• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৫, ২০১৯, ০১:২২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ২৫, ২০১৯, ০১:২৮ পিএম

বড়দিন

দেবতার শিবপুরে পাদ্রি এঞ্জোস

দেবতার শিবপুরে পাদ্রি এঞ্জোস

শিবপুরের মৎস্যজীবী ও কঠোর পরিশ্রমী কৃষক সবাই বিশেষভাবে শক্তির দেবতা শিবের পূজারি ছিল। এরা স্বল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণ এবং অধিকাংশই শৈব হিন্দু ও নমঃশূদ্র বা চণ্ডাল বর্ণের জাতি ছিল। এখানকার সরল প্রকৃতির হিন্দুরা শিবের পূজারি ছিলেন বলেই এই গ্রামকে প্রাচীনকাল থেকে সবাই 'শিবপুর' হিসেবে চিনত। তবে এ-ও কথিত আছে, খড়গ রাজাদের রাজত্বকালে (৬০০-৭০০ খ্রিস্টাব্দ) রাজা রাজভট্ট ও রাজা বলভট্ট দু'জনেই শৈব হিন্দত্ববাদী ছিলেন। ফলে এদের শাসনামলেই শৈব থেকে শিব শব্দের উৎপত্তি হয়ে এই এলাকার নাম শিবপুর হয়েছিল। পরে খ্রিস্টধর্মের পাদ্রি ডাস এঞ্জোসের আগমন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ফলে এ অঞ্চলের নাম 'পাদ্রিশিবপুর' হয়েছে।

১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাঙাল নামের দক্ষিণাঞ্চলীয় এই জনপদ বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামেও বিখ্যাত ছিল। ম্যাজিস্ট্রেসি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটিকে যখন জেলা সদর করা হয়, তখন মুর্শিদাবাদের নবাবের প্রভাবশালী জমিদার আগা বাকের খান এ অঞ্চলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ফলে আগা বাকেরের নামানুসারেই বাকেরগঞ্জ নামকরণ হয়। ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে আগা বাকেরের মৃত্যুর পর এ অঞ্চলের কর্তৃত্ব লাভ করেন রাজা রাজবল্লভ সেন। এর পর ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের ১ মে ম্যাজিস্ট্রেট স্যার জন শ্যোর নির্দেশে বাকেরগঞ্জ জেলা সদরের কার্যক্রম বরিশালে স্থানান্তর করা হলে বাকেরগঞ্জ তখন মহকুমা শহর করা হয়।

১৮৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে এটি আবার থানা শহরে রূপান্তরিত হলেও ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাকেরগঞ্জ জেলা এখন উপজেলা হিসেবে বহুল পরিচিত। বর্তমানে পাদ্রিশিবপুর এ উপজেলার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন। তবে ইউনিয়ন হলেও এ অঞ্চলটি আজও বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের তীর্থভূমি হিসেবে ব্যাপকভাবে আলোচিত একটি গ্রাম। জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে তখনকার প্রাচীন বাকলা অঞ্চল, এখনকার বাইফল থানা ছিল পর্তুগিজদের খ্রিষ্টীয় জনপদ গড়ে ওঠার প্রথম হাতছানি। কেননা, পশ্চিমবঙ্গের হুগলী থেকে এ দেশে ক্যাথলিক খ্রিষ্টমণ্ডলী স্থাপনের জন্য আসা প্রথম ফাদার ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এই জনপদ পরিদর্শনে এসেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতার অভিপ্রকাশেই হয়তো শিবপুরে পাদ্রিদের আগমন ঘটেছিল।

