• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২০, ২০১৯, ০৭:৩৭ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (১৯)

বিশ্বাসঘাতকদের কথকতা

বিশ্বাসঘাতকদের কথকতা

বাঙালির ইতিহাস যেমন হার না মানা লড়াই-এর ইতিহাস, তেমনি ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তের এবং বিশ্বাসঘাতকতার পৌণ‍ঃপুনিক ইতিহাসও বটে। পৌরাণিক কাহিনী থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত বিশ্বাসহন্তারকদের অসংখ্য কাহিনী বিধৃত আছে ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির আম্রকাননে বিশ্বাস ঘাতকতার যে মর্মান্তিক প্রদর্শনী ঘটেছিল— তা কিন্তু একইভাবে সক্রিয় থেকেছে প্রতি মুহূর্তেই। ব্যক্তিগত স্বার্থবুদ্ধি দেশের স্বার্থকে ছাপিয়ে এনে তুলেছে তমসালিপ্ত কাল। ষড়যন্ত্রের এবং বিশ্বাস ঘাতকতার উৎস কেন্দ্র কুখ্যাত কাশিমবাজারের কুঠি এখনও ভিন্ন আঙ্গিকে নানারূপে ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। এই ধারাবাহিকের এই পর্বটিতে কতিপয় বিশ্বাস ঘাতকের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাস ঘাতকতার কুশীলব হিসেবে মোশতাক, চাষি, তাহের ঠাকুর, জিয়া, শাহ মোয়াজ্জেম ছাড়াও আরো ‍অনেকে ছিলেন। কিন্তু এমন আরো কেউ কেউ ছিলেন যাদের রহস্যময় ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবনার সুযোগ আছে। এখানে আমি তারই ক্ষুদ্রাংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।   

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাক-মার্কিন চক্র নতুন করে তাদের চক্রান্তের জাল বিস্তৃত করে। বঙ্গবন্ধু সরকারের পুরো সময়টাতেই তারা নানা কৌশলে তাদের ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়নে তৎপরতা চালায়। বঙ্গবন্ধু ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়নের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চক্রান্তকারীদের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল ‘ভারত কার্ড’। তারা প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভারতীয় জুজুর ভয় দেখাত। এ ব্যাপারে একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তৎপর ছিল তেমনি সক্রিয় ছিল চক্রান্তকারী সেনা অফিসাররাও। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ও অভ্যুত্থান এবং ৭ নভেম্বরের মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের এই প্রতারণা ও প্রহসন ক্রমান্বয়ে উন্মোচিত হয় এবং তাদের বিশ্বাসঘাতকতার নগ্ন রূপ ও স্বরূপ প্রকাশ পায়।

ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সকাল নয়টার মধ্যেই তিন বাহিনীর প্রধান খুনি মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কয়েকদিন পর জেনারেল এম এ জি ওসমানী মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন এবং তিনি অত্যন্ত নগ্নভাবে খুনি মোশতাককে রক্ষায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। অক্টোবরের মাঝামাঝি জেনারেল ওসমানী বঙ্গভবনে সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের একটা কনফারেন্স ডাকেন। এই কনফারেন্সে তিনি সবাইকে খন্দকার মোশতাক ও তার সরকারের প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশ দেন। যেকোনো অবাধ্যতা সমূলে উৎখাত করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এরপর জেনারেল ওসমানী পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রেজিমেন্টের সিনিয়র জেসিওদের সাথে কথা বলেন। তিনি তাদের বলেন, “যারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা ভারতীয়দের প্ররোচনাতেই তা করবে। তারা সব ভারতীয় এজেন্ট।” এসব কথা বলে জেনারেল ওসমানী ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং তথাকথিত অভ্যুত্থানকে যারা বিরোধিতা করেছিলো তাদেরকেই ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে একটি লেভেল সেঁটে দেন। পরবর্তীতে দীর্ঘকাল এবং এখনও পর্যন্ত এটা ‘ভারত জুজুর’ ভয় হিসেবে স্থায়ী কলঙ্ক চিহ্ন হয়ে আছে। 

জেনারেল এম এ জি ওসমানী

“যারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা ভারতীয়দের প্ররোচনাতেই তা করবে। তারা সব ভারতীয় এজেন্ট।”

পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর ভোর থেকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের বাগ্‌যুদ্ধ শুরু হলে জেনারেল ওসমানী খুনিদের পক্ষ নেন। এদিন দুপুরের পর অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ থেকে ৫ জন অফিসারের একটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়। খুনিরা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা সংঘাতের পথ বেছে নেয়। প্রথম তারা গরম গরম কথা বললেও সারা দিন মিগ আর হেলিকপ্টারের মহড়া দেখে ক্রমেই বিচলিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে খন্দকার মোশতাক কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা করার দায়িত্ব নেন। তিনি খুনিদের নিরাপদে দেশত্যাগের নিশ্চয়তা দাবি করেন এবং তারই মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্ত হয় ফারুক-রশিদ গংকে ব্যাংককে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন বিমানবাহিনীর প্রধান এম জি তাওয়াব।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের যখন বাগ্‌যুদ্ধ চলছিল, তখনো তারা জানতে পারেননি জেলে চার জাতীয় নেতা নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। অথচ আগের রাতেই সংঘটিত হয়েছিল এই বর্বর হত্যাকাণ্ড। জেনারেল ওসমানী ও চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ খলিলুর রহমান ওই ঘটনার কথা তখন জানতেন। তারা দুজনই ছিলেন খন্দকার মোশতাকের বিশ্বস্ত সহচর। তাই শুধু খুনি মোশতাকের নিরাপত্তার স্বার্থে তখন তারা কাউকে কিছু জানাননি।

জেনারেল ওসমানী, খলিলুর রহমান এবং জি এম তাওয়াবের সার্বিক সহযোগিতায় ৩ নভেম্বর রাত ১১টায় খুনিচক্র ব্যাংককের উদ্দেশে রওনা হয়। ঢাকা থেকে ওড়ার পর রিফুয়েলিংয়ের জন্য তারা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে একবার নামে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী চক্রের সেনা অফিসাররা প্রায় সবাই ব্যাংককে চলে যায়। তবে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে খুনিচক্রের অন্যতম সদস্য আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনকে দেশে রেখে যায়। এই মেজর মহিউদ্দিন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে একটি আর্টিলারি গান দিয়ে ৭-৮ রাউন্ড ফায়ার করেছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট ওই গোলায় মোহাম্মদপুর এলাকায় কয়েকজন বেসামরিক লোক হতাহত হয়। ৭ নভেম্বর এই মেজর মহিউদ্দিন তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়ে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে আর্টিলারিতে নিয়ে যায়।

এইচ এম এরশাদ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৯ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান আর উপপ্রধান করা হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। রাতারাতি এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তান-ফেরত এরশাদকে দুটি বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি দিয়ে উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এরশাদের চেয়ে তিনজন সিনিয়র অফিসার ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক, ব্রিগেডিয়ার সি আর দত্ত এবং ব্রিগেডিয়ার কিউ জি দস্তগীরকে ডিঙিয়ে খুনিরা এইচ এম এরশাদকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে নিয়োগ দেয়।

এরশাদ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছুটিতে রংপুরে ছিলেন এরশাদ। যুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানে ফিরে যান। সে সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন এরশাদ। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসারদের বিচারে গঠিত সামরিক আদালতে তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান ফেরত এরশাদ মেজর ডালিম ও গাজী গোলাম মোস্তফার বিরোধে ডালিমের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। আর খুনী রশিদের সঙ্গেও ছিল তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা।  

জেনারেল এরশাদ রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা দখল করে আমাদের এই মানচিত্রের ওপর তার কালো আচ্ছাদন বিছিয়ে বছরের পর বছর এ দেশের গণতন্ত্রকে উপহাস করেছেন। শুধু রাষ্ট্র আর গণতন্ত্রকেই অবজ্ঞা করেনি, আপাদমস্তক ভণ্ডামিতে তিনি দূষিত করেছেন চারপাশ। কবিতা লেখার ভড়ং করেছেন, নারীলিপ্সুতার চরম রূপ দেখিয়েছেন, ধর্মপ্রাণদের অনুভূতি নিয়ে দক্ষতায় খেলেছেন, আর প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার রক্তে রাজপথকে করেছেন রক্তাক্ত,— এসব আমরা সবাই জানি।

তবে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এরশাদের ঘনিষ্ঠতা ও তাদের প্রতি তার সহমর্মিতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এরশাদ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হওয়ার দুদিন পর বিনা অনুমতিতে দিল্লি থেকে ঢাকায় আসেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। জিয়াউর রহমান তাকে  জিজ্ঞাসা করেন তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে এসেছেন। জবাবে এরশাদ বলেন, তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত তার স্ত্রীর জন্য একজন গৃহভৃত্য নিতে এসেছেন! জিয়া তার ডেপুটি চিফ এরশাদকে পরবর্তী ফ্লাইটে দিল্লি যাওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তাকে বঙ্গভবনে যেতে নিষেধ করেন। পরদিন ভোরে এইচ এম এরশাদ দিল্লিতে ফিরে যান। তবে এর আগে সেনাপ্রধান জিয়ার আদেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অর্থাৎ এরশাদ মূলত খুনিদের সঙ্গে আলোচনা করতেই ঢাকায় এসেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রশিদের মাঝখানে এইচ এম এরশাদ

