• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০১৯, ০৬:০১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২৭, ২০১৯, ০৬:০৩ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি-২০

উন্নয়নের রোলমডেল বাকশাল এবং তাকে বিতর্কিত করার চক্রান্ত

উন্নয়নের রোলমডেল বাকশাল এবং তাকে বিতর্কিত করার চক্রান্ত

৭ই মার্চ। ১৯৭৫ সাল। সদ্য গঠিত বাকশালের প্লাটফর্মের বিশাল সভা। সেখানে উপস্থিত দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ‍অংশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। জনগণের সঠিক কল্যাণের রাজনীতির স্বার্থে অসাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে এই মহাসমাবেশের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সেই সমাবেশে উপস্থিত নেই। পুরো সাংগঠনিক কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সুচারুভাবে পালন করে চলেছেন।

ঠিক সে সময় সেখানে উপস্থিত হলেন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি সঙ্গে এনেছেন তার স্ত্রীকে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার নাম না থাকায় তিনি বিচলিত। অনেক অনুনয়-বিনয়, কাকুতি-মিনতির পরে বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। স্বল্পভাষী জিয়াউর রহমানকে সেদিন মনে হয়েছিল কিঞ্চিৎ প্রগলভ। রাষ্ট্রের মঙ্গলের স্বার্থে এই পদক্ষেপ যে কতখানি প্রয়োজনীয়, তা তিনি বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যক্ত করেছিলেন। সেখানে নানাভাবে এই বক্তব্য বারবার উঠে আসছিল যে এই নতুন পদক্ষেপ একটি সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র। এটি ছিল একটি ‘ত্রিদলীয়’ জোট। আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য অক্ষ‍ুণ্ন রেখেই এই জোট গঠিত হয়। স্বাধীনতার পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) পক্ষ থেকেও এ ধরনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। জাসদ বলেছিল ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠনের কথা। অথচ বঙ্গবন্ধু যখন বাকশালের মাধ্যমে অনুরূপ সরকারব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেন, তখন এর বিরুদ্ধে এই জাসদ সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল।

বাকশালের বিধিবিধানে বিভিন্ন সরকারি চাকুরে ও সেনাবাহিনীর সদস্যসহ অপরাপর সব দল ও সংগঠনকে জাতীয় দলে যোগ দিয়ে অপশক্তির মোকাবেলা করা এবং দেশ পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা বলা হয়। বাকশালের বিভিন্ন দিক, কার্যক্ষেত্র এবং সম্ভাবনা সবিস্তারে বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই উদ্যোগকে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

পঁচাত্তরে আমাদের দেশে ১৯টি জেলা ছিল। এই ১৯ জেলাকে ভাগ করে বঙ্গবন্ধু ৬০টি জেলায় রূপান্তর করেছিলেন। তার মানে প্রতিটি মহকুমাকে পর্যায়ক্রমে জেলায় রূপান্তর করেছিলেন। এই মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর করা হয়েছিল যেন সেগুলো অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে ওঠে এবং তৃণমূলের মানুষ সেটার সুফল পায়। সেই পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন 

..............‘’..............

অথচ স্বাধীনতাবিরোধী পাক-মার্কিন চক্র তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দীর্ঘ প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বাকশালকে একটি অগণতান্ত্রিক ও একদলীয় ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করে। শুরুতেই বলা হয়, ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এই ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এর জবাবে বলেছেন, ‘কারো প্রেশার বা প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পণ বা মাথা নত করার অভ্যাস বা মানসিকতা আমার নেই। এ কথা যারা বলেন, তারাও তা ভালো করেই জানেন। তবে অপপ্রচার করে বেড়াবার বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই, তাই ওনারা এ কাজে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। করুণ অপপ্রচার। আমি স্বজ্ঞানে বিচার-বিশ্লেষণ করে, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, আমার দীনদুখী মেহনতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে আমি বাকশাল কর্মসূচি দিয়েছি। আমি যা বলি, তাই করে ছাড়ি। যেখানে একবার হাত দেই সেখান থেকে হাত উঠাই না। বলেছিলাম এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব, মুক্ত করেছি। বলেছি শোষণহীন দুর্নীতিমুক্ত বাংলা গড়ব, তাই করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। কোনো কিন্তুটিন্তু নাই, কোনো আপস নাই।’

বাকশাল পদ্ধতির কিছু বাধ্যবাধকতা ও নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থার মধ্যে একটি ছিল সংবাদপত্র অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে জারিকৃত এই অধ্যাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় মাত্র চারটি সংবাদপত্র প্রকাশনার ব্যবস্থা রেখে অন্য সব পত্রপত্রিকা প্রকাশের অনুমতি বাতিল করা হয়। তবে বাতিল করা পত্রিকাসমূহের সকল সাংবাদিককে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেয়া হয়। অথচ বাকশালের সুবিধাভোগীরাই বাকশালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচার চালিয়েছে।

সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বাকশালের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলের জন্য ১৫ সদস্যের একটি নির্বাহী কমিটি এবং ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি মনোনীত করেন। এছাড়া জাতীয় কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ নামে দলের পাঁচটি অঙ্গসংগঠনকে মনোনয়ন দেন। নির্বাহী কমিটির সদস্যরা মন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগের অধিকারী ছিলেন।

দেশের প্রশাসনব্যবস্থাকে গণমুখী করার লক্ষ্যে ঢেলে সাজানোই ছিল বাকশাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। বাকশালের একটি বড় লক্ষ্য ছিল দেশের প্রভাবশালী আমলাতন্ত্রের সংস্কার সাধন। নতুন ব্যবস্থায় পুনর্গঠিত আমলাতন্ত্রকে দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছিল। এর একটি ছিল জাতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং অপরটি জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল। এই ব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রতিটি মহকুমাকে একজন নির্বাচিত গভর্নরের অধীনে জেলায় রূপান্তরের বিধান রাখা হয়। জেলার সংসদ সদস্যগণ, বাকশালের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট জেলার বেসামরিক, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হবে জেলা প্রশাসনিক কাউন্সিল। গভর্নর হবেন জেলার প্রধান নির্বাহী এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হবেন গভর্নরের সচিব। উদ্দেশ্য ছিল, জেলা গভর্নর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শোষণমূলক ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রশাসনকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং স্বাধীনতাকে তাদের কাছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অর্থবহ করে তোলা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে বাকশালের পরিকল্পনায় ব্যাপকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

পঁচাত্তরে আমাদের দেশে ১৯টি জেলা ছিল। এই ১৯ জেলাকে ভাগ করে বঙ্গবন্ধু ৬০টি জেলায় রূপান্তর করেছিলেন। তার মানে প্রতিটি মহকুমাকে পর্যায়ক্রমে জেলায় রূপান্তর করেছিলেন। এই মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর করা হয়েছিল যেন সেগুলো অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে ওঠে এবং তৃণমূলের মানুষ সেটার সুফল পায়। সেই পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করে একদম তৃণমূল পর্যন্ত যেন পৌঁছে যায়, সে ব্যবস্থা করেছিলেন। একজন সাধারণ মানুষের যেন কাজ করার সুযোগ থাকে। যারা জমিতে শ্রম দেবে তারা উৎপাদিত পণ্যের একটি অংশ পাবে, যারা জমির মালিক তারা একটা অংশ পাবে এবং কো-অপারেটিভের মাধ্যমে সরকারের কাছে একটা অংশ আসবে; যেন কখনো কেউ বঞ্চিত না হয়। অন্তত যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমিতে ফসল ফলায় তারা যেন ন্যায্য মূল্য পায়, তারা যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারে। আমাদের কৃষিপদ্ধতিকে যান্ত্রিকীকরণ করে আধুনিকীকরণ করার কথাই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। সাথে সাথে শিক্ষাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর এক মাস পর ২৪ ফেব্রুয়ারি এক আদেশবলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) তথা জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একই সঙ্গে নিজেকে এই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন

..............‘’..............

বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের প্রশাসন যেভাবে চলছে, তা দিয়ে শত সমস্যার জগদ্দল পাথরকে বাংলাদেশের বুক থেকে সরানো সম্ভব হবে না। বাকশালের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় তাঁর বক্তৃতা ও বিবৃতিতে বিশ্লেষণ করেছেন। এ বিষয়ে সময়ের বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগৃহীত বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি মন্তব্য তুলে ধরছি :

“এককথায় বাকশাল বলতে আমি যা বুঝি তা হলো একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও শোষিতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠাকরণ। বাকশালের কর্মসূচিকে আমি প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। এক. রাজনৈতিক, দুই. আর্থসামাজিক এবং তিন. প্রশাসনিক ও বিচারব্যবস্থা।”

“রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক পেশাভিত্তিক লোকদের জাতীয় দল বাকশালে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা রেখেছি এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচনি এলাকায় জাতীয় দলের একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হবে। জনগণ তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করবেন। প্রেসিডেন্ট জনগণের নির্বাচনে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় দলের যে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট পদাধিকারবলে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় দলের যে কোনো একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করবেন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন। সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের অনাস্থায় প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা যাবে। মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন। স্থানীয় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বস্তরের জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যক্ষভাবে বজায় থাকবে।”

“আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম-সমবায় প্রকল্প। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থব্যবস্থায় উন্নয়ন বা স্বনির্ভর-স্বাধীন গ্রামীণ ব্যবস্থা, বিশেষ করে ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের পুনর্বাসন তথা কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সাম্যভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। ভারী শিল্পকারখানা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, যোগাযোগব্যবস্থা ইত্যাদি জাতীয়করণ করে জনগণের যৌথ শেয়ার মূলধনে নতুন নতুন কৃষিজাত শিল্প ও অন্যান্য শিল্প-কলকারখানা ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা। সীমিত ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহদানেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাসমূহ যাতে জনসাধারণ ও তাদের শ্রমিকদের শোষণ করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকবে।”

“প্রশাসনিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, করপোরেশন ও বিভাগগুলোর পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন তথা মাথাভারী প্রশাসনের উচ্ছেদ সাধন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জেলা গভর্নর ও থানা প্রশাসনিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ, মহকুমা ও বিভাগীয় পরিষদকে তুলে দেয়া হচ্ছে। জেলা ও থানাগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে থানা পরিষদ গঠন করা হবে। তবে থানা পরিষদের প্রশাসক/ চেয়ারম্যান ও জেলা গভর্নর জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। থানা প্রশাসক/ চেয়ারম্যানরা ও জেলা গভর্নররা জনগণ, স্ব স্ব পরিষদ ও প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। গ্রাম সমবায় পরিষদ, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদের পরেই থাকবে জাতীয় সরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে জাতীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিপুলভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করে প্রশাসনকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র, স্টিলফ্রেম গতানুগতিক বা টাইপড চরিত্রকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। সরকারি কর্মচারীরা এখন জনগণের সেবক।”

“বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে রাজধানীতে বহাল রেখে হাইকোর্ট বিভাগকে আটটি আঞ্চলিক বিভাগে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে সুপ্রিম কোর্টের অধিবেশন বছরে অন্তত একবার করে প্রতিটি আঞ্চলিক বিভাগে (হাইকোর্ট) বসবে। জেলা আদালতসমূহ বহাল থাকবে। প্রতিটি থানাতে থাকবে একাধিক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। প্রত্যেকটি আদালতে যে কোনো মামলা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মীমাংসা করতে হবে। গ্রামে থাকবে একাধিক শালিস বোর্ড। শালিস বোর্ড গঠিত হবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। শালিস বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকবেন সরকার নিয়োজিত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে সুষ্ঠু, ন্যায় ও দ্রুততর গণমুখী বিচারকার্য সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।”

পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর এক মাস পর ২৪ ফেব্রুয়ারি এক আদেশবলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) তথা জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একই সঙ্গে নিজেকে এই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন।

ওই বছরের ৭ জুন বাকশালের গঠনতন্ত্র, কার্যনিবাহী ও কেন্দ্রীয় কমিটি ও পাঁচটি ফ্রন্ট এবং এর কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হিসেবে সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল পদে প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর নাম ঘোষণা করেন। জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রাজ্জাককে দলের সেক্রেটারি করা হয়।

আর ফ্রন্ট পাঁচটি হলো : জাতীয় কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ। এর সেক্রেটারিরা হলেন যথাক্রমে ফণী মজুমদার, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, বেগম সাজেদা চৌধুরী, তোফায়েল আহমদ ও শেখ শহীদুল ইসলাম। ১৫ জনকে নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটি এবং ১১৫ জন সদস্য রাখা হয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে।

কার্যনির্বাহী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা হলেন —
(১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান - চেয়ারম্যান (২) জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম (৩) জনাব এম মনসুর আলী (৪) জনাব খন্দকার মোশতাক আহমদ (৫) জনাব আবুল হাসানাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (৬) জনাব আব্দুল মালেক উকিল (৭) অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী (৮) শ্রী মনোরঞ্জন ধর (৯) ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (১০) জনাব শেখ আবদুল আজিজ (১১) জনাব মহীউদ্দিন আহমদ (১২) জনাব গাজী গোলাম মোস্তফা (১৩) জনাব জিল্লুর রহমান - সেক্রেটারি (১৪) জনাব শেখ ফজলুল হক মনি - সেক্রেটারি (১৫) জনাব আব্দুর রাজ্জাক - সেক্রেটারি।

আর কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন : (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি - চেয়ারম্যান (২) জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, উপরাষ্ট্রপতি (৩) জনাব এম মনসুর আলী, প্রধানমন্ত্রী - সেক্রেটারি জেনারেল (৪) জনাব আবদুল মালেক উকিল, স্পিকার (৫) জনাব খন্দকার মোশতাক আহমদ, বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য মন্ত্রী (৬) জনাব আবুল হাসানাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, শিল্পমন্ত্রী (৭) জনাব মুহম্মদ উল্লাহ, ভূমি রাজস্ব ও ভূমি সংস্কারমন্ত্রী (৮) জনাব আবদুস সামাদ আজাদ, কৃষিমন্ত্রী (৯) অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, শ্রম, সমাজকল্যাণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী (১০) শ্রী ফণী মজুমদার, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী (১১) ড. কামাল হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১২) জনাব মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী (১৩) জনাব আব্দুল মান্নান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী, (১৪) জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ বিদ্যুৎ ও বন, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রী (১৫) শ্রী মনোরঞ্জন ধর, আইন, সংসদ বিষয়াবলী ও বিচারমন্ত্রী (১৬) জনাব আব্দুল মমিন, খাদ্য, বেসামরিক সরবরাহ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী (১৭) জনাব আসাদুজ্জামান খান, পাটমন্ত্রী (১৮) জনাব  এম কোরবান আলী, তথ্য বেতার মন্ত্রী (১৯) ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, অর্থমন্ত্রী (২০) ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী (২১) জনাব তোফায়েল আহমেদ, রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী (২২) জনাব শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, চিফ হুইপ (২৩) জনাব আবদুল মমিন তালুকদার, সমবায় প্রতিমন্ত্রী (২৪) জনাব দেওয়ান ফরিদ গাজী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী (২৫) অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী (২৬) জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী (২৭) জনাব মোসলেমউদ্দিন খান, পাট প্রতিমন্ত্রী (২৮) জনাব মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী (২৯) জনাব কে এম ওবায়দুর রহমান, ডাক, তার ও টেলিফোন প্রতিমন্ত্রী (৩০) ডা. ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী (৩১) জনাব রেয়াজ উদ্দিন আহমেদ, বন, মৎস্য ও পশুপালন প্রতিমন্ত্রী (৩২) জনাব এম বায়তুল্লাহ, ডেপুটি স্পিকার  (৩৩) জনাব রুহুল কুদ্দুস, রাষ্ট্রপতির প্রধান সচিব (৩৪) জনাব জিল্লুর রহমান এমপি - সেক্রেটারি (৩৫) জনাব মহিউদ্দিন আহমদ এমপি (৩৬) জনাব শেখ ফজলুল হক মনি - সেক্রেটারি (৩৭) জনাব আব্দুর রাজ্জাক এমপি - সেক্রেটারি (৩৯) জনাব আনোয়ার চৌধুরী (৪০) বেগম সাজেদা চৌধুরী এমপি (৪১) বেগম তসলিমা আবেদ এমপি (৪২) জনাব আবদুর রহিম - দিনাজপুর (৪৩) জনাব আব্দুল আওয়াল এমপি, রংপুর (৪৪) জনাব লুৎফর রহমান এমপি, রংপুর (৪৫) জনাব এ কে মুজিবুর রহমান এমপি, বগুড়া (৪৬) ড. মফিজ চৌধুরী এমপি, বগুড়া (৪৭) ডা. আলাউদ্দিন এমপি, রাজশাহী (৪৮) ডা. আসহাবুল হক এমপি, কুষ্টিয়া (৫০) জনাব রওশন আলী এমপি, যশোর (৫১) জনাব শেখ আবদুল আজিজ এমপি, খুলনা (৫২) জনাব সালাহ উদ্দিন ইউসুফ এমপি, খুলনা (৫৩) মি. মাইকেল সুশীল অধিকারী, খুলনা (৫৪) জনাব কাজী আবুল কাশেম এমপি, পটুয়াখালী (৫৫) জনাব মোল্লা জালালউদ্দিন আহমদ এমপি, ফরিদপুর (৫৬) জনাব শামসুদ্দিন মোল্লা এমপি, ফরিদপুর (৫৭) শ্রী গৌরচন্দ্র বালা, ফরিদপুর (৫৮) জনাব গাজী গোলাম মোস্তফা এমপি, ঢাকা নগর (৫৯) জনাব শামসুল হক এমপি, ঢাকা (৬০) জনাব সামসুদ্দোহা এমপি, ঢাকা (৬১) রফিক উদ্দিন ভূইয়া এমপি, ময়মনসিংহ (৬২) সৈয়দ আহমদ, ময়মনসিংহ (৬৩) শামসুর রহমান খান এমপি, টাঙ্গাইল (৬৪) নুরুল হক এমপি, নোয়াখালী (৬৫) কাজী জহিরুল কাইউম এমপি, কুমিল্লা (৬৬) ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এমপি, কুমিল্লা (৬৭) এম আর সিদ্দিকী এমপি, চট্টগ্রাম (৬৮) এম এ ওয়াহাব এমপি, চট্টগ্রাম (৬৯) শ্রী চিত্তরঞ্জন সুতার এমপি (৭০) সৈয়দা রাজিয়া বানু এমপি (৭১) আতাউর রহমান খান এমপি (৭২) খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস (৭৩) শ্রী মং প্রু সাইন, মানিকছড়ির রাজা (৭৪) অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ (৭৫) আতাউর রহমান (৭৬) পীর হাবিবুর রহমান (৭৭) সৈয়দ আলতাফ হোসেন (৭৮) মোহাম্মদ ফরহাদ (৭৯) বেগম মতিয়া চৌধুরী (৮০) হাজী মোহাম্মদ দানেশ (৮১)  তৌফিক ইমাম, সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (৮২)  নুরুল ইসলাম, সচিব (৮৩) ফয়েজউদ্দিন আহমদ, সচিব (৮৪) মাহবুবুর রহমান, সচিব, সংস্থাপন বিভাগ (৮৫) আবদুল খালেক, উপরাষ্ট্রপতির সচিব (৮৬) মুজিবুল হক, সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (৮৭) আব্দুর রহিম, রাষ্ট্রপতির সচিব (৮৮) মইনুল ইসলাম, সচিব, পূর্ত গৃহনির্মাণ ও শহর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় (৮৯) সৈয়দুজ্জামান, সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় (৯০) আনিসুজ্জামান, সচিব (৯১) ড. এ সাত্তার, রাষ্ট্রপতির সচিব (৯২) এম এ সামাদ, সচিব, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় (৯৩) আবু তাহের, সচিব, ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় (৯৪) আল হোসায়নী, সচিব, বিদ্যুৎ শক্তি মন্ত্রণালয় (৯৫) ডা. তাজুল হোসেন, সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় (৯৬) মতিউর রহমান, চেয়ারম্যান, টিসিবি (৯৭) মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান (৯৮) এয়ারভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকার, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান (৯৯) কমোডর এমএই খান, বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান (১০০) মেজর জেনালের খলিলুর রহমান, মহাপরিচালক, বিডিআর (১০১) এ কে নাজির উদ্দিন আহমদ, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক (১০২) ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১০৩) ড. মাযহারুল ইসলাম, উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১০৪) ড. মুহম্মদ এনামুল হক, উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১০৫) এটিএম সৈয়দ হোসেন, অতিরিক্ত সচিব (১০৬) নুরুল ইসলাম, আইজিপি, পুলিশ (১০৭) ড. নীলিমা ইব্রাহীম (১০৮) ড. নুরুল ইসলাম, পরিচালক, পিজি হাসপাতাল (১০৯) ওবায়দুল হক, সম্পাদক, বাংলাদেশ অবজারভার (১১০) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সম্পাদক, ইত্তেফাক (১১১) মিজানুর রহমান, প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক, বিপিআই (১১২) আনোয়ারুল ইসলাম, যুগ্ম সচিব, রাষ্ট্রপতির সচিবালয় (১১৩) ব্রিগেডিয়ার এ এন এম নুরুজ্জামান, পরিচালক, জাতীয় রক্ষী বাহিনী (১১৪) কামারুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (১১৫) ডা. মাজহার আলী কাদরী, বাংলাদেশ চিকিৎসক সমিতির সভাপতি।
(দৈনিক ইত্তেফাক : ৭ জুন ১৯৭৫)

আবেদ খান ● সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

বি.দ্র : পরবর্তী পর্ব প্রকাশ হবে আগামী ৪ ডিসেম্বর, বুধবার। ] 

আরও পড়ুন