভূখণ্ড।

জলাভূমিগুলোতে এখন দেখা মিলবে পদ্ম, শাপলা, পানিফল। আর ফসলি জমির পাশে জলাভূমিগুলোতে ইতিমধ্যেই এসে গেছে সুগভীর ছন্দের পরিযায়ী পাখি। ঝোপঝাড়ে উচ্ছিষ্ট পাতার জঙ্গলে, বিল-হাওরের তীরে, খোলা মাঠে রোদ পোহাচ্ছে তাদের বাহারি ডানা মেলে। পানকৌড়ি আর গয়ারের দল ব্যস্ত মাছ ধরায়। বনমোরগের ডানায় তেলচিক্কন রং। হেমন্ত শুধু পরিযায়ী পাখির ঋতু নয়। ধনেপাতা, টম্যাটো, শিম, মুলা, পালং অফুরান সবজির সমারোহও হয় এই ঋতুতে। গ্রামে গেলে দেখবেন উঠোনে উঠোনে কচু পাতায় সরিষার তেল মাখিয়ে খেসারি ডালের বড়ি দিয়ে রেখেছেন গৃহিণীরা।

ভাগ্য প্রসন্ন হলে শুনতে পাবেন ঘুঘুর ডাকও। প্রায় দুর্লভ হয়ে যাওয়া বাঁশঝাড় বা জিউল বাবলা, বেতকাঁটা বা শিরীষ বনে কার্তিকের নিঃস্তব্ধ দুপুরে ঘুঘু খুব বিষণ্ন স্বরে ডাকে। যেন খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলেছে সে। দক্ষিণে হেলানো রোদ যেন শীতে দিনভর উষ্ণতা দেয়, হেমন্তের মিষ্টি রোদ যেন সারা দিন ফ্ল্যাটের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রসন্নতার আমেজ দেয়। বর্ষায় থাকে বৃষ্টি দেখার বিশেষ ব্যবস্থা। পাখিদের নীড়ে এতশত কায়দা করে দেওয়ার কেউ নেই। তারা নিজেরাই হেমন্তের হাওয়া সরাসরি যেন তাদের নীড়ে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য শুকনো ঘাস আর লতাপাতা দিয়ে প্রবেশমুখ আটকে রেখেছে। ছিন্নপত্রে লেখা আছে, মনের ঋতু ছয়টা নয় বাহান্নটা।

এক প্যাকেট তাসের মতো। কখন কোনটা হাতে আসে তার ঠিক নেই। অন্তরে বসে কোন খামখেয়ালি খেলোয়াড় যে এই তাস ডিল করে, এই খামখেয়ালি খেলা করে তার পরিচয় জানি নে। মনের খামখেয়ালি খেলোয়াড়ের মোকাবিলা নয়, একুশ শতকের নাগরিকদের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ষড়্ঋতুর বাহান্ন ভোগান্তিকে মোকাবিলা করা। অফুরান আনন্দের ঋতু হেমন্তেও এই শহরের নাগরিকদের বাহান্ন রকম মন নয়, বাহান্ন রকম ভোগান্তি পোহাতে হয়। ধূমল রঙে আঁকা ঘোমটা টানা হিমের ধন দেখার ভাগ্য এই শহরের নাগরিকদের নেই। আছে কেবল আদ্যোপান্ত ধুলোর বিস্তার। তা দেখে অবচেতনে মন গেয়ে ওঠে, হায় হেমন্ত লক্ষ্মী তোমার নয়ন কেন ঢাকা!

 লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক