• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২০, ০৭:০১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ১৬, ২০২০, ০৭:০৬ পিএম

বাস্তবতা ও ঐক্যের প্রতীক কমরেড অমল সেন

বাস্তবতা ও ঐক্যের প্রতীক কমরেড অমল সেন

সতেরই জানুয়ারি উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত, তে-ভাগা কৃষক আন্দোলনের নেতা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রয়াত সভাপতি কমরেড অমল সেনের সতেরতম মৃত্যুবার্ষিকী। উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন কখনই সোজা পথে চলে নাই। তাকে যেমন দেশি-বিদেশী শাসক গোষ্ঠীর চরম নিপীড়নকে মোকাবিলা করে এগুতে হয়েছে, তেমনি সেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে নানা ধরনের বিভ্রান্তি, বিভাজন-বিভক্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। ব্রিটিশের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করলেও, শত শহীদের রক্তে তার লাল পতাকা সিঞ্চিত হলেও, ঐ স্বাধীনতার প্রাক-মুহূর্তের লড়াই-সংগ্রামকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষিত ‘জনযুদ্ধ’ রাজনীতি কংগ্রেসী প্রচার ও সে সময়ের  বাস্তবতায় ঐ কমিউনিস্টদের পরিচিত করেছে ‘ইংরেজদের দালাল’ বলে। উপমহাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে তাদের অবদানকে আজও অস্বীকার করার চেষ্টা চলে।

আবার উপমহাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৪৮ সালে রণদীভের দেয়া ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, সাচ্চা আজাদী ছিনকে লও’ বলে সশস্ত্র বিপ্লবে আহ্বান ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশের কমিউনিস্টদের চরম নিপিড়নের মুখে ঠেলে দেয় নাই কেবল, তাদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।

তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা অমল সেন

ঐ ‘জনযুদ্ধে’র যুগেই কমরেড অমল সেন পার্টির ঐ নীতির প্রকাশ্য বিরোধীতা না করেও পার্টির সিদ্ধান্তে পরিচালিত তে-ভাগা কৃষক আন্দোলনকে নিয়ে গেছেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্যে। গড়ে তুলেছেন কৃষকের মুক্তাঞ্চল, তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও দাঙ্গার রাজনীতিতে ঠেকিয়েছেন ঐ আন্দোলনের দ্বারা। যে কয়জন হাতে গোনা কমরেড রণদীভের ঐ লাইনের সাথে একমত হন নাই, কমরেড অমল সেন ছিলেন সেই ব্যতিক্রমীদের একজন।
 
আবার বাংলাদেশের সেই কমিউনিস্টরা যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মস্কো-পিকিং বিতর্ক-বিভাজনে অবতীর্ণ হয়েছে, হয় মস্কো, না হয় পিকিং-এ ধরণের অন্ধত্ব তাদের গ্রাস করেছে, সে সময় কমরেড অমল সেন চীনা নীতির সমর্থক হয়েও অন্ধ আনুগত্যের ভ্রান্তিতে ভোগেননি। এ কারণেই ভারতের নক্সালবাড়ী কৃষক আন্দোলনের প্রতি চীনের সমর্থনের কারণে পিকিং পন্থী কমিউনিস্ট পার্টি নক্সালপন্থাকে যখন তাদের মত ও পথ হিসাবে নির্ণয় করেছে তখন তিনি তার থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছেন। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐ বামহঠকারীরা যখন ‘দুই কুকুরের কামড়াকামাড়ি’ তত্ত্বে আত্মবিনাশী পথ নিয়েছে কমরেড অমল সেন তখন প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেও যে কজন সমমতের কমরেডদের পেয়েছেন তাদের ‘কমিউনিস্ট সংহতি’তে একত্র করে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির’ যে তরুণরা ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন তাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন- ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি’। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগের সন্দেহ, বিরূপতার মুখে দাঁড়িয়ে প্রবাসী সরকারের প্রতিই সমর্থন জানিয়েছেন। পাশাপাশি নিজেদের ভিত্তিতে দেশের চৌদ্দটি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি গড়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থী ধারাকে এগিয়ে নিয়েছেন। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এবার তিনি হাত দিয়েছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে। গড়ে তুলেছেন ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’ (লেনিনবাদী)। এবার তিনি স্থানীয় রাজনীতির জায়গা থেকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে মনোযোগী হয়েছেন।  হয়েছিলেন ঐ পার্টির সাধারণ সম্পাদক। একই সঙ্গে সর্বত প্রচেষ্টা নিয়েছেন নক্সালপন্থায় বিভ্রান্ত্র কমরেডদের কমিউনিস্ট  আন্দোলনের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে। 

তবে নতুন এই বাংলাদেশে পার্টি গড়ে তোলার কাজটি সহজ ছিল না। একদিকে কমিউনিস্টদের মস্কোপন্থী অংশের নিঃশর্তে শাসক দলকে সমর্থন এবং সর্বশেষ ‘বাকশালে বিলুপ্ত হওয়া, অপরদিকে পিকিংপন্থী অংশের বাম-হঠকারীতার রেশ এসব মিলিয়ে বাংলাদেশ পরবর্তীতে এদেশের কমিউনিস্টরা জনগণের সামনে কোন বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। পচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর বরং ঐ ধারার অনুসরণে মস্কোপন্থীরা জিয়ার ‘খাল কাটতে’ গেছেন। পিকিংপন্থীদের বড় অংশ বিলীন হয়েছেন জিয়ার জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট, পরে বিএনপি-তে।

কমরেড অমল সেন এর বিপরীতে তার লেনিনবাদী পার্টির নাম ওয়ার্কার্স পার্টিতে পরিবর্তন করে জিয়া-এরশাদ সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সূচনা করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)-এর নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলন। সম্মিলিত কৃষক সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ভূমি সংস্কারের আন্দোলন। 

তবে বিভ্রান্তি-বিভাজন কমরেড অমল সেনের পিছু ছাড়ে নাই। তিনিও তার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। মধ্য পঁচাশিতে ওয়ার্কার্স পার্টি ভেঙেছে। সামরিক শাসনের অধীন নির্বাচন করা নিয়ে ভেঙ্গেছে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের ঐক্য। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান বিজয়ী হলে বাম-কমিউনিস্টদের প্রায় সকলকেই আবারও ঐক্যবদ্ধ করেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে। আমৃত্যু ছিলেন তার সভাপতি।

২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি কৃষকনেতা অমল সেনের মৃত্যুর পর কমরেডদের শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন আজও মস্কোপন্থা-পিকিংপন্থার রেশ ধরে বিভাজন-বিভক্তি, বাস্তবতাহীনতার ধারা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এর ফলশ্রুতিতে বামপন্থা জনগণের কাছে কিছুটা হলেও অপাংক্তেয়। কমিউনিস্টরা নিজেরা গোষ্ঠীতে বিভক্ত। তার বিপরীতে অমল সেন তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে পথ অনুসরণ করে গেছেন তা ঐক্যের ও বাস্তবভিত্তিক রাজনীতির। আর তার ঐ আদর্শনিষ্ঠ পথ অনুসরণের ভিত্তি সব সময় থেকেছে মার্কসবাদী- লেনিনবাদী নীতির অনুসরণ। 

ব্যক্তিজীবনে নির্লোভ, সাদামাটা জীবনযাপনের অনুসারী অমল সেন ছিলেন সকল অহমবোধের উপরে একজন বিনয়ী শিক্ষক যার শিক্ষার দেখা মিলবে তার লেখার মধ্যে। ‘এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা’, ‘বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে’ ‘কমিউনিস্ট আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে’, ‘কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণরীতি প্রসঙ্গে’ এবং সর্ব্বোপরি ‘জনগণের বিকল্প শক্তি’ প্রভৃতি লেখায় কমরেড অমল সেন এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পথদিশা দিয়ে গেছেন। 

এদেশের কৃষকের সবচেয়ে কাছের মানুষ, তে-ভাগা সংগ্রামী ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এই বীরকে তাই স্মরণ করব একজন বাস্তবভিত্তিক কমিউনিস্ট হিসেবে যিনি এদেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থী আন্দোলনকে ডান ও বাম সংকীর্ণতার হাত থেকে রক্ষা করে সংগ্রাম, আন্দেলন ও ঐক্যের মূল ধারায় রাখতে চেয়েছিলেন। কমরেড অমল সেন যুগ যুগ জিয়ো। 

লেখক : সভাপতি,বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি