• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২০, ০৫:১৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ১৩, ২০২০, ০৫:২০ পিএম

 সমালোচকের নিঃসঙ্গতা এবং স্তাবকতার কুফল!

 সমালোচকের নিঃসঙ্গতা এবং স্তাবকতার  কুফল!

যত মত তত পথ-বলে একটি কথা আছে। সেটা বিবেচনায় নিলে মানতে হয় মানুষে মানুষে চিন্তায়, পর্যবেক্ষণে এবং প্রকাশে পার্থক্য থাকেই, যাকে ‘ব্যাক্তিক ইন্টারপ্রিটেশন’ বলা যায়। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে একটি উদাহরণ নেয়া যাক। যেমন ধরুন, একটি গ্লাসে অর্ধেক জল রয়েছে। এরকম একটি সাধারণ ব্যাপারেও একেক জন একেকভাবে ইন্টারপ্রিটেশন দিতে পারে। কেউ বলতে পারে-গ্লাসটি অর্ধেক জলে পূর্ণ, কেউ বলতে পারে-গ্লাসটি অর্ধেকই ফাঁকা, কেউ আবার বলতে পারে-অর্ধেক জল আর অর্ধেক অক্সিজেন, আবার কেউ বলতে পারে-গ্লাসটি অর্ধেক পরিমান বিশুদ্ধ সুপেয় জলে পূর্ণ ইত্যাদি। অর্থাৎ-এই একটি বিষয়কে অনেকভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় অনেকে দু’য়ে-দু’য়ে চার মেলান আবার  অনেকে দু’য়ে-দু’য়ে তিন হয় বলার চেষ্টাও করেন। আবার কেউ একেই পাঁচ বানিয়ে ছাড়েন। আর কারো কাছে এগুলো সবাই অর্থহীন মনে হতে পারে। 

এই যে পার্থক্য যেটাকে ডাইভারসিটি হিসেবে দেখা ভালো সেটা শুধু দৃষ্টিভঙ্গিতেই নয়, পার্থক্য হয় জীবন দর্শনেও। কেউ ভোগবাদী/পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে চলতে দেখলে অসুবিধা মনে করে না আবার কেউ সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পুরো জীবন বিলিয়ে দেন। সমাজ সংসারে প্রতিদিন যতো মানুষের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয় তারা সবাই যে গড্ডলিকায় (ভেঁড়ার পালের মতো) গা ভাসান তা নয়, কেউ কেউ আছেন যারা শুধু আখের গোছাতে তথাকথিত রাজনীতির সস্তা হাটে বিক্রি হয় না। 

এতোক্ষণ যে ভূমিকা হাজির করা হল- তার তাগিদ আসলে পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক কিছু কিছু ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত অনাকাঙ্ক্ষিত  আলোচনা-সমালোচনা। বিষয়টির সূচনা যেভাবেই হোক না কেনো, সেটার প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। এখানে লেখক যে স্কুল অব থট-এর অনুসারি সেখানে তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু বক্তব্য ও তার মানে, তথাকথিত লোক দেখানো সৌজন্যতা সেখানে মূখ্য নয়। বিবাদী চর্চার মধ্যে স্টেরিওটাইপ আচরনিক কম্পায়েন্স দেখতে চায় না যতোটা প্রয়োজন বোধ করে সোজা-সাপটা উত্তর করার ক্ষেত্রে। 