‘‘জেনারেল জিয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জেনারেল এরশাদের নির্দেশে গঠিত এবং তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সামরিক আদালত বিচারে মোট ২৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ২০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল, তিন-চারজনকে চাকরিচ্যুত এবং বাকীদের খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া একই অভিযোগে গঠিত অন্য একটি কোর্ট মার্শালে আরেকজন সেনা অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয়’’ 

এরশাদ প্রসঙ্গে আরো একটি ঘটনা বলা জরুরি। এটি জিয়ার শাসনামলের শেষ দিকের কথা। ওই সময় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত ১৫ আগস্টের খুনি অফিসাররা গোপনে মিলিত হয়ে জিয়াকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে। একপর্যায়ে এই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাদের সবাইকে ঢাকায় তলব করা হয়। সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে চক্রান্তকারী অফিসাররা যার যার দূতাবাস ত্যাগ করে লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। এদিকে দেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন সদস্য এই অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হন। আরো অনেকের সঙ্গে লে. কর্নেল দিদারের ১০ বছর এবং লে. কর্নেল নূরন্নবী খানের এক বছর মেয়াদের কারাদণ্ড হয়। প্রধান আসামিরা সরকার ও আইনকে উপেক্ষা করে বিদেশেই অবস্থান করে। পরবর্তীকালে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে যারা চাকরি চেয়েছিলেন, এরশাদ তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। এর মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্বাসিত হয় ১৫ আগস্টের খুনিরা। পোস্টিং নিয়ে খুনীদের অনেকে বিভিন্ন দূতাবাসে যোগ দেয়।

শুধু পুনর্বাসনই নয়, বঙ্গবন্ধুর খুনের সঙ্গে জড়িত অফিসাররা বিনা অনুমতিতে প্রায় তিন বছর অফিসে অনুপস্থিত থাকলেও এরশাদ তাদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। অন্যদিকে একই অপরাধে জড়িত তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে কারাবন্দি থাকে।

ঘটনাটি এখানেই থেমে থাকেনি এরশাদের পর বেগম খালেদা জিয়া ওই ফেরারি আসামিদের চাকরিতে শুধু বহালই করেননি, পদোন্নতিও দিয়েছিলেন।

জেনারেল জিয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জেনারেল এরশাদের নির্দেশে গঠিত এবং তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সামরিক আদালত বিচারে মোট ২৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ২০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল, তিন-চারজনকে চাকরিচ্যুত এবং বাকীদের খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া একই অভিযোগে গঠিত অন্য একটি কোর্ট মার্শালে আরেকজন সেনা অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয়। দণ্ডিত অফিসারদের মধ্যে কয়েকজন জুনিয়র অফিসার ছাড়া সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, যাদের অনেকেই ছিলেন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। 

জেনারেল এরশাদ কর্তৃক সামরিক আদালতে এই গোপন বিচারটি ছিল পুরোপুরি প্রহসন এবং সাজানো নাটক। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের নীল নকশার অংশ হিসেবে আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল কাদের বিচার হবে এবং কী শাস্তি হবে।

সে সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চার জন ব্রিগেড কমান্ডারের তিনজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা- ব্রিগেডিয়ার মহসীন, কর্নেল নওয়াজেশ ও কর্নেল রশিদ। এই তিনজনকেই কোর্ট মার্শাল করে ফাঁসি দেওয়া হয়। অন্য ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার লতিফ ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত। তাকে কোর্ট মার্শালে অভিযুক্তই করা হয়নি।

১৯৮১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যে ১২ জন অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয় তারা হলেন, ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, কর্নেল নওয়াজেস উদ্দিন, কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ বীরপ্রতীক, লে. কর্নেল এটিএম মাহফুজুর রহমান বীরবিক্রম, লে. কর্নেল মোঃ দেলোয়ার হোসেন বীরবিক্রম, মেজর এ জেড গিয়াসউদ্দিন আহমদ, মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া বীরপ্রতীক, মেজর কাজী মমিনুল হক, মেজর মোঃ মুজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন জামিল হক এবং লেফটেন্যান্ট রফিকুল হাসান খান। ৩০ সেপ্টেম্বর বিচারের জন্য শারীরিক সক্ষমতা না থাকার পরও অন্য এক কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয় লে. কর্নেল শাহ মোঃ ফজলে হোসেনকে।

৭ সদস্যের ওই কোর্টের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুর রহমান ছিলেন পাকিস্তান ফেরত একজন সেনা কর্মকর্তা। এছাড়া বাকী সদস্যদের মধ্যে এক মাত্র কর্নেল মতিউর রহমান (বীরপ্রতীক) ছাড়া আর কেউ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, সবাই ছিলেন পাকিস্তান ফেরত। এই কর্নেল মতিউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও তার নানা কর্মকাণ্ড ছিল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বিরুদ্ধে।

