• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০১৯, ০৫:৪৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২৫, ২০১৯, ০৫:৪৮ পিএম

ঢাকার আকাশ ধোঁয়াশা

ঢাকার আকাশ ধোঁয়াশা

ঢাকার বাতাসে দূষণ। দিন দিন বাড়ছেই। দূষণ কমানোর কোন উদ্যোগ নেই। ঢাকার শহরের ভেতরের  জলাধারগুলো ভরাট হচ্ছেই। বুড়িগঙ্গার জলের দুর্গন্ধ পাওয়া যায় বহুদূর থেকে । বুড়িগঙ্গার এ মৃত্যু উৎসব কারো চোখে পড়ে না? বুড়ি গঙ্গার জল গায়ে লাগলে  ‍চুলকায়,ওর পাড়ে যারা থাকে তাদের চর্মরোগ ,হাঁপানিসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দেয় । দখল দূষনে ঢাকা্ শহরের চারপাশের নদীগুলো,খালগুলো নিশ্চিহ্ন।  অতচ এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখলে বা সচল করলে ঢাকা শহর ভেনিসের চেয়ে সুন্দর নগরী হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি,
হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তাহলে পরিবেশের অবস্থা কি হবে?

অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, তীব্র যানজট, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ভারী ধাতু ধুলার সঙ্গে যোগ হচ্ছে। ঘরের বাইরে তো বটেই, বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ ও খেলার মাঠেও ভর করছে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে নগরবাসী, বিশেষ করে শিশুরা। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যার শিকার হয় এই বায়ুদূষণে। ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে,যার মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী ৬ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে।

শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বাধা, স্নায়বিক ক্ষতি এবং গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। ঢাকার অবস্থা পর্যালোচনা করে বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, পারিপার্শ্বিক বায়ুদূষণের কারণে বছরে মারা যায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষ এবং আবাসিক দূষণের কারণে বছরে সাড়ে চার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ঢাকার বাতাসে সিসাজনিত দূষণ জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কমপক্ষে হাজার গুণ বেশি। রাজধানী শহর আজ যেন একটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে।( সমকাল১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) 

দুই.
মনে পড়ে ছোটবেলায় যখন বাগানে দৌড়াতাম তখন ফুলের গাছের ফাঁকে ফাঁকে মৌমাছি এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়াউড়ি করত। এ মসময় যে ফুলের বাগানে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি দেখতাম তা নয়। কাঠবিড়ালী,মৌমাছি ,চামচিকা, বাদু, বহুরঙের ফড়িং, কীটপতঙ্গ দেখতাম । ফুলের গন্ধে সাপ আসে আমাদের বলে দিতো গুরুজনেরা।

 আমরা ফুলের বাগানে গেলে সন্তর্পনে পা ফেলতাম। আজ আর সেসব ফুল বাগান নেই। ভবন আর কারখানার জঞ্জালে ভরা ঢাকা। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ছে নগরীর পরিসর। গ্রাম থেকে ঢাকা মুখী মানুষ। সব মিলিয়ে ঢাকার প্রানবৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে। আর আজকের এই দিনে বায়ুদূষণ যতই বাড়ছে মৌমাছির খাদ্য খোঁজার ক্ষমতা ততই কমছে শুধু না এখন এসব আর চোখে পড়ে না ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। আর বর্তমানে বাংলাদেশের সব নদ-নদী, ক্ষুদ্র জলস্রোত, খাঁড়ি, খাল ইত্যাদির সম্মিলিত দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার কিলোমিটার। এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই ধারণা করা যায় যে বাংলাদেশ থেকে বহু নদী হারিয়ে গেছে। আর হারিয়ে যাওয়া সেসব নদীর সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক জলজ জীব। একাধিক গবেষনায় দেখা গেছে যে কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে কিছু মাছ বিরল হতে হতে দেশ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

আইইউসিএন বাংলাদেশের প্রায় ৫৪টি মাছকে অতি ও মহাবিপন্ন, বিপন্ন, সংকটাপন্ন ইত্যাদি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।  বালিতোরা, নান্দিনা, তিলা খোকসা, নিপাতি, দারকিনা, মাইটাভাঙা, ভোল, কাজুলি, নলুয়া চান্দা, পিপলা শোলসহ আরো অনেক নাম উল্লেখ করা যায়। মিঠা পানির কুমির বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশের নদীতে ঘড়িয়াল, বড় কাইট্টা, ধুর কাছিম, কড়ি কাইট্টা অতি বিপন্ন প্রাণী। এ ছাড়া নোনা পানির কুমির ও ১৩টি কাছিম/কাইট্টা বিপন্ন কিংবা সংকটাপন্ন সরীসৃপ বলে জানা গেছে। জলচর স্তন্যপায়ীদের মধ্যে
ভোঁদড়/উদবিড়ালের তিনটি প্রজাতি অতি বিপন্ন এবং তিন প্রজাতির শুশুক (ইরাবতিসহ) বিপন্ন/সংকটাপন্ন বলে বলা হচ্ছে। ( বিপন্ন
নদী—সংকটাপন্ন প্রাণবৈচিত্র্য/বিধান চন্দ্র দাস।১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ )

 বায়ু দূষণের ফলে - ফুলে গন্ধ কমে যাচ্ছে এবং পরিবর্তিত হচ্ছে। একদল গবেষকদের মতে, প্রত্যেক মৌমাছি যে এলাকায় অল্প গন্ধফুল রয়েছে সেই এলাকা থেকে বেশি  গন্ধ ফুলের দিকে উড়ে যেতে পছন্দ করে । তা নয় মৌমাছি উড়ে গেল কিন্তু এই  বিশাল ঢাকা শহরে মানুষ যাবে কোথায়? এ ব্যাপারে নগরপিতাদের কোন পরিকল্পনা আছে কি?

তিন.
১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে এক বিরাট বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল লন্ডন। ভয়ংকর বায়ু দূষণের শিকার হয়ে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। 'দ্য গ্রেট স্মগ' বা ভয়ংকর ধোঁয়াশা নামে পরিচিতি পাওয়া সেই ঘটনা এখনো ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। লন্ডনের আকাশে এমন অন্ধকার আর কখনো দেখা যায়নি। কেউ যেন ঘন কালো চাদরে ঢেকে দিয়েছিল পুরো নগরী। ১৯৫২ সালের সেই ডিসেম্বরে লন্ডন পরিণত হয়েছিল এক মৃত্যুকূপে।

ব্রিটেনে তখন জ্বালানির প্রধান উৎস কয়লা। আর এই কয়লা পোড়ানো ধোঁয়ার সঙ্গে মিশলো শীতের ঘন কুয়াশা। দূষিত বায়ুতে ঢাকা পড়ে গেল পুরো নগরী। স্মরণকালের ইতিহাসে এরকম ভয়ংকর স্মগ বা ধোঁয়াশা মানুষ আর দেখেনি।

এটা ছিল অনেক ধরণের দূষিত জিনিসের একটা সংমিশ্রন। এসব দূষিত কণা আবার মিশেছিল কুয়াশার সঙ্গে। এটার গন্ধ আপনার নাকে লাগবে, জিভে আপনি এটার স্বাদ পাবেন। একটু অম্ল স্বাদের। এই ধোঁয়াশা যেখানেই লাগছে, আপনার গায়ে, পোশাকে- সব নোংরা হয়ে যাচ্ছে। এটা ভয়ংকর এক বিপর্যয় সৃষ্টি করলো। যে মাত্রার দূষণ তৈরি হলো, তা অবিশ্বাস্য, ভয়ংকর।

গত ৭ নভেম্বর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে কর্তৃপক্ষ বায়ু দূষণের ভয়াবহ মাত্রা বৃদ্ধির কারণে সব স্কুল গোটা সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো।শহরের বাতাসে দূষণের মাত্রা এ পরিস্থিতিতে দাঁড়ায় যে,  পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটায় শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ঘন ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়েছিলো দিল্লির রাস্তাঘাট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বায়ু দূষণের যে মাত্রাকে গ্রহণযোগ্য নিরাপদ সীমা বলে মনে করে, দিল্লির অনেক এলাকায় বায়ু দূষণ তার চেয়ে তিরিশ গুণ বেশি।

