• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২০, ০৫:৪১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ১২, ২০২০, ০৫:৪১ পিএম

হাটন্ত বলাকা

হাটন্ত বলাকা

কবে কীভাবে আমাদের দশ জনকে  ‘হাটন্ত বলাকা’ নামে নামকরণ করা হয়েছিল আজ আর তা মনে নেই, তবে কে করেছিলেন তা এখনও মনে আছে। আমাদের প্রিয় নবী ভাই‘র দেয়া এ নামটির কথা আজও মনে করতে পারি। পিকুর চাচাতো বোন বুলা আপার বন্ধু, ফিলোসফির তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। আমরা সদ্য কলেজ পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে হাঁটতে শুরু করছি। তখন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিষয় ছিল মাত্র চারটি। অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজ কর্ম আর রাষ্ট্র বিজ্ঞান। অর্থনীতির অনেক ঝামেলা। নিয়মিত ক্লাস করতে হয়, অনেকগুলো ক্লাস তারপর আবার অংক। সব মিলিয়ে অনেক সময়,এত সময় তখন আমার কোথায়,তাই ঠিক করলাম সবচেয়ে কম সময় দিতে হবে যে বিষয়ের সেই বিষয়ে ভর্তি হবো।

পাশের বাড়ির অগ্রজ পিটার ভাই তখন সমাজ বিজ্ঞান এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। পারিবারিক ভাবে বন্ধুত্ব থাকায় প্রায় আমাদের বাসায় আসতেন। উনার মুখে শুনতাম  কত সহজে এ বিষয়ে  পাশ করা যায় । পাশপাশি কেয়ার বাংলাদেশের মেয়েরা যখন বাইক নিয়ে ছুটতো তখন মুগ্ধতায় আমি  আপ্লূত হতাম । আর ভাবতে ভালবাসতাম আমিও একদিন ওভাবেই রাজশাহী শহরে বাইক চালাবো। যদিও আম্মা খুব ইচ্ছে করেছিলেন আমি যেন অর্থনীতিতে পড়ালেখা করি । কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে সমাজ বিজ্ঞান প্রথম পছন্দ দিলাম। ভর্তি হয়েও গেলাম।

১৯৯১ এর জুন মাসের ১ তারিখে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু হলো। রাজশাহী কলেজ থেকে আমার বন্ধুদের মধ্যে এ যাত্রায় সাথী হলো অনেকে। তাদের মধ্যে অন্যতম তিথি,লাকি,পিকু , শাম্মী,বাবলী আর শিল্পীসহ আরো অনেকে। এই জন্যই এদের কথা বলছি যে, এরাই পরবর্তীতে হাটন্ত বলাকার অংশ হয়ে গিয়েছিল। সমাজ বিজ্ঞান এর প্রথম বর্ষের মজায় আলাদা। মুল কোর্স দুইটা সাথে সাবসিডিয়ারী হিসেবে যার যার পছন্দ মত আরো দুই টা বিষয়। তাই মুল ক্লাসে একসাথে থাকলেও অন্য ক্লাসগুলোতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাম। ক্লাস শেষ একত্রিত হতাম মমতাজ উদ্দিন আহমেদ কলা ভবনের তিন তলার কমন রুমে। আমরা তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র সরব হয়ে উঠিনি। এই কমন রুমেয় পরিচয় এবং পরবর্তীতে ঘনিষ্টতা স্মৃতি,জয়া ,নাফিসা আর এ্যানির সঙ্গে। আরও অনেকে আমাদের সাথে কমন রুমে আড্ডা দিতো।

তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল রেশমী। যার গানের গলা অসাধারণ। আমরা প্রায় ওর গান শুনতাম। আমাদের জয়া রবীন্দ্র সংগীত গাইতে গাইতে রবীন্দ্র ভক্তে পরিনত করে ফেলেছে আমাদের যা আমি অত্যন্ত এখনও ধারন করে যাচ্ছি। পিকুর গলায় হারানো দিনের গান অন্য মাত্রা যোগ করতো আমাদের আড্ডায়। সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে, সেই সময় গানটি ছিল খুবই জনপ্রিয়। আমিতো একাই বহুবার ওকে বাধ্য করেছিল গানটা করতে। আজ এত দিন পরেও আমরা মন খুলে গলা ছেড়ে সবাই মিলে গেয়ে উঠি। সেখানে বয়স কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারে না! আমাদের বন্ধুত্ব এতটাই নিবিড় এখনও। ভিন্ন পরিবারের , ভিন্ন সামাজিক অবস্থানের বেড়ে উঠা দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ে কখন যেন বিনিসূতায় গাঁথা একটা মালা হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবখানেই বিচরণ করতে লাগলো তা ওরা নিজেরাই বুঝতে পারেনি তখনও।

কখনো প্যারিস রোড, কখনো মেয়েদের হলের পথে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামের পথে চলছে তারা। সমাজ বিজ্ঞান এবং ফিলোসফি এক ভবনে ছিল বলে বুলা আপুদের বন্ধুদের সাথে প্রায় দেখা হতো। আমরা দশ জনই তখন রাজশাহী শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছিলাম। তাই শহর থেকে আসা বাস থেকে নেমে সবাই একত্রিত হলে তারপর আমরা মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের দিকে রওনা দিতাম। এক সাথে মোটামোটি রাস্তা পুরোটা দখল করেই আমরা হাটতাম। ঐ আসছে এক ঝাঁক হাটন্ত বলাকা । শব্দটা আমাদের সবার ভাল লেগে গেল।আমরা লুফে নিলাম। আজও আমরা সেই হাটন্ত বলাকা নামটা ভুলে যায়নি।

আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে আজ তা। আজও আমরা দশজন মিলে যে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ করেছি তার নাম দিয়েছি হাটন্ত বলাকা। জীবন প্রবাহের ফলাফল ,আট জন ঢাকায় আর বাকি দু'জন রাজশাহী আছি। তবুও যখনই সুযোগ হয় আমরা আবারও সব ভুলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ১৮/১৯ বছরের হাটন্ত বলাকায় রুপান্তরিত হয়ে সেই ভালোবাসার মতিহারে বারেবারে ফিরে ফিরে যাই । জীবন জুড়ে জরিয়ে গেছে অনেক দায়িত্ব, ব্যস্ততা এবং দায়বদ্ধতা। তবুও আমাদের মনের মনি কোঠায় উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে আছে ‘হাটন্ত বলাকা’ এবং থেকেও যাবে আজীবন। বলাকারা সবাই খুব খুব ভাল থাকিস..

লেখক: উন্নয়নকর্মী