• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯, ০৪:৫২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯, ০৪:৫২ পিএম

 সোনার বাংলা যখন দূষণের বাংলা

 সোনার বাংলা যখন দূষণের বাংলা

দেশের ম্যাগাসিটি ঢাকার পথে নাকে রুমাল বা মাস্ক বেধে চলাচল করতে হচ্ছে। বায়ু দূষণে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার পরিবেশ। বেহিসেবি যানবাহন এবং ইটভাটার কালো ধোঁয়ার সাথে ধূলা-ময়লা আবর্জনায় ঢাকার আকাশ বাতাস হয়ে গিয়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন । ম্যাগাসিটি ঢাকা এখন বিশ্বের একনম্বর বায়ুদূষণের নগর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সরকার উন্নয়নের দিকে সর্বশক্তিতে নিয়োজিত থেকে দিল্লীর কাছ থেকে বিশ্বের এক নম্বরের স্বীকৃতি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। যে কোনদিন হয়তো কোনো মন্ত্রী দাবী করে বসবেন বায়ুদূষণে আমরা এখন বিশ্বের রোল মডেল। দেশের সাধারণ মানুষের এখন অপেক্ষার পালা। সরকারের সহযোগিতা নিয়ে নগরপিতারা উৎসব শুরু করলে আপ্লুত হবে নগরবাসীর সাথে সারাদেশের মানুষ।

সম্পতি আমাদের ক্রিকেট দল ভারত সফরে গিয়েছিল। তখন ভারতের রাজধানী দিল্লি বিশ্বের একনম্বর বায়ুদূষণের শহর। সারাদেশের মানুষের কত দুশ্চিন্তা। সবাই ক্রিকেটারদের স্বাস্থ্য চিন্তায় ব্যস্ত। ক্রিকেটারদের মাস্ক পরে নেট প্যাকটিসের ছবিও জাতীয় পত্রিকায় দেশবাসী দেখেছে। পরিবেশ উন্নয়নের জন্য স্কুল বন্ধ করে দেয়া, রাজপথে জোড়-বেজোড় করে গাড়ি চলাচলের নির্দেশ জারীর সংবাদও শুনেছে। তারপরও এমন পরিবেশে ক্রিকেট খেলা হবে কিনা শংকা প্রকাশ করেছে অনেক। তবে ক্রিকেটাররা ভারত সফর শেষ করে দেশে ফিরে দেখে ঢাকা বায়ুদূষণে এখন বিশ্বের এক নম্বর। আনন্দ হবারই কথা ! ভারতে মাস্ক পরে খেলতে হয়েছে আর দেশে চব্বিশ ঘন্টা মাস্ক পড়েই থাকতে হবে।
 
দেশে এখন উন্নয়নের জোয়ার চলছে। রাজধানী ঢাকা তার কেন্দ্রবিন্দুতে। উন্নয়নের সাথে ধুলোবালি আর আবর্জনার প্রত্যক্ষ যোগসূত্র রয়েছে। ঢাকা ওয়াসা স্যুয়ারেজ লাইন, টিএণ্ডটি টেলিফোনের লাইন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গ্যাসের লাইন স্থাপনের নামে মাসের পর মাস ধরে রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলির রাস্তা একের পর এক খোঁড়াখুঁড়ি করে চলে। এসব খোঁড়াখুঁড়ি কখনও শেষ হয় না। একটা শেষ হলে আবার নতুন করে পাশে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। 

এতে ধূলো-ময়লা, আবর্জনা আর ইট বালিতে একাকার হয়ে থাকে রাস্তাগুলো। শোনা যায় কোনো সংস্থা উন্নয়ন কাজের প্রয়োজনে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করলে কাজ শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তা পুনরায় মেরামত করবে নগর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আজ পর্যন্ত সাধারণ জনগণ এমন মেরামত দেখতে পায় নি। বছরের পর বছর নগর কর্তৃপক্ষ রাস্তাগুলো মেরামত না করে ফেলে রাখে। বরং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্য নগর কর্তৃপক্ষ একটা পূর্বনির্ধারিত অংকের অর্থ গ্রহণ করলেও মেরামতে আগ্রহী হয় না। বিষয়টি বায়ুদূষণে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রেখে চলেছে।
 
রাজধানী ঢাকায় এখন একটার পর একটা উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। মেট্রো রেলের নির্মাণ কাজ চলছে। একটার একটা ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলছে। এসব নির্মাণ কাজের জন্য রাস্তার যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তাও যথাসময়ে মেরামত করা হচ্ছে না। আর নির্মাণ কাজের জন্য জড়ো করা ইট বালি, সিমেন্টের ধূলো বায়ুদূষণের অন্যতম সহায়ক হচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে বিপর্যস্ত পরিবেশ উন্নয়নের কোন দায় কারো আছে বলে মনে হয় না। চলমান নির্মাণ পাশাপাশি যোগ হয়েছে ব্যবহার অযোগ্য রাস্তার ধূলোবালি, সরকারি- বেসরকারি নির্মাণের ইট, বালি, খোয়া সিমেন্ট পরিবহন এবং রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা। 