মীর শওকত

পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর যশোরের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী ঢাকায় আসার অনুমতির জন্য অনবরত খালেদ মোশাররফকে ফোন করতে থাকেন। মীর শওকতের স্ত্রীও খালেদ মোশাররফের স্ত্রীকে অনুরোধ করেন খালেদ মোশাররফকে এ ব্যাপারে রাজি করানোর জন্য। মীর শওকতের উপর্যুপরি টেলিফোনে বিরক্ত হয়ে খালেদ মোশাররফ তাকে ঢাকায় আসার অনুমতি দেন। মীর শওকত ৬ নভেম্বর বিমানযোগে ঢাকায় আসেন। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তার দু-তিন ঘণ্টা বৈঠক হয়। পরদিন (৭ নভেম্বর) পাল্টা অভ্যুত্থানের পর ৩ নভেম্বরের ঘটনায় জড়িত আটক অফিসারদের পরিদর্শনের জন্য গণভবনে যান। ওই অফিসারদের সেখানে বিচারের অপেক্ষায় কড়া পাহারায় রাখা হয়েছিল। ওই অফিসারদের লক্ষ্য করে তাদের সামনেই মীর শওকত গার্ড কমান্ডারের কাছে মন্তব্য করেন, ‘Why try them? Line them up and shoot them like dogs.’ আটক সব অফিসার মীর শওকতের এই চরম প্রতিহিংসামূলক মন্তব্যে হতবাক হয়ে যান।

মীর শওকত

‘Why try them? Line them up and shoot them like dogs.’

রাজসাক্ষী!

পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর সকালবেলা বঙ্গভবনের উপর দিয়ে যখন হেলিকপ্টার ও মিগ ফাইটার মহড়া দিতে শুরু করে তখন দ্বিতীয় বেঙ্গলের সিও কর্নেল আজিজুর রহমান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন! তার বদলে তার অধীন ক্যাপ্টেন নজরুল দুই কোম্পানি সৈন্য দিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। তবে সিও সাহেব ভোরবেলা আকাশে মিগ আর হেলিকপ্টার দেখে অভ্যুত্থান সফলের ব্যাপারে আশ্বস্ত হন। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে অতি উৎসাহ দেখাতে থাকেন। ৩ নভেম্বরের আগে এই কমান্ডিং অফিসার বেশ কয়েকবার শাফায়াত জামিলের সঙ্গে দেখা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন। তার অধীন কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন নজরুলকেও তিনি এর সঙ্গে যুক্ত করেন। অথচ ৭ নভেম্বরের বিপর্যয়ের পর এই কর্নেল আজিজুর রহমান অবলীলায় রাজসাক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তৎকালীন সামরিক কর্তৃপক্ষ এই অফিসারকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ায়। তাকে দিয়ে বলানো হয়, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে ভারতের যোগসাজশ ছিল।

বিচারপতি সায়েম

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় অভ্যুত্থানকারীরা বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সন্ধ্যাতেই খালেদ মোশাররফ, এম জে তাওয়াব এম এইচ খান, শায়াফাত জামিলসহ কয়েকজন সায়েমের বাসভবনে যান। বিচারপতি সায়েম ধৈর্যসহকারে খালেদের বক্তব্য শোনেন।

বিচারপতি সায়েম

‘‘বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিচারপতিদের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের অনেকেই যে মেরুদণ্ডহীনতার নজির স্থাপন করেছেন, বিচারপতি সায়েম ত‍ারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’’

এর আগে অবশ্য তাকে একবার বঙ্গভবনে ডেকে এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের কথাটি জানানো হয়েছিল। ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিচারপতি সায়েম খালেদ মোশাররফের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেয়ে শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু উপস্থিত সবাই পীড়াপীড়ি করায় তিনি বলেন, পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিচারপতি সায়েম তখনই উঠে গিয়ে ঘরের ভেতরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে যান এবং তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে আসেন, যেন এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কার সঙ্গে কী আলাপ করলেন তা তিনিই জানেন! বিচারপতি সায়েম এসেই বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। বিচারপতি সায়েম ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের বরখাস্ত করার সময় বিচারপতি সায়েম নিজে পদত্যাগ করার বিষয়টি বিবেচনায় নেননি। বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিচারপতিদের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের অনেকেই যে মেরুদণ্ডহীনতার নজির স্থাপন করেছেন, বিচারপতি সায়েম ত‍ারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আবেদ খান ● সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

বি.দ্র : পরবর্তী পর্ব প্রকাশ হবে আগামী ২৭ নভেম্বর, বুধবার। ] 

আরও পড়ুন