এককালে শিবপুর ছিল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার জলরাশি প্রবাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত ব-দ্বীপের নিম্নভাগে গড়ে ওঠা একটি চরাঞ্চল। তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলা সদরের পাঁচ মাইল দক্ষিণে শ্রীমন্ত নদীর তীরজুড়ে ছিল এ গ্রামের অবস্থান। প্রাচীনকাল থেকে পলি গঠিত উর্বর গ্রামটির অধিকাংশ ভূমিই শস্যশালিন ছিল বলে কৃষিকাজই এখানকার মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল এবং নদী-তীরবর্তী সবাই ছিলেন মৎস্যজীবী। কিছু সংখ্যক জেলে, গোয়ালা, ধোপা, নাপিত, চামার, চণ্ডাল, কামার-কুমার সম্প্রদায়ও বসবাস করত। সাগর-নদী-অরণ্যে ঘেরা এখানকার প্রজাদের স্বভাবে প্রচণ্ড রুক্ষতা ও স্থুলতা থাকলেও এরা ধর্মবিশ্বাসে প্রকট- কিছুটা সরল ও শান্তিকামীও ছিল। কিন্তু মাঝেমধ্যে এরাই জমিদার সৈন্যদের অত্যাচার ও অবজ্ঞা রুখতে কখনও দাঙ্গাবাজ ও উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে উঠত। ফলে সপ্তদশ শতকের শেষদিকে জমিদার সৈন্যদের লুণ্ঠন ও উৎপীড়ন বাড়তে থাকলে এ গ্রামে গড়ে ওঠে রামচরণের লাঠিয়াল দল। সেই সময় শিবপুরের প্রজারা লাঠিয়ালপ্রধান রামচরণের নেতৃত্বে জমিদারের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

শিবপুরবাসী একযোগে রাজার খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়। অবাধ্য প্রজারা তখন খুবই দুর্ধর্ষ ও দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। ফলে কোনোভাবেই যেন জমিদারের লোকেরা বিদ্রোহীদের বাগে আনতে পারছিলেন না। এদিকে খাজনা আদায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজকোষে রাজস্ব আদায়ও কম হচ্ছিল। রাজা রাজবল্লভ তখন উপায়ান্তর না দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন, এখানে কিছু পর্তুগিজ খ্রিষ্টানকে ডেকে আনবেন। তিনি এও ভাবলেন, স্থানীয় প্রজা দমনের জন্য খ্রিষ্টানরাই মোক্ষম হাতিয়ার হবে। কেননা, জাত্যভিমানের লক্ষ্যে বিদেশি ও ভিন জাতির লোকদের সঙ্গে নিছক মেলামেশা করলেই হিন্দু-রায়তরা তাদের শুদ্ধতা ও জাতপাত হারাবে। তা ছাড়া পর্তুগিজরা বন্দুকবাজ- লাঠিয়ালদের লাঠি, সড়কি, রামদা ও দেশি অস্ত্রবাজদের থেকে উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্তও ছিল। ফলে খ্রিষ্টানরা জমিদারের হয়ে কাজ করলে শিবপুরের প্রজা বিদ্রোহের অবসান ঘটবে এবং প্রজারা খুশি মনেই রাজার বাধ্য হবে।

এমন ভাবনা ও পরিকল্পনা মোতাবেক রাজা রাজবল্লভ ব্যান্ডেলের পর্তুগিজ মিশনের কয়েকজন খ্রিস্টভক্ত বণিককে তার পক্ষে এসে কাজ করার আবেদন জানান। রাজার আমন্ত্রণে সম্ভবত ১৭৬০-৬২ খ্রিস্টাব্দে ব্যান্ডেল চার্চের চারজন পর্তুগিজ বণিক এখানে নিজেদের ব্যবসার প্রসার ও প্রজা দমনের উদ্দেশ্যে শিবপুরে আসেন। কিছুদিন পর খ্রিস্টান এই বণিকরা তাদের ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের জন্য রাজার কাছে একজন পাদ্রি আনার অনুমতি প্রার্থনা করে। রাজা একজন পাদ্রিকেও এখানে নিয়ে আসেন। পাদ্রির ভরণপোষণ ও খ্রিস্টের উপাসনাগৃহ নির্মাণে রাজা তখন চারখণ্ড জমিও দান করলেন এবং চার বণিককে সেই হাওলা জমি দেখাশোনার দায়িত্বও দেন। কিন্তু চারজনের মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিরোধ তৈরি হলে রাজা তখন এই হাওলাকে অচিরেই 'পাদ্রি তালুক বা মিশন তালুক' হিসেবে একটি তালুকে রূপান্তরিত করেন এবং পাদ্রি ফ্রে র‌্যাফেল ডাস এঞ্জোসের নামে (১১৭১ বঙ্গাব্দের ৯ ফাল্কগ্দুন) ১৭৬৪ খিষ্টাব্দে তালুকটি ইজারা দান করেন।

