• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, ০৫:২২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, ০৫:২২ পিএম

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে নারী-পুরুষের সম্পর্ক

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে নারী-পুরুষের সম্পর্ক

জার্মান দার্শনিক হেগেলের যে ভাববাদী দ্বন্দ্ববাদ থেকে নির্যাস নিয়ে কার্লমার্কস এবং ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের ( মেটেরিয়ালিস্টিক ডায়ালেক্টিক) জন্ম দিয়েছিলেন তার মূল কথা ছিল তিনটি-থিসিসি, এন্টিথিসিস এবং সিনথেসিস। অর্থাৎ হেগেল বলছেন-পৃথিবীর যা কিছু সৃষ্টি, পরিবর্তন তার সবকিছুই একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থার ফল। আর এই দ্বন্দ্ব প্রক্রিয়ায় কোনো একটি অবস্থা বা আঁধার একটি নতুন ধারণা দেয় (থিসিস), এরপরে সেটা নিয়ে অন্য একটি অবস্থা বা আধার পাল্টা যুক্তি বা প্রতিধারণা দেয় (এন্টিথিসিস) এবং সবশেষে সেই যুক্তি-পাল্টাযুক্তির ফলে সৃষ্ট নতুন বাস্তবতাই (সিনথেসিস) হলো পরিবর্তন।

 আর এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। নিরন্তর এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় সমাজ-সভ্যতা এগিয়ে চলে। আর হেগেলের কথায় ‘থিসিস’ আসে ভাব (আইডিয়া) থেকে। কিন্তু কার্ল মার্কস দ্ব›দ্ববাদকে বস্তুগত আধার হিসেবে প্রমান করেছেন। তিনি বলছেন-দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর যাবতীয় কিছুরই পরিবর্তন হয় ঠিকই কিন্তু সেখানে অবস্তুগত নয়। বস্তুনিরপেক্ষ কোনো কিছু পরিবর্তন আনে না। সে বস্তু বা মেটেরিয়ালিষ্টিক বাস্তবতা বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা অনুযায়ীই হয়ে থাকে। অর্থাৎ যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, যার দৈঘ্য-প্রস্থ এবং ভর রয়েছে তাই বস্তু। তবে অনেক ক্ষেত্রে বস্তুর উপস্থিতি সাধারণ ঈন্দ্রিয়ক্ষমতা দিয়ে উপলব্ধিতে নাও আসতে পারে কিন্তু তার সুক্ষ্ম উপস্থিতি থাকবেই।

হেগেল তার দ্বান্দ্বিকবাদের ব্যাখ্যায় বলেছেন-বস্তু বাহ্যিক শক্তিদ্বারা চালিত হয় এবং তার সাথে সাংঘর্ষিক বা দ্বান্দ্বিক আচরণই পরিবর্তন আনে। কিন্তু মার্কস বলছেন- বস্তু বাইরের শক্তিদ্বারা চালিত হয় না বরং বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তিই বাহ্যিক শক্তিকে চালিত করে। এ প্রসঙ্গে মাও সে তুং বলছেন-বস্তুর বাহ্যিক শক্তি হলো দ্বন্দ্বের শর্ত আর অভ্যন্তরীণ শক্তি হচ্ছে তার ভিত্তি। যেমন-ডিমে নির্দিষ্ট তাপ দিলে তার অভ্যন্তরীণ শক্তিতে-ই মুরগীর বাচ্চা তৈরি হয় কিন্তু সমপরিমান তাপ পাথরে দিলে সেখানে মুগরীর বাচ্চা তৈরি হবে না। মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদি এ ব্যাখ্যা সভ্যতায় চিন্তার ক্ষেত্রে যুগান্তর নিয়ে আসে। 

মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদি ধারনায় সবকিছু ব্যাখ্যা করা গেলে এ মর্তের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র নারী ও পুরুষের সম্পর্ককেও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীআয়নায় দেখলে ক্ষতি কি? প্রাণীজগতের একটি বিয়িং হিসেবে নারী ও পুরুষের উপস্থিতি নানভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম বুঝি-মানুষ সৃষ্টির সেবা জীব, মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা চিন্তা করতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু এদু’টির ধারনার কোনোটিই সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত কিনা, নাকি আবেগ আর ফ্যালাসির মিশেল তা আরও আলোচনার দাবি রাখে। সম্ভবত চার্লস ডারউইনই প্রধান ব্যক্তি যিনি পৃথিবী/সভ্যতা/ বিশ্বজগতে টিকে থাকার বা পরিবর্তনের শর্ত হিসেবে-‘যোগ্যতা’-কে সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন-এ বিশ্বব্রহ্মান্ডে প্রানি ও বস্তুকূলের মধ্যে নিয়ত সংঘর্ষ চলছে, আর সেই সংঘর্ষে যারা যোগ্যতার প্রমান দিচ্ছে তারাই কেমন টিকে যাচ্ছে। 

অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যেমন-অতিশয় ডায়নোসর বিলুপ্ত হলেও ক্ষুদ্র তেলাপোকা টিকে আছে। তাঁর এ তত্তে¡র কেতাবি নাম হল-সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট বা যোগ্যরাই টিকিয়া থাকিবে। সে দিক থেকে, নারী-পুরুষের সম্পর্কেও বিবর্তনবাদ মূলসুর খুঁজে পাওয়া যায়। আলোচ্য সম্পর্কটিতে কেউই নিরঙ্কুশ যোগ্য বা অযোগ্য নয়। এখানে যোগ্যতা বিষয়টি আপেক্ষিক হয়ে যাচ্ছে।আবার মার্কস ও এঙ্গেলস যখন জানাচ্ছেন-সম্পত্তির মালিকানার সংস্কৃতি কীভাবে নারীর চিরাচরিত ভূমিকায় যুগান্তর এনেছিল তখন পুরুষের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের ফাঁকিবাজী ধরা পড়ে।

তবে, এতোসব অকাট্য যুক্তি, প্রমাণ থাকার পরও মানুষ নারী-পুরুষের সম্পর্কটিকে সামাজিক, ধর্মীয় অনুশাসন আর আচরণগত আটপৌড়ে লেন্স দিয়ে দেখতেই অভ্যস্ত। আমরা হামেশাই শুনে থাকি, বাপ-দাদা’র আমল থেকে চলে আসছে। অর্থাৎ নারী-পুরুষ সম্পর্কে আগের প্রজন্ম যা স্বীকার করেছেন, চর্চায় নিয়েছেন তাকেই উত্তরপ্রজন্ম ভবিতব্য হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং করছে। কিন্তু সম্পর্কটিকে বা নারী-পুরুষের সম্পর্কের নেক্সাসকে এতো সরল অর্থে তো দেখার সুযোগ নেই! নারী-পুরুষের সম্পর্কটিতে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, সঙ্গমে চয়েস নিয়ে দ্বন্দ্ব, সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, সাংসারিক পদসোপান বা হাইরারকি নিয়ে দ্ব›দ্ব অর্থাৎ সম্পর্কটি মূলগতভাবেই দ্বান্দ্বিক।তাই নারী ও পুরুষের সম্পর্কের শর্ত ও ভিত্তি, এর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শক্তি কেমন, শক্তিসমূহের আচরণগত মুভমেন্ট ও ধরণ সবকিছুই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদি দৃষ্টিতেই বিচার্য। নারী-পুরুষের সম্পর্ক বা দ্বন্দ্বটিকে শুধু ভালোবাসায় জীবনপার বা কাজিয়া-ফ্যাসাদ হিসেবে দেখাটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়, নয় কম্প্রেহেনসিভও।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদি দৃষ্টিতে সম্পর্কটিকে ব্যাখ্যা করার ফলিত রূপ তবে কেমন হবে? এখানে আলোচনার সুবির্ধার্থে একজন নারী ও একজন পুরুষের জীবনচক্রকে উপাদান হিসেবে নেয়া যাক। জীবনচক্রের শুরুতে শিশুকন্যা ও ছেলে শিশুর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে আমাদের চর্চিত জীবনে। বায়োলজিক্যাল সেক্স নয়, শুধুমাত্র সোস্যালি কনস্ট্রাকটেড জেন্ডারের ফোঁকর দিয়ে বায়োস্কোপ দেখা শুরু হয়ে যায়। সেই জন্মের ক্ষণে উচ্চাঙ্গ বা  মৌন স্বরে আযান, নামকরণ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন রিচুয়াল পারফর্ম করতে গিয়ে কোথায় খুঁজে পাওয়া যায় নারী-পুরুষ সমান?

 একটু বড় হলে-কন্যার শরীরের নানা জায়গায় সুঁচবিদ্ধ করে তাকে অলংকার পরিধানের উপযুক্ত করা হয়। সাথে সাথে চলে-খেলাধূলায় নারী ভার্সন, কন্যাটির হাঁটায়, হাসিতে, বলায়, মেলামেশায় পড়ানো শুরু হয় নানা শাসনবেড়ি। বয়ঃসন্ধিকালে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বোঝানো হয়-সে নারী, তার নারী শরীরের রক্ষণাবেক্ষণ, শরীরের নানান অঙ্গ-প্রতঙ্গের বাজার চলতি চাহিদা এবং একজন পুরুষের চোখে আদর্শ (কামবস্তু হিসেবে) নারী হয়ে ওঠার জন্য চলে নিরন্তর যত্ন-আত্তি। 

এরপরে কুমারিত্ব রক্ষার ধর্মীয়-সামাজিক তাগিদ, যথাসময়ে বিয়ের পিড়িঁতে বসাতে চৌদ্দবংশ মিলে চলে ভালো ছেলের (ভালো ছেলের সংজ্ঞা কী?) সন্ধান। তারপর কণ্যার দুচোখের জল, হৃদয়ের ক্ষরণ আর স্বচিন্তা-স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে জন্মের সুতো কেটে নারীঘুড়ির নাটাই অজানা-অচেনা পুরুষের হাতে তুলে দেয়া হয়। তারপর বৌ হিসেবে মানতে হয় পুরুষের তৈরি দীর্ঘ ফর্দ, কালবিলম্ব না করে পুরুষ উত্তরপ্রজন্মের আগমন নিশ্চিত করা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে দেখুন-একজন নারী কার্যত মানবশিশু হয়ে জন্মনিয়েই উঠে পড়ে পুরুষের বাটখাড়ায়। এরপর তার শেষ নিঃশ্বাস নেয়া পর্যন্ত চলতে থাকে পুরুষের মাপা পথে চলার বাধ্যবাধকতা। 

উপরের প্যারায় এতক্ষণ যা বলা হলো, তাকে হালের জেন্ডার তাত্ত্বিকগণ বলেন-সোস্যালাইজেশন বা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়ায় শুধু ভোগের নারী নয়, ভোক্তা পুরুষও তৈরি করা হয়। ছেলে শিশুর মুখেভাত, আকিকা, খৎনা, শিক্ষায় অগ্রাধিকার, খাবারের মানে তারতম্য, বিবাহ, সম্পত্তিতে ভাগ ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই থাকে সক্রিয় পুরুষতান্ত্রিক প্রচেষ্টা। শুধু পুরুষ তৈরি নয়, তাকে নারীর চেয়ে সবদিক থেকেই শ্রেয়তর হতে হবে সে প্রচেষ্টায় গোটা সভ্যতা ত্বারস্বরে কোরাস করতে থাকে। 

তাহলে দেখুন- দুটো ভিন্ন সংস্কৃতি, শক্তি, চিন্তা, সম্পদ, নির্বাহী ক্ষমতা ও পরিসর নিয়ে বেড়ে ওঠা নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক কী হবে? সেটাতে কী সমতা বা সাম্যতা আসবে? কেউ ক্ষমতা ছাড় দেবে? সম্পদ? না, কিছুই হবে না। কারন যুক্তিযুক্ত কিছু হবার মতো কোনো শর্ত ও ভিত্তি কোনোটিই নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কটিতে আদর্শ অবস্থায় নেই। একজন কন্যাশিশু যখন তার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে দেখে তার ভাইটির (পড়ুন পুরুষটির) সুপিরিয়রিটি তখন তার মধ্যে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা আঙ্গিক গড়ে ওঠে, যা ইভেনচুয়ালি তার মধ্যে বিশেষ ব্যক্তিত্বও তৈরি করে। 

বিয়ের পর, নতুন সংসারে ঐ নারীটির নিরঙ্কুশ ক্ষমতাহীনতা, অসংখ্য বিবি-নিষেধের পুরুষতান্ত্রিক বেড়াজাল আক্ষরিক অর্থেই তার প্রতিটি পদক্ষেপইআসলে পরিবীক্ষণ করতে থাকে। অল্পদিনেই নারী বুঝে যায়, নতুন জীবনে তার টার্মস অব রেফারেন্স। সে বন্ধ হয়ে পড়ে মূলত: কতিপয় কাজের চর্বিতচর্বনে। যাকে জেন্ডার পরিভাষায় বলা হয় ‘‘পুনরোৎপাদনমূলক কাজ”। সেই স্বামী, সংসার, রান্না, ঘরকন্না, শিশুর দেখভাল, বয়জ্যোষ্ঠদের সেবা আর সামাজিক আচারে-বিচারে খাবার সরবরাহকারী হিসেবে।এমনিভাবে একজন নারীর কপালে লেখা হয়ে যায় অলক্সঘনীয় জব ডেসক্রিপশন।

নারী ও পুরুষ একই সূত্রে তথ্য পাচ্ছে, জ্ঞানবাড়ছে, ভার্চুয়াল জগতের পরিসর বাড়ছে, তুলনামূলক পরিসংখ্যান, আয়ের ও ক্ষমতার বৈষম্য নিয়ে বিতর্কও কম হচ্ছে না। এমতাবস্থায়, নারী-পুরুষের গতানুগতিক সম্পর্কটি সাংঘাতিকভাবে ঝাকিঁ খেয়েছে। মূলত স্যাটেলাইট চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আয়মূলক কাজে নারীর অংশগ্রহণ, বায়োলজিক্যালী নারী দূর্বল এ ফসকা গেঁড়োখুলে যাওয়া ইত্যাদি নারী ও পুরুষের সম্পর্কটিকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করছে।

 নারীরা আজ পুরুষের সাথে শারিরীক সম্পর্কে না গিয়েও সন্তান নিতে পারে এবং একইভাবে পুরুষরাও। যা প্রজন্ম রক্ষায় একমাত্র দাওয়াই ‘বিয়ে বা সমাজ স্বীকৃত সঙ্গম’ কে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। চিরাচরিত জেন্ডার রোল পরিবর্তনের দাবিও তাই জোড়ালো হচ্ছে দিনে দিনে। সারাদিন অফিসে কাজ করে আবার বাড়িতে ফিরেও রান্না বা ঘরকন্নার কাজ-এটা আর চলতে পারে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা, নির্বাহী শাসনে নারীর ক্ষমতায়ন-নারী পুরুষের অধীন বা সেকেলে অধস্থনতায় জীবন পার করার অকারণ দেয়াল ভেঙ্গে দিচ্ছে।
দ্বান্দ্বিক এ প্রক্রিয়ায় এতোসব অগ্রগতি সত্বেও নারীর জন্য সাম্যতা ও সমতা অর্জনের বাকী পথ কিন্তু কুসুমাস্তির্ণ নয়। এ পথ বন্ধুর, পুরুষের পুতে রাখা দুষ্টু মাইন যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। তার থেকে বেঁচে থাকা এবং পরিবর্তনের ঝান্ডাটি উর্দ্বে তুলে ধরাও এই প্রজেন্মর নারীদের অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিৎ। আর এখানেই পুরুষ নারীর এগিয়ে যাবার তাগিদটাকে আরও অনিবার্য করে তুলতে পারে।

 লেখক: অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন সন্ধানী