বিবাদীর বক্তব্য, মন্তব্য, চিন্তা হাল জামানায় অধিকাংশের সাথেই মিলবে না। তার প্রধানতম কারন বোধ করি-প্রচলিত সামাজিক আচার, আন্তঃসম্পর্ক, আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ, শ্রেণী বৈষম্য, অবকাঠামো কেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারনা, রাজনীতি, অধিকার, উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা অথবা নারী-পুরুষের সম্পর্ক ইত্যাদির কোনোটির সাথে পুরোপুরি একমত না হতে পারা। উক্তসকল বিষয়ে তার তরফে সুষ্পষ্ট ক্রিটিক আছে। বাপ-দাদার উত্তরাধিকার বা অধস্তনতা, প্রভূ-ভৃত্য‘র সম্পর্ক সে মানে না। সে জীবনের অর্থ ও চিন্তার নতুন নির্মাণ চায়। আর সে জায়গা থেকে  বিবাদীর ব্যক্তিসম্পর্ক, শ্রেণীবৈষম্যের কারন, চলতি আর্ট-কালচার ইত্যাদি সম্পর্কেই তার পজিশন ক্রিটিক্যাল। এটা শুধু সমালোচনার খাতিরে নয়, বিবাদি মনে করে এ ধরণের সমালোচনার প্রয়োজনও রয়েছে। সে মনে করে কোনও বিষয়ে ব্যক্তির অবস্থান ও বক্তব্য তৈরি হয় তার কগনিটিভ সিস্টেম, সাইকোমোটর এবং এটিচ্যুড-এর ধরণের উপর। চিন্তা বা ক্রিয়ার এটা এমন একটি প্রক্রিয়া যা ব্যক্তিমাত্রই সবার ক্ষেত্রে কাজ করে। পার্থক্য তৈরি হয় শুধু ব্যক্তির সোস্যালাইজেশন, তাত্ত্বিক পাঠ এবং চিন্তার দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার উপর।

সমাজ, রাজনীতি, ধর্মনীতি, প্রেম, বিরহ, শিক্ষাপদ্ধতি, অর্থনীতি, শ্রেণীভিত্তিক সমাজ, বৈষম্য, অধিকারহীনতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিগত ৪৪-৪৫ বছরে তার চিন্তাগুলো যে অনেকটাই সুনির্দিষ্ট অবয়ব পেয়েছে তা বলাই বাহুল্য। সে বিশ্বাস করে এগুলো সময়ের সাথে সাথে আরও হয়তো পুষ্ট হবে কিন্তু ভিন্ন হবে না কিছুতেই। যদিও হাল আমলের শিরদাঁড়াহীন সংস্কৃতিতে বিবাদীর আপন চিন্তা-ভাবনা হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া তেমন কেউ পছন্দ করে নাই। চেনা চৌহদ্দির মধ্যে যারা তাদের প্রায় নিরানব্বই শতাংশই তার চিন্তা-ধারাকে অলীক বলে বাতিল করে দিয়েছেন। প্রথাবিরোধী বৈজ্ঞানিক চিন্তার কুঁড়েঘরে সংগীহীন একজন হিসেবে তাকে জানার তেমন তাগিদ এ যুগে কারও থাকার কথাও নয়। তারপরও বিবাদীর স্কুল অব থটস-এর একটি হাইলাইটস নিম্নে দেয়া গেল-

এক. প্রচলিত যে রাজনীতির নামে লুটপাট, দুর্বৃত্তায়ন তার প্রয়োজন অন্য অনেকের কাছে থাকতে পারে কিন্তু বিবাদী সে রাজনীতিকে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম অন্তরায় হিসেবেই জ্ঞান করে। এমন রাজনীতির হয়তো প্রয়োজন আছে তাদের জন্য, যারা জ্ঞানভিত্তিক কর্মসংস্থান জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের জন্য। এই রাজনীতি এমন যা দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন আর ক্ষমতায়নের কথা বলতে বলতে কেবল নিজেরাই ধনী হয়! দরিদ্র মানুষ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যায়। এ রাজনীতির শ্লোগান ‘দারিদ্র দূরীকরণ’  একটি জনতুষ্টিবাদী শ্লোগান ছাড়া আর কিছুই নয়। এর ধ্বজাধারীরা যে কোনো মূল্যে শুধু ক্ষমতায় যেতে চায়। তারা মসনদ আঁকড়ে রাখতে নীতি-নৈতিকতা, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, বহুদলীয় রাজনীতি, ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করে দেয়। শুধু তাই নয়, এ রাজনীতির ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট রাষ্ট্রের সকল সুবিধা, সম্পদ নির্লজ্জভাবে ভোগ করতে থাকে। যারা এ ধারার রাজনৈতিক দলের বা আদর্শের উত্তরাধিকার তাদের প্রতি ন্যুনতম শ্রদ্ধা বিবাদীর কাছে নেই। 