দিল্লির বাসিন্দারা বলছিলেন ধোঁয়াশা এতটাই ঘন যে তিনি তার আটতলা ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে নিচে রাস্তায় গাড়ি বা যানবাহন কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না এবং গাড়িগুলো দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলছে।  শীতের শুরুতে দিল্লিতে বায়ুদূষণ হয় প্রতিবছর। গাড়ির নিগর্মন তো রয়েছেই, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেওয়ালিতে বাজি পোড়ানো বন্ধ থাকেনি,
পাশাপাশি এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে দিল্লির আশেপাশের রাজ্য, যেমন পাঞ্জাব বা হরিয়ানায় চাষের ক্ষেতে ফসলের গোড়া পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে সৃষ্ট বায়ু দূষণ।

 চার.
 আমাদের দেশে অনেকগুলো উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ চলছে। যেমন মেট্রোরেল , রেপিড ট্রানজিটের পাশাপাশি ওয়াসা ,বিদ্যু বিভাগ  এবং অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের জন্য ঢাকার রাস্তায় চার থেকে পাঁচ কিলোমিটারেরই মধ্যে কোথাও না কোথাও কোন কর্মযজ্ঞ হচ্ছে ,রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে । যার ফলে গ্রাউন্ড থেকে প্রচুর ধুলা আকাশকে ধোঁয়াশা আর ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।দ্বিতীয়ত: ঢাকাকে যদি উপর থেকে এখন কেউ দেখে থাকেন ,তাহলে দেখবেন পুরো ঢাকাকে ঘিরে রেখেছে  কালো ধোঁয়ায় ।

তৃতীয়ত: অপরিকল্পিতভাবে বজ্র পোড়ানোসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য এবং পলিথিন থেকে ব্যাপক বায়ুদূষণ ঘটছে । চতুর্থত: বহু সময় ধরে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের জন্য যানবহন অবস্থান করা এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।তবে আমাদের করণীয় যে নেই তা কিন্তু নয় এখানে মূলত সিটি কর্পোরেশনের সবথেকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে | ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এবং ওয়াসার একযোগে কাজ করতে হবে। 

ওয়াসার যেসকল গাড়ি পানি ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত হয়, এই সব গাড়ি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে যেন একটি গাড়ি দ্বারা এক থেকে দেড় কিলোমিটার আপডাউন করে পানি ছিটায় দৈনিক অন্তত ১৬ ঘন্টা ।সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে সমন্বয় ঘটাতে হবে ,কিভাবে অপরিকল্পিতভাবে বজ্র এবং ময়লার স্তুপ পড়ানো বন্ধ করা যায় এবং স্থায়ীভাবে ইটের ভাটা গুলো ঢাকার আশপাশ থেকে অপসারণে একযোগে কাজ করতে হবে।আর যারা বায়ু দূষণের এই সকল কার্যক্রম গুলোকে ঘটিয়ে থাকে ,সেই সকল দূষণকারীদের কে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে ।

আমাদের ঢাকা শহরের চারপাশে ঘেরা নদীগুলো দখল- দুষনে মৃত প্রায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী, বুড়ি গঙ্গাকে খনন ও মৃতপ্রায় খালগুলোকে উদ্দার করলে দুষনের পরিমান কমে যাবে। জলের প্রবাহে ফিরে আসবে প্রাণবৈচিত্র্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে বায়ু দূষণেশুধুমাত্র ফুসফুস জনিত রোগ বিস্তার লাভ করে এমনকি নয় এছাড়াও স্ট্রোক ,হার্ট অ্যাটাক এবং পরবর্তী প্রজন্মের নানা অজানা রোগে ভুগতে পারে । শীত এসেছে। এসময শুরু হবে মেট্রোরেলের কাজ থেকে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী কাজ। তখন ঢাকায় চলাচলের পরিবেশ থাকবে কিনা - এ নিয়ে শংকিত পরিবেশবিদরা। এই পরিস্থিতি থেকে জনগনকে মুক্ত করতে পরিত্রাণের জন্য সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলন ,প্রচারণা এবং কার্যক্রম গুলোকে গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে ।তাহলে বায়ু দূষণরোধ খুব কঠিন হবে না। সারা বিশ্ব জানে আমরা পারি । আমাদের না পারলে হবে?

লেখক : সংগঠক ও প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের গৌরব