একই বছরে পেদ্রো গনসালভেস নামে আরও একজন পাদ্রি এসে কাজ শুরু করেন এবং তার উদ্যোগেই 'পথপ্রদর্শিকা কুমারী মারিয়ার গিজা' নামে এখানকার প্রথম গির্জা নির্মিত হয়। পরে এখানকার বিখ্যাত ধান-চাল ব্যবসায়ী ডোমিঙ্গ ডি সিলভা মৃত্যুর সময় একটি উইলে গির্জাটিকে বড় করার জন্য অর্থ দান করে যান। পিতার ইচ্ছানুযায়ী ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে পুত্র ম্যারেল ডি সিলভা আগের গির্জাটি ভেঙে একই স্থানে দ্বিতীয়বার বড় আকারের একটি গির্জা নির্মাণ করে দেন। এরই মধ্যে ইজারা সম্পর্কিত জটিলতার ক্ষেত্রে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ এপ্রিল 'ইজারাটি রাজা রাজবল্লভ মঞ্জুর করেছেন' বলে সদর দেওয়ানি আদালত একটি রায় দেন। পরে ১৮৯০-৯১ খ্রিষ্টাব্দে মি. থম্পসন মিশনের পক্ষেই এস্টেটের দলিলাদি নবায়ন করে দেন। একই নবায়নে রাজা রাজবল্লভের স্থাবর সম্পত্তি পুত্র পিতাম্বর সেন এবং অন্যান্য উত্তরাধিকারীর মধ্যে ভাগবাটোয়ারার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।

পাদ্রিশিবপুরে আসা যাজকদ্বয় ছিলেন রোমার কাথলিক আগাস্টানিয়ান মংক শ্রেণীভুক্ত। জমিদারের অনুমোদন নিয়ে এরাই এই অঞ্চলে ক্যাথলিকমণ্ডলী ও খ্রিস্টধর্মের প্রচার প্রথম শুরু করেন এবং দক্ষিণ ভারতের মইলাপুর বিশপের পক্ষে হুগলী ব্যান্ডেল চার্চের অধীনে কাজ করতেন। কিন্তু বিপত্তিটা শুরু হয় ১৮ এপ্রিল ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে, পোপ যখন ভিকার অ্যাপোস্টোলিক ড. সেন্ট লেগারকে বাংলার রোমান ক্যাথলিকমণ্ডলী প্রসারের দায়িত্বভার দেন। কেননা ভিকার সেন্ট লেগার তখন হঠাৎ ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পাদ্রিশিবপুরে বেনেডিক্টাইন সংঘের দক্ষিণাঞ্চলীয় কারণিক কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন এবং এখনকার দায়িত্বে থাকা মংক শ্রেণিভুক্ত পাদ্রি ফ্রেজস ডাস নেভেসকে বরখাস্ত করে নিজের মনোনীত ফাদার ইগনাটিয়াস জাভিয়ের মাসকারহ্যানাসকে নিয়োগ দেন। এমনকি খাজনা সংক্রান্ত একটি মামলায় বাকেরগঞ্জ সিভিল কোর্টের ডিসিশন বলে এখানকার সব সম্পত্তির মালিকানাও নিজেদের দখলে নেন।

ফলে এখানকার খ্রিস্টভক্তরা সেই সময় জাভিয়েরের যাজকত্ব মেনে নিয়ে ভিকার লেগারের নেতৃত্বকেই মেনে নিতে বাধ্য হন। এক পর্যায়ে এখানকার স্থানীয় একজনের মৃত্যু হলে 'খ্রিস্ট ধর্মের নিয়মানুযায়ী কনফেসন ছাড়াই ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে'- এ অজুহাতে ফাদার সেই মৃতের সমাধিকৃত্য সম্পন্ন করতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে তখন ফাদার ও স্থানীয়দের সঙ্গে তুমুল বিবাদ বাধে। এই বিবাদের জেরে উত্তেজিতদের ভয়ে ফাদারকে শিবপুর ত্যাগ করতে হয়। তখন বেশ কয়েক বছর গির্জার কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। এই সুযোগে পর্তুগিজ ডাস পাদ্রিরা পুনরায় তাদের গির্জা ও ভূখণ্ডের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাকেরগঞ্জ সিভিল কোর্টে একটি মামলা করেন। বাকেরগঞ্জের সিভিল কোর্টের বিচারক মি. লাফনান ছিলেন এখানকার রোমান ক্যাথলিক সদস্য। তাই তিনি তখন সঠিক বিচারের জন্য মামলাটি ২৪ পরগনার বিচারিক আদালতে প্রেরণ করেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মামলাটির নিষ্পত্তি ঘটে। এদিকে কোর্ট এবং সদর দেওয়ানি আদালত- উভয় বিচারেই আগাস্টানিয়ানরা জয়লাভ করেন। তখনকার এই রায়ে পর্তুগিজরা শুধু তালুকের কর্তৃত্বই নয়; ভিকার লেগারের সময়ে তালুকের অর্জিত সব মুনাফার অর্থও তাদের ফেরত দেওয়ার কথা বলেছেন।

এর পর ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মইলাপুরের বিশপ এবং হুগলীর গোয়া ধর্মপ্রদেশের পাদ্রিরাই একের পর এক এখানে এসে নির্বিঘ্নে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের কাজ করেছেন।

এরই মধ্যে খ্রিষ্টধর্মের প্রাচীন পুণ্য ভূমিখ্যাত চট্টগ্রামকে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে এ দেশের ধর্মপ্রদেশ ঘোষণা করা হয়। তখন পাদ্রিশিবপুর ধর্মপল্লিটিও ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পবিত্র ক্রুশ সংঘের মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত হতে থকে। দেশান্তরকাঠি, কালাদা, মাটিভাঙা এবং পটুয়াখালীর উপকেন্দ্রগুলো এখনও এ ধর্মপল্লির আওতাধীন এবং এখানে আরও রয়েছে স্কুল, চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র, হোম, হোস্টেলসহ বহু উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। ব্রতীয় জীবন গ্রহণের ক্ষেত্রেও এ ধর্মপল্লির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছেলেমেয়ে ফাদার, ব্রাদার, সিস্টার হয়ে দেশ-বিদেশে খ্রিষ্টের গঠন প্রসারণে কাজ করছেন।

এদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের বর্তমান কার্ডিনাল ও আর্চ-বিশপ প্যাট্রিক ডি'রোজারিও, ফাদার বেঞ্জামিন লাবে, ফাদার ফিলিপ ডি'রোজারিও এবং ফাদার যোসেফ গমেজ জীবন। কারণ আধ্যাত্মিক অবদানে এঁদের সুনাম পাদ্রিশিবপুরের মাটিকে সত্যিই গর্বিত করে তোলে। অতিসম্প্রতি ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি পুণ্যদানে বরিশালকে খ্রিষ্টীয় মহিমায় ধর্মপ্রদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই ঐতিহ্যমণ্ডিত পাদ্রিশিবপুর ধর্মপল্লির ভাগ্য এখন 'বরিশাল ডইওসিস'-এর নবনিযুক্ত বিশপের হাতে বর্তেছে।

ধূসর-খয়েরি রঙের আকাশে, পাদ্রি ডাস এঞ্জোসের ঘামে-লোনায় মিশে আছে পাদ্রিশিবপুরের সব অহঙ্কার ও পবিত্রতা।

লেখক : কবি ও লেখক; সম্পাদক, লিটল ম্যাগাজিন,'জীবনানন্দ'