দুই. সমাজের উপরিকাঠামো আজ রাজনীতিরই বাইপ্রডাক্ট (অনেকেই তর্কের খাতিরে বলতে পারেন, না, সমাজই বেসিক স্ট্রাকচার) অর্থাৎ, রাজনীতিই সমাজের বিধি-বিধান তথা মূল্যবোধ তৈরি করছে। রাজনীতিতে পদায়ন, ক্ষমতা প্রদর্শন, সুবিধা বা লাভালাভ, নতুন চাটুকার শ্রেণী তৈরি এবং তাদের আর্থিক উল্মম্ফন এগুলোই শেষ বিচারে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তথাকথিত রাজনৈতিক পেশীশক্তি ঠিক করে দিচ্ছে সমাজের আচরণ। দু’একটি উদাহরণ নেয়া যাক। যেমন-সমাজ বা রাজনীতি কোথাও প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষকের মর্যাদা যদি দেয়া হতো তাহলে নতুন প্রজন্ম শিক্ষক হতে আগ্রহী হতো । কিন্তু কোথাও সেটা হয়নি বলে কেউ আর জান থাকতে শিক্ষক হতে চায় না। সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোই নির্ধারণ করছে -কার চাকুরি হবে, কার বদলী হবে, কে ঠিকাদারী পাবে, কে জলাশয় লীজ পাবে, সেফটিনেটের সুবিধাভোগী কারা হবে, কারা কাবিখা-টিআর- এর বাটোয়ারা পাবে সব, সব।

 অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের গ্রাম পর্যায়ের যে কোনো পদধারীও উষ্ণ সম্বর্ধনা পাচ্ছে। তার মানে, ক্ষমতার রাজনীতি দলীয় যে কোনও পদ প্রাপ্তিকে এতো আকর্ষণীয় আর মহার্ঘ্য করে তুলেছে যে সবাই যে কোনও মূল্যে ঐ পদই পেতে চাচ্ছে। কিছুদিন আগে পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়ের এক ভিসি পর্যন্তও স্বপদ ছেড়ে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আজ শিক্ষকের আদর্শ পেশা ছেড়ে অনেকেই নির্বাচন করছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসিও একটা সময় চলতি দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে উপ-নির্বাচন করে সংসদে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এ সকল উদাহরণ প্রমান করে, ক্ষমতার রাজনীতিকে কতোটা আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে যে মানুষ দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে পঙ্কপালের মতো শুধু ছুটছে ঐ জনবিরোধী রাজনীতির পানে। এমন ভোগবাদী সমাজ ও রাজনীতির পুরোভাগে থাকা নেতা/নেত্রীদের বর্ণাঢ্য জীবনের উপর যারা মানপত্র রচনা করেন, পাল্টি খাওয়া নীতিহীন রাজনীতিকরদের প্রশংসায় যারা পঞ্চমূখ হন তাদের জন্য করুনা আর কিছুই হয় না তার।

তিন. অর্থনীতি মানে তো এখন শুধু টাকা! অথচ অর্থনীতি হলো-সমাজ ও রাজনীতির অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তার বিকাশের রোডম্যাপ। শুধু টাকা মানে তো -ফাইনেন্স? অর্থনীতি মানে-মানুষ, তার সম্পদ, সামাজিক পুঁজি, সম্পর্ক, সুনাম, মর্যাদাপূর্ণ জীবিকায়ন, আর্থিক ব্যবস্থাপনার ইনোভেশন ইত্যাদি। আমরা যাকে অর্থনীতি বলছি সেখানে ঐ সকল উপাদানের উপস্থিতি কোথায়? অর্থনীতি বলতে এখন শুধু টাকা, টাকা আর টাকা। টাকা দিয়ে কি সবকিছু হয়? 

টাকা তো একটি বিনিময় মাধ্যম/কাগুজি মুদ্রা মাত্র। টাকার অর্থ তো মানুষের মর্যাদায়, অধিকারে, নিরাপত্তায়, নিশ্চয়তায় আর বিশ্বস্ততায়-এই অর্থনীতিতে তার কোনো মিনিংফুল অস্তিত্ব নেই? আজ মানুষের ঘামের টাকায় গড়ে ওঠা রাজস্ব দিয়ে পোষা হচ্ছে-বিশাল আমলাতন্ত্র যাদের সম্পর্কে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ অতি পুরোনো। সেই টাকা রাতের আধাঁরে পাঁচার হয়ে যাচ্ছে ভীনদেশে, কেন্দ্রিয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি মিলিয়ন ডলার, আজ ব্যাংক ডাকাত-ভূমিদস্যু তারাই সবক্ষেত্রে দন্ডমুন্ডের কর্তা? কিসের উন্নয়ন আর অর্থনীতির বড়াই করা হচ্ছে তবে?

 চার. শিক্ষা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার আদর্শ-উদ্দেশের জায়গায় আর নেই। কেন নেই,, কিভাবে নেই-তারও হাজারটা উদারহণ দেয়া যাবে। ভর্তিবাণিজ্য, কোচিং, ঠিকাদারী কারবারী, শিক্ষার্থী নির্যাতন, চটকদারী রেজাল্ট ইত্যাদির সুতিকাগারে পরিনত হয়েছে বহুধাবিভক্ত শিক্ষাধারা আর প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বিশ-ত্রিশ বছরে দেশে অন্তত পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম করা যাবে না যারা শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছে? অধিকাংশ শিক্ষক আজ রাজনীতির দাস। দলীয় আনুকূল্য পেতে তাদের সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নয়, কাটে পার্টির কাজে, নেতা তোষণে। বিবাদী তাই-একজন শিক্ষককে আর দেখতে পায় না কারন সে তো আর শিক্ষক নেই, পরিনত হয়েছে দলদাসে! 

পাঁচ. সমাজ সম্পর্ক, সংস্কৃতি এবং বিবিধ কয়েকটি বিষয়ে কথা বলতে ‘‘ডেমনোন্সষ্ট্রেশন ইফেক্ট “ বলে ইকোনোমিক্সে যে কথাটি চালু আছে সেটি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। এটির ব্যাখ্যা হল-যখন একজন মানুষ অন্যের বৈষয়িক-মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক-রাজনৈতিক আচরণ দ্বারা যুক্তিহীনভাবে প্রভাবিত হয় তখন সেটা আর তার আচরণ থাকে না, সেটা আসলে হয়ে যায় ডেমোন্সস্ট্রেশন ইফেক্ট। যেমন-কেউ কাউকে কোনো বিলাস দ্রব্য বা সেবা ব্যবহার করতে দেখে প্রভাবিত হলেন এবং সেই একই পণ্য বা সেবা সংগ্রহ করতে মরিয়া হয়ে ক্রয় করলেন। এভাবে তাকে দেখে তার পাশের বাড়ির বা ফ্ল্যাটের এবং এভাবে সবার ঘরে ঘরে একই রোগ ছড়িয়ে পড়ল, যাকে মোটাদাকে-ডেমোন্সস্ট্রেশন ইফেক্ট-এর উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় । 

এটা শুধু পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রেই হবে এমন নয়, এটা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রেই বাড়তি প্রাপ্তি বা সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে আরও কিছু উদাহরণ নিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। যেমন-রাজনীতি করে যখন কেউ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয় তখন সেটা আরও অসংখ্য মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। তারাও তখন একইভাবে রাজনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করে ফায়দা লুটতে তৎপর হয় যেখানে খুব স্বাভাকি কারনেই আদর্শের কোনও বালাই থাকে না।

 তেমনিভাবে, দূর্নীতিগ্রস্থ কোনো আমলা বা কর্মচারীর কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে বা নারী নির্যাতনকারী কোনো পাষন্ডের বিচার না হলে বা সড়ক দূর্ঘটনায় মানুষ মারলেও চালকের কোনো শাস্তি না হলে-উক্ত প্রতিটি ঘটনার ক্রমবর্ধমান পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়। তাই কোনও একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সমাজ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটার ম্যারিট বা যৌক্তিকতা ঐ সমাজের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে বিবাদীর বক্তব্য হলো-চোর কে চোর বলা এবং চোরকে চোর না বলে সাধু বা তথাকথিত নিরপেক্ষ থাকার ভান করা একটি কৌশলী আচরণ যা প্রকারান্তরে একটি সফিসটিকেটেড অন্যায়ও বটে।

