• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, ০২:২৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, ০২:২৭ পিএম

রোকেয়ার নারীচিন্তা : আধুনিক সমাজ ভাবনা 

রোকেয়ার নারীচিন্তা : আধুনিক সমাজ ভাবনা 

উনবিংশ শতাব্দীর পশ্চাদপদ সমাজে জন্ম নেয়া রোকেয়া এক বিস্ময়কর যুগঅগ্রগামী মানুষ। তাঁর এই অগ্রসর চিন্তার মূলে ছিলো  আধুনিকতা ও সমজে সচেতনতা।  সে সময়ের পশ্চাদপর, কুসংস্কারাছন্ন, অনুদার সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনই ছিলো তার স্বপ্ন ও সাধনা।  এই সমাজ পরিবতর্নের ক্ষেত্রে রোকেয়ার দর্শন ছিলো আধুনিকতা। 

উন্নত সমাজ গঠনে প্রয়োজন শিক্ষা এবং এই শিক্ষা শুধু পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, সমৃদ্ধ সমাজ ও জাতি গঠনে শিক্ষিত পুরুষের পাশাপাশি  শিক্ষিত ও বোধসম্পন্ন নারীও  প্রয়োজন  এ ধ্রুব সত্য রোকেয়ার দূরদৃষ্টিতে খুব ভালোভাবেই ষ্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। রোকেয়া আধুনিক ও অগ্রসর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে প্রথমেই নারীশিক্ষার কথা বলেছেন। রোকেয়া যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছিলেন অশিক্ষা ও অবরুদ্ধ জীবন নারীর চিন্তাশক্তিকে পঙ্গু করে ফেলেছে, নারী হারিয়ে ফেলেছে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা,  ফলে তাঁর দেহ ও মন চালিত হচ্ছে অন্যের ইচ্ছায় , এইভাবে নিজের চিন্তাও ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ না থাকায়  নারী দেহ ও মন অন্যের দাস হয়ে পড়েছে আর দূভাগ্যের বিষয় নারী এই দাসত্বকেই নিজের জীবনের সৌভাগ্য মনে করছে। এই দাসত্ব, মনের এই বৈকল্য থেকে নারীকে জাগানোর জন্য রোকেয়া আমাদের চিন্তার জায়গাটিতে আঘাত করেছেন, রোকেয়ার তীর্যক  প্রশ্ন-

 “এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কি ? দাসী। পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসায় উঠিয়া গিয়াছে শুনি কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? না। আমরা দাসী কেন? ”
আমাদের মন পর্যন্ত দাস (enslaved) ) হইয়া গেছে। 

রোকেয়া চেয়েছিলেন দাসত্বের মুক্তি। এই দাসত্বের মুক্তি শুধু মাত্র নারীর অববোধবাসীনি জীবন বা নারীর পরনির্ভরশীল জীবন থেকে মুক্তি নয়, নারীর বিকল মন ও চিন্তার বৈকল্য থেকে মুক্তি। অশিক্ষার অন্ধকার আর আত্মার পরাধীনতা থেকে মুক্তি। এই মুক্তির আলো তিনি দেখেছিলেন শিক্ষায়। রোকেয়ার সেই শিক্ষার  অর্থ ব্যাপক ও প্রয়োগিক ‘শিক্ষা’র অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতি বিশেষের ‘অন্ধ-অনুকরণ’ নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (faculty) দিয়েছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা। .... যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, কর্ণ দ্বারা মনোযোগ পূর্বক শ্রবণ করি এবং চিন্তাশক্তি দ্বারা আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিতে শিখি-তাহাই প্রকৃত শিক্ষা”
এই শিক্ষা শারীরিক ও মানসিক। জড়বৎ শরীর ও মনকে সচল করার জন্য এই শিক্ষা অনুশীলনের ও চর্চার। অনুশীলন না থাকলে মানুষের চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিজ্ঞান  ভোতা হয়ে যায়। মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোর মৃত্যু হয়। তখন মানুষ শুধু একটা নির্জীব দেহ বহন করে, সে হয়ে পড়ে একজন মৃত মানুষ। এই মৃত মানুষ নিজেকে যেমন কিছুই দিতে পারে না, তেমনি সমাজ এবং জাতিকেও কিছু দিতে পারে না। নারীর বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনে তাই রোকেয়া এতো জোর দিয়েছিলেন, তাদের অচল জীবনে গতির সঞ্চারে এতো মুখর হয়েছিলেন। নারীর এই বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন মূলত আর কিছুই নয় সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের প্রধান অনুসঙ্গ। আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশলিন করি না বলিয়া হীনতেজ হইয়াছি। 

এখন অনুশীলন দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিকে সতেজ করিব। যে বাহুলতা পরিশ্রম না করায় হীনবল হইয়াছে তাহাকে খাটাইয়া সবল করিতে হয় না ? এখন একবার জ্ঞানচর্চা করিয়া দেখি ত এ অনুর্ব্বর মস্তিষ্ক (dull head  ) সুতীক্ষ হয় কি না! প্রকৃত সুশিক্ষা চাই- যাহাতে মস্তিস্ক ও মন  উন্নত(brain o mind cultured) হয়। আমরা উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে সমাজও উন্নত হইবে না। যতদিন আমরা আধ্যাত্মিক জগতে পুরষদের সমকক্ষ না হই, ততদিন পর্যন্ত উন্নতির আশা দূরাশা মাত্র। আমাদিগকে সকল প্রকার জ্ঞানচর্চা করিতে হইবে। 
এই ‘আধ্যাত্মিক’ শব্দটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ কোনো জড় বন্তু নয়। মানুষের মনও কোনো জড় পদার্থ নয়। মানুষের আছে আধ্যাত্ম শক্তি যা মানুষকে পৃথক করেছে জীবজগতের অনান্য প্রাণি থেকে। এই শক্তিই মানুষকে মনুষ্যত্বের উজ্জ্বল বিভায় অনন্য করে তুলেছে। রোকেয়া নারীর কর্মে এবং ধ্যানে শিক্ষা ও প্রজ্ঞার সঞ্চার চেয়েছিলেন।

এবং সেটা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বা জীবিকার প্রয়োজনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ নয়।  তিনি চেয়েছিলেন নারীর মানসজগত ও তার সত্তার ভেতরে শিক্ষার স্ফুরণ। মনোজাগতিক এবং আত্মিক উন্নয়ন।  যাকে বলতে চেয়েছেন ‘ প্রকৃত সুশিক্ষা’ । এই প্রকৃত সুশিক্ষায় আলোকিত মানুষই প্রকৃত মানুষ এবং তারাই সমাজের প্রকৃত সম্পদ। প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নারীও পরিণত হয় সমাজের সম্পদে।  
প্রকৃত শিক্ষায় আালোকিত নারীকে রোকেয়া চেয়েছেন পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে। কারণ পরনির্ভরশীল মানুষ পরিবার এবং সমাজের গলগ্রহ ও বোঝা।  পরনির্ভরশীলতা যেমন মানুষের অধোগতির কারণ তেমনি  তা মনের স্থবিরতারও অন্যতম কারণ। নিজ সত্ত¡ার জাগরনের জন্য কর্ম করা প্রয়োজন, প্রয়োজন যোগ্যতা ও প্রতিভার বিনিয়গীকরণ এবং স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থাকরন। রোকেয়ার স্বপ্নের নারী ছিলো অবরুদ্ধতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত ও প্রকৃত শিক্ষায় আলোকিত স্বাধীন উর্পাজনক্ষম নারী।
 
“আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টর, লেডি জজ সবই হইব।” 
রোকেয়া চেয়েছিলেন তাঁর সমাজের কুসংস্কার আর অন্ধকার দূর করতে। আর সেজন্যই চেয়েছিলেন নারীর উন্নয়ন এবং স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত নারী। সুশিক্ষিত উর্পাজনক্ষম নারী আর কিছুই নয় সমাজের ও দেশের সম্পদ। নারী পুরুষের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সমাজ যে কখনও উন্নতি লাভ করতে পারে না রোকেয়া তা খুব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন।