এসবও বাতাসে মিশে রাজধানীর আকাশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে। তবে নগর কর্তৃপক্ষের জন্য এগুলো আশীর্বাদ। দায় এড়াতে অন্যের কাঁধে বন্দুক রাখতে সহায়ক। রাজধানী ঢাকাকে বায়ুদূষণে বিশ্বের রোল মডেল করে তুলতে যানবাহনের কালো ধোঁয়া অন্যতম। রাজধানীর পরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কোনো কার্যক্রম না থাকায় বিত্তবানরা নিজেদের খেয়াল খুশী মতো উন্নয়ন করে চলেছে। ঢাকা হয়েছে যানজটের শহর, শত কোটি শ্রম ঘন্টা পথেই চলে যাচ্ছে। 

তারপরও পাবলিক পরিবহনের চাইতে প্রাইভেট পরিবহন গুরুত্ব পাচ্ছে। নৌ ও রেল পরিবহনকে অবহেলা করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ায় সড়ক পরিবহন আজ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেখাচ্ছে। ফিটনেস বিহীন চলাচলে অযোগ্য যান রাস্তায় নামিয়ে তারা প্রতিনিয়ত পথচারীদের জিম্মি করছে। রাজধানীতে এখন ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যান চলাচল করছে সবসময়। এর সাথে যোগ হয়েছে শিল্প কারখানা ও ইট ভাটার কালো ধোঁয়া। 

ধূলো, ময়লা, আবর্জনার সাথে এই কালো ধোঁয়া ঢাকার আকাশকে ধূসর ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে। আশার কথা এই যে ইতোমধ্যে হাইকোর্ট অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশ পালনে কর্তৃপক্ষের কতদিন সময় লাগবে তা সাধারণ মানুষ অনুমান করতে পারছে না। বিশ্বের একনম্বরের তকমা প্রাপ্তির আনন্দ নষ্ট করতে অন্য কোনো নির্দেশ এখনো দেখা যাচ্ছে না। 

রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা সব পরিসংখ্যানকে বেহাল করে তুললেও তা নিয়ন্ত্রনের কোনো পরিকল্পনা দেখা যায় না। এক কোটি লোকের বসবাস উপযোগী ম্যাগাসিটিতে এখন পাঁচকোটি লোকের বাস। সারাদেশের মানুষের নজর এখন ঢাকার দিকে। রুটিরুজির জন্য মানুষ কাতারে কাতারে ঢাকার দিকে ছুটছে প্রতিনিয়ত। রাজধানীতে এসব মানুষের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ধারণ ক্ষমতা না থাকলেও একসাথে রোধ করা যাবে না। এখানে উভয় পক্ষের স্বার্থ জড়িত। একপক্ষ বেঁচে থাকার সংগ্রামে জড়িত আর অন্য পক্ষ এদের শ্রমে নিজের সুখের সাম্রাজ্য সৃষ্টিতে ব্যস্ত। 

এককেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলাফল এমনটাই। সবাই কেন্দ্রের আশেপাশে থাকতে চায়। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। নগর ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়ছে। নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেই। সময়ে সময়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিয়োজিত মানুষগুলোর দিকে আঙ্গুল তোলা হয়ে থাকে মাত্র। তবে তাতে কোনো প্রাণের স্পন্দন থাকে না। 

দেশের জনসংখ্যাকে এখন আর কেউ সমস্যা বিবেচনা করে না। ক্ষমতার বলয় তাই জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রম গ্রহণে আগ্রহী নয়। আমাদের গার্মেন্টস এদের শ্রমে সচল, এরাই মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি হিসেবে রফতানি হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে। এদের আয়ই রিজার্ভ বৃদ্ধির সহায়ক। আর প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হিসেবে দান অনুদানের প্রাপ্তির হাতিয়ার। সারাদেশের ভেসে বেড়ানো মানুষগুলোর জন্য সাহায্য সহযোগিতার কম প্রকল্প নেই। এদের শ্রম বিক্রি করা অর্থেই হোয়াইট কলারের মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটছে। প্রকৃত অর্থে এসব হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করার শ্লোগান সর্বস্ব কার্যক্রম দিয়েই দেশ এগিয়ে চলেছে।

 অথচ এসব মানুষগুলোর মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজন হয় না। ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করে দেশ বিদেশে বাহবা নেয়া যায়। দায়িত্ব নিতে হয় না কিন্তু লাভের ষোলআনা ভোগ করা যায়। তাই সব সুবিধার মধ্যে সামান্য কিছু অসুবিধা ভোগ করতে হলেও তা মেনে নিচ্ছে হোয়াইট কলারের মানুষেরা। বিশ্ব পরিবেশ দূষণে আমাদের অবদান নগন্য। কিন্তু কার্বন দূষণে আমাদের অবদান বিবেচনায় ক্ষতিগ্র্স্তদের তালিকায় আবার আমরা প্রথম সারীতে। কার্বন নিঃসরণে হয়তো আমরা পিছিয়ে আছি তা বলে আকাশ-বাতাস-পানিতে পিছিয়ে থাকবো এমন রণনীতিতে ক্ষমতার বলয় বিশ্বাসী নয়। 

আমাদের বিচিত্র কিছু পরিকল্পনা আছে। রাজধানী ঢাকার পরিবেশ রক্ষার জন্য টু স্ট্রোক ইঞ্জিনের যান তুলে দিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হলো। আবার হাজারিবাগের ট্যানারি শিল্প সাভারে নিয়ে যাওয়া হলো। নদীর ভাটি থেকে উজানে নিয়ে দূষণ আরো বিস্তার ঘটানো হলো। ধানমণ্ডিকে আবাসিক এলাকা হিসেবে তৈরি করে আজ অতিবাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তর করে ফেলা হলো। নগর পরিকল্পনার চাইতে ব্যক্তির স্বার্থরক্ষাকে প্রাধান্য দেয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সুন্দরবন। যেখানে ধ্বংস হবে জেনেও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ আরো বেসরকারি শিল্পকারখানা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলো।

 বিষয়টি অনেকটা এরকম-পরিবেশ রক্ষায় বনায়ন করতে না পারলে কি হবে প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংসে আমরা পিছিয়ে থাকবো কেন? দেশের ছোট বড় সব জলাশয় আজ দূষণ আর ভরাটের কবলে। সবুজ বিপ্লব করতে গিয়ে বনভুমি-জলাভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। গোলাপী বিপ্লব করতে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে লবণাক্ততা নিয়ে আসা হয়েছে। গভীর নলকূপ ব্যবহারের ফলে আর্সেনিক ডেকে আনা হয়েছে। পানির স্তরকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে নিচে। 

পরিবেশ সুরক্ষার নামে হাতে নেওয়া আমাদের ছোট বড় কার্যক্রমগুলো পরিবেশবাদীদের উদ্বেগের কারণ হলেও উন্নয়নের জোয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো দায় কোথাও দেখা যায় না। তাই দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ে আমাদের যত উদ্বেগ ছিল তার সিকিভাগও নেই ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে। সেই একই ভাবে আমাদের পরিবেশ রক্ষার সকল কার্যক্রমের লাগাম পাওয়া দুষ্কর। আজ বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে পোল্ডার স্লুইচ গেট তৈরি করে জলজট সৃষ্টি করলে কাল আবার তা নিরসনের নামে দ্বিগুণ ব্যয়ে প্রকল্প তৈরি করতে হয়। এভাবেই এগিয়ে চলেছি আমরা। আগামীতে পরিবেশ সুরক্ষায় নিজেদের দায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে পালন করা প্রয়োজন।

 আশু সমস্যার আশু সমাধানের কার্যক্রম থেকে বের হয়ে ক্রমে স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করে পরিবেশ রক্ষার কার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগ প্রয়োজন। এখানে দেশের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়ে সর্বগ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব যারা নিয়েছেন তারা কেউ দেশকে লস অ্যাঞ্জেলেস মনে করছেন, কেউ প্যারিস মনে করছেন, কেউ সিংগাপুর মনে করছেন, কেউ বা গোটা বিষয়টিকে সিনেমার দৃশ্য মনে করছেন। তবে কেউ এখনো কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা মনে করতে পারেন নি। 

তাই পানি দূষণ রোধ করা যাচ্ছে না, বায়ুদূষণ রোধ করা যাচ্ছে না, শব্দদূষণ রোধ করা যাচ্ছে না, মাটি দূষণ রোধ করা যাচ্ছে না। ওয়াসার পানিতে মলের জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে। সারাদেশ থেকে রাজধানীতে মানুষের স্রোত রোধ করা যাচ্ছে না। নাগরিক সেবার মান দিনে দিনে কমছে। কার্বনকেই একমাত্র পরিবেশ ধ্বংসের কারণ বিবেচনায় চিৎকার চলছে। মানুষের কল্যাণ বিবেচনায় পরিবেশ সুরক্ষায় সব সেক্টরের সমস্যায় অত্যন্ত প্রয়োজন। দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়িত্বশীল হলেই তবে সোনার বাংলা হবে। সাধারণ মানুষ তাদের জাতির জনকের সোনার বাংলা চায়। লস অ্যাঞ্জেলেস, প্যারিস, সিঙ্গাপুর কিংবা ফাইভস্টার টয়লেট অথবা সিনেমা হল নয়।
 
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাবেক সভাপতি, ইনষ্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)
    


 

আরও পড়ুন