ভার্চুয়াল তথা সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তি মানুষের আরও একটি আচরণ ইদানিং হামেশাই প্রকাশ্যে আসছে। যার নাম দেয়া যেতে পারে - স্থাবকতা, টার্গেটেড স্তুতি, ধান্দাবাজি যেখানে প্রশংসাবাচক শব্দের বিপুল অপচয় হচ্ছে। সেটা কেমন? যেমন-প্রায় প্রতিদিন একাধিক বন্ধুর ( সোস্যাল মিডিয়ায় আবার বন্ধুত্ব হয় নাকি?) জন্মদিনে উইশ করা, কারও সন্তানের, স্বামীর বা স্ত্রী’র অনুল্লেখ্য সফলতা, প্রমোশন, ট্রান্সফার, বিলাত গমন, বিবাহ, বিচ্ছেদ, ঝগড়া, অর্থহীন কবিতা, পুরোনো দিনের ছবি, শর্ষেক্ষেতে মুখ বাঁকিয়ে ছবির পোজ ইত্যাদি হাজারটি বিষয়ে নেটিজেনদের যে উদার, পরোপোকারী, বন্ধুবৎসল, শুভাকাঙ্ক্ষী-শুভানুধ্যায়ির ন্যায় আচরণ সেটা অনেক দিক থেকেই মেকি এবং অসুন্দর! কারন, প্রশংসা এমন একটি উচ্চমার্গীয় মনস্তত্ত্ব যেখানে একটি অক্ষর বা বাক্যের হেরফের হলেই যার পুরো অর্থ ভিন্ন হয়। ধরা পড়ে নেপথ্য ধান্দাবাজিটাও । প্রশ্ন আসতে পারে, প্রশংসায় অসুবিধা কী? কেউ যদি আরেক জনের প্রশংসা বা সফলতায় ভাগ নিতে চায় তাহলে লাভ ছাড়া ক্ষতি থাকার কথা তো নয়, তাই এটাতে সমালোচনা কেন?

কারন আছে, বিস্তর ক্ষতিও আছে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি বিশেষ দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। সেটা হলো-মানুষের বিয়িং। একজন মানুষের (আসল) জন্মকালীন পরিচয় সময়ের সাথে সাথে সামাজিক-রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক আঘাত/আস্তরণ দ্বারা পরিবর্তিত অথবা ঢাকা পড়ে। আর এভাবে ব্যক্তির অরিজিনালিটি অনেকটাই হারিয়ে যায়। এভাবে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্বটিই (বা দৃষ্টিভঙ্গি) হয় তার বিয়িং বা রূপান্তরিত রূপ। মনোবিজ্ঞানী বা এর গবেষকগণ সে কারনে মানুষের কোনো আচরণকে বোঝার ক্ষেত্রে কৃত আচরণের নির্মোহ বিশ্লেষণ করার তাগিদ দিয়েছেন।

 কারন, মানুষের কোনও আচরণই উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ হতে পারে না। নির্দিষ্ট কোনো আচরণের পশ্চাতে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিহিত থাকবেই। ফলে, এটা বলার কোনো উপায় নেই যে, মানুষ সাদামনে বা কোনও কারন ছাড়া কাজ করে। এক্ষেত্রে প্রচলিত একটি ধারণা এমন যে- যখন কোনও ব্যক্তি সবার নিকট জনপ্রিয় হতে চান তখন বুঝতে হবে সে অনেকের সাথে বা অনেক বিষয়ের সাথে আপোষ করছেন। না হলে, এতো এতো মানুষের সবার স্বার্থের অনুকূরে তার আচরণ সঠিক হতে পারে না।

একটি সঠিক তথ্য, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা, অবস্থান বা মন্তব্য কখনই সবার স্বার্থের অনুকূলে যাবে না, সবার পছন্দও হবে না। তাই যারা সমালোচক-তারা চিরকাল অজনপ্রিয়। শুধু অজনপ্রিয়ই হন তাই নয়, তারা ক্ষেত্র বিশেষে ধীকৃতও হন। ইতিহাসে তার হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে- গ্যালিলিও গ্যালিলি’র কথা বলা যায়। তিনি যখন ‘পৃথিবী-ই সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে’- এ তত্ত্ব দিলেন তখন মানুষ তাঁকে স্ট্রেইট পাগল বলে সাব্যস্থ করে বিচারের দাবী তুলেছিল। আরজ আলী মাতুব্বরের গবেষণামূলক বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হাজির হলে -তাঁকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়, বেগম রোকেয়া, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, মাষ্টার দা, চন্ডিদাস সবাইকে প্রথা ভাঙ্গা বা প্রচলিত বিশ্বাসে আঘাত করার দোষে দোষী সাব্যস্থ করা হয়। তাই, সমালোচনা-এমন একটি বিষয় যেটি সমাজকে আঘাত করে, অচালায়তনকে ভাঙ্গতে চায় কিন্তু তার বিপক্ষে অবৈজ্ঞানিক আর স্বার্থান্বেষী মহলের প্রতিরোধও প্রবল। মার্ক্সসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মূলকথাও ছিল তাই। অর্থাৎ, কোনও চলমান ব্যবস্থার বা পরিস্থিতির পরিবর্তন দ্বান্দ্বিক আণরন ছাড়া অপরিবর্তিত রূপে একইভাবে চলতেই থাকে। বস্তু বা এককের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ দ্বন্দ্বই তার পরিবর্তন সাধন করতে পারে।

দেশে বা সমাজে এ মূহুর্তে শত শত সমস্যা রয়েছে। মাদকের ব্যবহার, নারী নির্যাতন, নারীর পোষাকের প্রতি পুরুষাধিপত্য আরোপ, ক্রিড়া শিক্ষার অভাব, শিক্ষার মানে অধপতন, একদলীয় শাসন, কতিপয় মানুষের ঈশ্বরের সমান শক্তিশালী হওয়া, বহুত্ববাদের কন্ঠরোধ, সুকুমার বৃত্তির চর্চাহীনতা এবং জ্ঞানভিত্তিক সংস্কৃতির জায়গায় ধর্মান্ধ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সেগুলো নিয়ে কোনও কথা নেই? বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকোচন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকা, দরিদ্র কৃষকের ভূমি কেড়ে নিয়ে বিলাসী বাগান-খামার গড়ে তোলা, নির্বিচারে পাথর উত্তোলন প্রতিরোধে কোনো ব্যক্তিক বা সামষ্টিক উদ্যোগের কোনও দেখা নেই? সাংষ্কৃতিক সংগঠনে গড়ে তোলা আর যুবসমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্ল্যাটফরম তৈরির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখছে কয়জন? অতি প্রয়োজনীয় এ সকল বিষয়ে লিখতে কারও হাত চলে না কেনো? স্তাবকতার সংস্কৃতি, ভাঁড়ামো আর বালিতে মাথা ঢুকিয়ে যারা সমাজের প্রধান প্রধান রোগগুলোকে সনাক্ত না করলে সমাজের স্বাস্থ্য স্থায়ীভাবে (ভেঙ্গে পড়েনি কি?) অচিরেই ভেঙ্গে পড়বে, যা হবে দূরারোগ্য।
 
কে এমপি, কে মন্ত্রী, কে চেয়ারম্যান, কে বা মেম্বার, কে কতো টাকার মালিক- এগুলো সভ্যসমাজের সূচক হতে পারে না। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন আর ক্ষমতার দাপট যাদের অস্তিত্বের মূলপুঁজি তাদেরকে ধর্তব্যে নেয়ারও তো কিছু নেই। আজকে ভালো মানুষগুলো নিরব আর তফাতে থাকার কারনেই দুর্বৃত্তরা চালকের আসনে জায়গা করে নিয়েছে। সমাজের সুস্থ বিকাশ আর জ্ঞানভিত্তিক প্রগতির জন্য অর্থহীন প্রশংসা আর স্তাবকতা নয়-চাই সমালোচনা। আর সে সমালোচনা হবে হবে বস্তুনিষ্ঠ, ধারালো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যা হবে খাড়া, কোনওয়ালা, ন্যুরালজিয়ার ব্যাথার মতো তীব্র আর গথিক স্থাপত্য রীতির মতো। সমালোচককে একদিকে যেমন চিহ্নিত করতে হবে- কে মানুষের বন্ধু তেমনি অন্যদিকে কৃষক-শ্রমিকের শোষক তাদেরকেও। আর সেটা করতে গেলে ছাড়তে হবে তথাকথিত জনপ্রিয়তা পাওয়ার সস্তা চালাকি।

লেখক : অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন সন্ধানী