• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ০৩:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ০৩:১৭ পিএম

বিজয়ের ৪৮ বছর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চারযুগ

বিজয়ের ৪৮ বছর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চারযুগ

জাতি উদযাপন করছে দেশের ৪৮তম বিজয় দিবস। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ যেদিন পাক হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ বাধ্য করেছিল লড়াকু মুক্তিবাহিনী। সঙ্গত কারনে দিনটি এদেশের মানুষের নিকট সবচেয়ে গৌরবের। দিনটি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে বর্ণাঢ্য উৎসবে পরিনত হয়। এদিন মুক্তির স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের উদ্বেল উপস্থিতি দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয় বিজয়ের সোনালী আবির।

আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবারই পথ যেন গিয়ে মেশে দেশের সব শহীদ বেদিতে। স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধীতাকারী ও তাদের দোসর ব্যতিত দেশের প্রতিটি মানুষ বিজয়ের এ দিনে গৌরবের অংশীজন হিসেবে নিজের পরিচয় নবায়ন করে নব উদ্দমে দেশমাতৃকার কল্যাণে কাজ করার শপথ নেয়। দিবসের প্রাক্কালে তাই শত সহ¯্র সালাম জানাই-শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা আর সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের। 

আজ ৪৮তম বিজয় দিবস। যুগের হিসেবেও কম নয়, চারযুগ। স্বল্প কলেবর এ লেখায় আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছি মূলত স্বাধীনতার চেতনা এবং তার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি’র মধ্যে।  

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের বছরগুলোতে মানুষ ভালো করেই জানতো নতুন দেশটিতে তারা কি চাইতে পারেন আর কি পারেন না। তখন মানুষের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল দু’বেলা লবনভাত আর মাথার উপরে একটুখানি আচ্ছাদন। আমজনতা যে সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে মহামূল্যবান স্বাধীনতা পেয়েছেন তাকে অর্থবহ করতে আরও অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল। যেটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় সামাজিক পুঁজি যা দায়িত্বগ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের জন্য ছিল আশির্বাদস্বরূপ। কিন্তু শাসকগণ কি সেই পুঁজি যথাযথভাবে ব্যবহার করেছিলেন? যে গণমানুষ যুদ্ধদিনে রক্ত দিল সেই তারাই কি দেশগঠনের অংশ নিতে পেরেছিলেন? স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে তাঁরা মর্যাদাই বা কতটুকু পেয়েছিলেন বা পাচ্ছেন- সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি।

একটি সদ্য স্বাধীন দেশে জনগণের তাৎক্ষণিক চাওয়া আর ভবিষ্যতের যৌক্তিক আকাঙ্ক্ষা কী ছিল তা কিভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে? এতোদিনে তার কতোটুকু অর্জিত হয়েছে? সর্বোপরি দেশ গড়ার কাজে মানুষের মালিকানাই বা কি পরিমান দেয়া গেল, না গেলে কেনো গেল না-সেই প্রশ্ন আসাও তো অবান্তর নয়। যখন দেশটির বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই তখন তার প্রকৃত অর্জনকে শুধু জিডিপি’র চতুর অংকে মাপা ঠিক হবে না, মাপতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাপকাঠিতেই।

কিন্তু সেই দাবিগুলো খুব জোড়ালো ভাবে আসছে না। কেনো আসছে না তার একটা বড় কারন বোধ হয়- ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি এবং শাসকদের পক্ষ থেকে জিডিপি আর অবকাঠামোনির্ভর উন্নয়নের অতি প্রচার, চলমান রাজনীতির বেনিফিসিয়ারির ব্যপ্তি এবং লুটেরা ধনীক শ্রেণীর অতি সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই তারাই জাতীয় দিবস এলেই উদযাপনে আড়ম্বরতা আর চোখধাঁধানো প্রচার-প্রপাগান্ডা দিয়ে মানুষকে স্বাধীনতার মূলচেতনা ভুলিয়ে রাখতে প্রয়াস পায়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, বেনিয়া মিডিয়া এবং পেইড বুদ্ধিজীবীদের স্বার্থবাদী অংশগ্রহণ যে চেতনার মৌসুমী জাগরণ একটি অসহ্য বাস্তবতা যদিও তার কার্যকারণ ঠিকই ঠাহর করা যায়। আর খুব স্বাভাবিক কারনে সে উপলক্ষ্য শেষ হলেই তাদের আর লেঙ্গুর খুঁজে পাওয়া যায় না, তারা গিয়ে তখন ঢুকে পড়ে বৈষয়িক সুবিধাবাদের চিরচেনা জগতে। 

মূলধারা আর ভার্চুয়াল মিডিয়ার বাড়-বাড়ন্তের যুগে মানুষ এক প্রকার অসহায় হয়েই কায়েমী স্বার্থবাদী এই প্রচারণা গিলতে বাধ্য হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের বুকভরা চেতনা নিয়ে তথাকথিত উন্নয়নের ভাঙ্গাসেতুতে দাঁড়িয়ে দোদুল্যমান জনতা আসলে কি দেখতে পায়? তাদের সামনে যা দেখা যাওয়ার কথা সে তো চুঁইয়ে পড়া উন্নয়নের কপট আলো! আর সেই ভুল আলোয় আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই আজ সামিল হচ্ছে সেসব রাজনৈতিক কাফেলায় যা মোটেও আশাবাদী হওয়ার বিষয় নয়। পাশাপাশি তথাকথিত ধর্মের মোড়কে রাজনৈতিক সালসার যে চটকদারি বিজ্ঞাপন তাতেও বিভ্রান্ত হওয়ার নজীর কম নয়। অপরদিকে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি আর নগদ টাকার কারবারে নতুন প্রজন্মকে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াও চলছে সমান তালে। মোদ্দা কথা, চিনির আস্তরণ দিয়ে তেতো স্বৈরতন্ত্র-গোষ্ঠীতন্ত্রকে রাজনীতির মূলধারা হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ তথাকথিত রাজনীতির ছায়াতলে হাঁটাহাটি করলেও তারা যে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং টিকে থাকার কাঁচামালই যোগান দিচ্ছেন সেটাও তারা বুঝছেন না। ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ছিটিয়ে তাদের পোষ মানিয়ে রাখছে ধূর্ত শিয়ালের দল।  

কিন্তু স্বাধীনতার মানে কী? মুক্তিযুদ্ধ কেনো হয়েছিল? এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ কেনো তাদের প্রাণ ও সম্ভ্রম অকাতরে দিয়েছিল? বিজয়ের চারযুগ পূর্তিতে সে হিসাব চাওয়া কি অন্যায় কিছু হবে? না, তা মনে করি নাা বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে না পারার কৈফিয়ত চাওয়াও অতি কিছু হবে না। আজ উন্নয়ন বলতে গড় জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি’র ধারাবাহিক অগ্রগতি, মাথাপিছু আয়ের উর্ধ্বমূখিনতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং গড় আয়ুবৃদ্ধি ইত্যাদিকে সামনে আনা হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় তা হয়তো ঠিকই, ঐসকল ক্ষেত্রে উন্নতি নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু সেটা সংখ্যার বিচারে, মানের বিচারে নয়। আর সংখ্যার বিচারে উন্নয়ন তো ব্যক্তির উন্নয়নের একটি দিককে বোঝায় কিন্তু গুনগত মান বিচারে গেলে তো উন্নয়নের সংজ্ঞায়ই আমুল পরিবর্তন আনতে হয়।   

   গুনগত মানে উন্নয়ন হয়নি এটা আমার একার কথা নয়, এটা এখন অনেকেই স্বীকার করছেন। গত ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. ফরাশউদ্দিন আহমদ দেশে আয়-বৈষম্য মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে বলে মন্তবব্য করেছেন। তিনি বলেন-স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের দিকে ‘‘গিনি সহজ’’ ছিল-০.৩৩ যা এখন ০.৪৮। এই গিনি সহগ যা আয়-বৈষম্য পরিমাপের অন্যতম মাপকাঠি যা ০.৫ পর্যন্ত গেলেই যেখানে বিপজ্জনক বলা হয় তা কেনো এমন অসহনীয় পর্যায়ে গেল সে প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর তিনি না দিলেও এ বিষয়ে উদ্বেগ লুকাতে পারেননি। এতো গেলো অর্থনীতির টেকনিক্যাল বাস্তবতা, কিন্তু যারা এ অবস্থায় দেশকে নিয়ে এসেছেন সেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কি বলেন-সেটা জানতে কৌতুহল হয় বৈকি। চলমান রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা যারা রাখেন তারা নিশ্চয়ই শুনেছেন রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা ছিলেন এবং আছেন তাদের কথা।

তবে আলোচ্য বিষয়ে তাদের সবার মুখে মুখস্ত কথাই শোনা যায়, তারা বলেন-দেশ যখন উন্নতির পথে থাকে, উন্নয়নের সুফল যখন নীচের দিকে প্রবাহিত হয় তখন জনে জনে আয়-বৈষম্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তারা সাফাই হিসেবে অপরাপর কিছু দেশের নামও উল্লেখ করেন। কিন্তু তাদের এই কথার তো কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, এর পুরোটা না হলেও বেশীরভাগটাই রাজনৈতিক ভাষ্য। কথা হচ্ছে- কেনো দীর্ঘ ৪৮ বছরেও স্বাধীনতার সুফল সবার জন্য হলো না, কেনো তা ন্যয্যতাভিত্তিক করা গেল না সেই প্রশ্নের উত্তর ক্ষমতাসীনরা যেভাবে দেন তা তো হতে পারে না।

কিন্তু অর্থনীতির তত্ত্বে গিনি সহগে আয়-বৈষম্য দেখা হয় কিন্তু আয় ছাড়াও আরও বহুরকম বঞ্চনা তা কি দিয়ে মাপা হবে? এর কোনো মাপকাঠি তো প্রমিত পরিসংখ্যানে সরাসরি নেই। তবে আয়-বৈষম্য এবং অন্যান্য জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যায় বৈষম্যের বিচিত্র সব রূপ। বিগত চারদশকে শাসকগোষ্ঠী সেই ব্যবস্থাকেই পোষকতা দিয়েছে যা তাদের আয়, চৌদ্দবংশের ভবিষ্যত এবং ক্ষমতার বুনিয়াদ তৈরি করেছে তাকেই, এ প্রক্রিয়ায় জনগণ শুধুই ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের সাম্যভিত্তিক উন্নয়নের কথা তারা সচেতনভাবে পরিহার করেছে বলেই আজ শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, কর্মসংস্থানে, রাজনীতির প্রতিনিধিত্বে, ভূমিতে সবখানেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। দেশে ভূমিহীন কতো মানুষ? কতো মানুষ আয় উপার্জনহীন? কতো মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বহুকাল খুঁজে ফিরছে ভুক্তভোগী মানুষের চোখ-মুখ।

আজ আমলাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে, একপেশে ব্যবস্থায় রাতারাতি জনপ্রতিনিধি বনে যাওয়া প্রত্যেকেই বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর সুবিধাও দেয়া হচ্ছে উদার হস্তে কিন্তু অর্থের টান পড়ছে শুধু গরিবের বেলায়? সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নামে এক-দুই হাজার টাকা বা মাসে বিশ-ত্রিশ কেজি চাল দিয়ে গরীব বিদায় করা হচ্ছে যা রীতিমতো করুনা। কৃষক পাচ্ছে না ফসলের ন্যয্যমূল্য, সার, বীজ, কীটনাশক কিন্তু মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্মে সেই পণ্যই ভোক্তদের কিনতে হচ্ছে কয়েকগুন বেশী দামে। মুক্তবাজার অর্থনীতি, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র আর সিন্টিকেটেড বিজনেস ব্যবস্থা শ্রেণীস্বার্থের কারনেই কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য কাজ করবে না। এই ব্যবস্থা ধনীকে আরও ধনী করার, তেলা মাথায় তেল দেয়ার।  

 সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিকল্পধারার মিডিয়া, লেখালেখি, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি ছাত্র-নাগরিক আন্দোলন বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে-মানুষ এই একপেশে, কতিপয় মানুষের চরম অর্থ-ক্ষমতার অর্থনীতি-রাজনীতির অবসান চায়। তারা ঠিকই ধরতে পেরেছে-স্বাধীনতার সুফল হাতেগোনা কয়জনের ঘরেই কেবল যাচ্ছে। মানুষ এও জানে, চলমান এলিট  এবং জনবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র্র চর্চা, ক্ষমতাকাঠামো এবং ক্ষমতা তোষণকারী রাজনীতির উপরিকাঠামো চিরস্থায়ী কিছু নয় এবং এই ব্যবস্থায় স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়নের কথা মুখস্থ বুলি আওড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়, এটি অলীক কল্পনা মাত্র। 

বিজয়ের চারযুগ পূর্তির এদিনে জনআকাঙ্খা আর স্বাধীনতার চেতনায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা হোক সবার। লাঞ্চিত-বঞ্চিত মানুষের ঘরে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দিতে চলুন খুঁজি  আগামীর পথ।  

 লেখক : অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন সন্ধানী