 ১৯৫০ সালে কলম্বো পরিকল্পনা উত্থাপিত হলে সারাবিশ্ব কাতর হয়ে পড়ে আধুনিকায়নের জ্বরে। উন্নয়নের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব আর  কাক্সিক্ষত সে উন্নয়নের জন্য  নারী ক্ষমতায়ন হয়ে পড়ে অপরিহার্য। বিশ্বে তোলপাড় শুরু হলো নারীইস্যূতে, বাঘা বাঘা নীতিনিধারকরা গলধঘর্ম হয়ে যান উন্নয়ন আর নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে। বলা হয় উন্নয়নের মূল স্রোতে নারীকে সম্পৃত্ত করা না গেলে কখনই উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ঘোষণা করে নারীবর্ষ, অথচ একশত আটত্রিশ বছর আগে এই উন্নয়নের অপরিহার্যতার চিত্র কত সহজে রোকেয়া এঁকেছিলেন মাত্র কয়েকটি বাক্যে-

যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট(পত্নী) হয়, সে শকট অধিক  দূর অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহ কোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না। 
সেই অন্ধকার সময়ে জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের প্রতি রোকেয়ার আগ্রহও বিস্ময়কর। রোকেয়া উন্নতির জন্য প্রযুক্তির কথা বলেছেন, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চার ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর বিভিন্ন লেখায় এই বিজ্ঞানমনস্কতা ফুটে উঠেছে। 

ধর্মের প্রতি মানুষের চিরন্তন ও সহজাত দুর্বলতার বিষয়টি তিনি জানতেন তাই  ধর্মে জ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মানুষকে আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন- জ্ঞান ধর্ম্মেরই প্রধান অঙ্গ। এককালে মোসলেম সমাজ অতিশয় উন্নত ছিল; কিসের বলে? জ্ঞানবলে। আজি ইউরোপ ও আসেরিকা সুসভ্য, ধনাঢ্য এবং সর্ব্ববিষয়ে উন্নত; কেন জ্ঞানবিজ্ঞানের কৃপায়। যে ক্ষূদ্র  জাপানের দিকে চাহিয়া অভাগিনী বঙ্গভুমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে, তাহারও উন্নতির একমাত্র কারণ-জ্ঞান। 

রোকেয়া দেশ্রপমিক ছিলেন। এই ভারতবর্ষের মঙ্গলের জন্য আর অন্তরের ভেতর গভীর কান্না আর ভালোবাসা ছিলো। কখনও শ্লেষ, আক্ষেপ, কখনও যুক্তি আবার কখনও ব্যঙ্গের মাধ্যমে এই সমাজকে জাগাতে চেয়েছেন। বঙ্গললনার উন্নয়ন যেমন ছিলো তার আজীবনের সংগ্রাম আর সাধনা তেমনি বঙ্গমাতার উন্নয়নের জন্য তার ছিলো গভীর প্রেম আর প্রচেষ্টা।

 ভারতবাসীর বুদ্ধি সুপথে চালিত হয় না- জ্ঞানবিজ্ঞানের সহিত আমাদের সম্পর্ক নাই। আমাদের সব কার্যের সমাপ্তি বক্তৃতায়Ñসিদ্ধি করতালি লাবে! কোনো দেশ আপনা হইতে উন্নত হয় না, তাহাকে উন্নত করিতে হয়। কেয়ার নারীচিন্তা আর সমাজচিন্তা মূলত একই মূদ্রার দুটি পিঠ, পাশাপাশি সমান্তরালভাবে বহমান। 

তার নারীউন্নয়ন চিন্তা পক্ষান্তরে সমাজ আর জাতিরই উন্নয়নচিন্তা। উন্নয়নের এই বিন্দুতে রোকেয়ার মধ্যে নারী-পুরুষে কোনো বিভেদ ছিলো না, সেখানে স্বার্থ ছিলো একটাই এই সমাজের উন্নয়ন, এই বাঙালি জাতির উন্নয়ন । আর এজন্যই রোকেয়া র্নিদ্বিধায় উচাচারণ করেছিলেন স্বার্বজনীন সেই শ্বাশত সত্য-
পুরুষের স্বার্থ আর আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে- একই। তাঁহাদের জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য যাহা আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। শিশুর জন্য পিতামাতা উভয়েরই সমান দরকার। 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট