• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২০, ১১:১২ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০, ০২:২৫ পিএম

বিশ্ব বেতার দিবস 

প্রযুক্তি নির্ভর সমাজেও অনন্তকাল টিকে থাকবে বেতার 

প্রযুক্তি নির্ভর সমাজেও অনন্তকাল টিকে থাকবে বেতার 

তারবিহীন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো বেতার বা রেডিও।সবচেয়ে প্রাচীন, সহজলভ্য ও একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে বেতার পৃথিবীব্যাপী বহুল ব্যবহৃত একটি যন্ত্র। বেতারে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্য প্রেরণ বা গ্রহণ করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষলগ্নে অনেক দেশের একাধিক বিজ্ঞানী প্রায় একই সময়ে বেতার আবিষ্কার করলেও ১৮৯৮ সালে ২৪ বছর বয়সে ইতালিয়ান তরুণ বিজ্ঞানী গুইলিইমো মার্কোনি বিশ্বে প্রথম রেডিও আবিষ্কার এবং তার বাণিজ্যিক সার্ভিস চালু করেন। 

১৯২০ সালে আমেরিকাতে সর্বপ্রথম বেতার সম্প্রচার হয়। বর্তমানে সর্বত্রই বেতার প্রযুক্তির ব্যবহার চলছে। রেডিও (বেতার), টেলিভিশন (দূরদর্শন), মোবাইল ফোন, ইত্যাদিসহ তারবিহীন যেকোনো যোগাযোগের মূলনীতিই হলো বেতার। এমনকি বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে মহাকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয় বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা রেডিও টেলিস্কোপ।

শক্তিশালী এই গণমাধ্যমের গুরুত্ব অনুধাবণ করে ইউনেস্কো ২০১২ সালে প্রথম ‘বিশ্ব বেতার দিবস পালনের ধারণা দেয়। এরপর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় দিবসটিকে বিশ্বব্যাপী পালনের লক্ষ্যে ‘বিশ্ব বেতার দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১২ সাল থেকেই নিয়মিত ১৩ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে ‘বিশ্ব বেতার দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। এ বছরওবিপুল উৎসাহ উদ্দিপনার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো “বেতার ও বৈচিত্র্য (Radio and Diversity).”এই প্রতিপাদ্যে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে বেতারকে সকলের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স, পেশা নির্বিশেষে সকলের জন্য উপযোগী বেতার অনুষ্ঠান পরিকল্পনার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবারের বিশ্ব বেতার দিবসে। এতে শক্তিশালী এই গণমাধ্যমটির আগামী দিনের পথচলা আরো মসৃণ হবে। 

ইউনেস্কোর মহাপরিচালক আদ্রে আজলে বিশ্ব বেতার দিবস উপলক্ষ্যে তার বার্তায় বলেছেন, আমরা রেডিওর শক্তি ব্যবহার করে, সকল ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান এবং চিন্তার প্রতিফলন ও উন্নয়ন ঘটাতে চাই।

প্রবল প্রযুক্তি নির্ভর এই সমাজেও বেতার তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। সহজলভ্যতা এবং বহনযোগ্যতার কারনেই বিশ্বব্যাপী বেতার সগৌরবে টিকে আছে এবং থাকবেও অনন্তকাল। ইন্টারনেট লাইভ স্ট্রিমিং এবং ফেসবুক, ইউটিউব অডিও, ভিডিও লাইভ শোনার ও দেখার সুবিধা থাকায় সব শ্রেণির শ্রোতার কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে আজকের বেতার। 

বাংলাদেশে বেতার বলতে সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত বাংলাদেশ বেতারকেই বোঝানো হতো। কিন্তু ২০০৭ সাল থেকে বেসরকারি উদ্যোগে প্রাইভেট এফএম রেডিও (২৭টি) এবং কমিউনিটি রেডিও (১৯টি) স্টেশনগুলো চালু হলে এদেশে বেতার ভিন্ন মাত্রা পেতে শুরু করে। বর্তমানে প্রায় ২৭টি বেসরকারি এফএম স্টেশন রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র গুটিকয়েক চ্যানেল ঢাকার বাইরে প্রায় সবগুলো বিভাগীয় শহরে এদের সম্প্রচার বিস্তৃত করেছে।

ইনফোটেইনমেন্টের পাশাপাশি খুব সম্প্রতি ৩-৪ টি বেসরকারি এফএম স্টেশন নিয়মিত বাংলাদেশ দল সম্পৃক্ত ক্রিকেট ম্যাচগুলোর ধারাভাষ্যও সম্প্রচার করছে। সুতরাং বেতার এবং ক্রীড়া একটি নতুন সম্ভাবনা। একে সঠিক দিক-নির্দেশনায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে আগামীতে এ ক্ষেত্রটি সমৃদ্ধ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। 

বিশ্ব বেতার দিবস ২০২০- এ ইউনেস্কো রেডিও স্টেশনগুলোকে তাদের অনুষ্ঠান নির্মাণ, পরিকল্পনা এবং সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা বজায় রাখার আহবান জানিয়েছেন। বিশেষ করে নিউজরুমে এবং এয়ারওয়েভসে (সম্প্রচার ফ্রিকোয়েন্সিতে) বৈচিত্র্যতা ধরতে রাখতে অনুরোধ করেছেন। এবারের প্রতিপাদ্যে নিচের তিনটি বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। 

বেতারের অনুষ্ঠান সকলের জন্য অংশগ্রহণমূলক করা

বেতার সবসময় সবখানে সকলের জন্য এই স্লোগানটি মনে রেখে, সব শ্রেণি/পেশার শহর/মফস্বলের সকল স্থানের শিল্পী/পাফরমারকে সমান গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সব ধরণের শ্রোতার কথা চিন্তা করেই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করতে হবে এবং সকলের অংশগ্রহণমূলক মনোভাব এক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্ব বহন করে।  

রেডিও সংবাদকক্ষে প্রতিনিধিত্বমূলক মনোভাবকে উদ্বুদ্ধ করা

বেতারের সংবাদকক্ষে সমাজের সব শ্রেণি এবং গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এখানে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সকল গ্রুপের সবার তথ্য চাহিদা এবং পছন্দের প্রতি সমান গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদকক্ষের বৈচিত্র্যতা নিশ্চিত করতে পারলে সকল শ্রোতার চাহিদা এবং প্রয়োজনমাফিক সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশন করা যায়, যা সমাজে ঐ রেডিও স্টেশনের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা, গল্প, বিষয় পুরো অনুষ্ঠানে আনবে ভিন্নতা এবং বৈচিত্র্য যা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম।  আর তখনই বেতার শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে তার শ্রোতাদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

সম্পাদকীয় সামগ্রী এবং অনুষ্ঠান নির্মানে বৈচিত্র্যতাকে অগ্রাধিকার দেয়া

আমরা জানি প্রতিটি গনমাধ্যমের নিজস্ব চিন্তা এবং ধ্যানধারণা থাকে। সম্পাদকীয় সামগ্রীগুলোর মধ্যে তাঁরা তার প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু বিশ্ব বেতার দিবসের এবারের থিম অনুযায়ি বৈচিত্র্যতা নিশ্চিত করতেই হবে। হোক সেটা সম্পাদকীয় ম্যাটার কিম্বা সাধারণ ইনফোটেইনমেন্ট অনুষ্ঠান সর্বত্রই বৈচিত্র্যতা আনতে হবে এবং সকলের চিন্তা ও চাহিদার প্রতিফলন ঘটাতে হবে কন্টেন্টের মাধ্যমে।   

বেতার ও বৈচিত্র্যতা প্রতিপাদ্য বিষয়টি শুধু কন্টেন্ট বা সম্পাদকীয় আইটেমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়, বরং বেতার সম্প্রচার ফ্রিকোয়েন্সি এবং সম্প্রচার প্রযুক্তির বৈচিত্র্যতার উপরেও সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন- ডিজিটাল অডিও ব্রডকাষ্টিং (ড্যাব)- এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বেতার স্টেশনগুলো তাদের অনুষ্ঠানমালা ডিজিটাল প্লাটফর্মে সম্প্রচারের প্রতি আরো মনোযোগী হবে এবং গুরুত্ব দেবে। কারণ বর্তমান প্রজন্ম ইন্টারনেট ভিত্তিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেই তাদের আনাগোনা বেশি। সুতরাং এই শ্রোতা গ্রুপটিকে টার্গেট করেও বেশ কিছু সমসাময়িক কন্টেন্ট ডেভেলপ করা যেতে পারে, যা এই ডিজিটাল প্রজন্মকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতে পারে। আর এভাবেই বেতার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শ্রোতা ধরে রাখার কাজটি কতে পারে। ড্যাব রেডিও প্রযুক্তি একই সঙ্গে নানারকমের সুবিধা দেয়, যেমন- বাড়তি তথ্য, লাইভ দেখা ও শোনার সুযোগ, অনুষ্ঠান রেকর্ড করার সুযোগ, ইচ্ছেমতো গান শোনার সুযোগ, চাইলে পজ বাটন চাপ দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার সুবিধা মতো শুনতে পারে পছন্দের অনুষ্ঠান। ফলে ড্যাব প্রযুক্তিতে রেডিও শোনায় ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। যা প্রচলিত এএম বা এফএম রেডিওতে পাওয়া যায় না। 

বেতার মাধ্যমে যেহেতু অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচার খরচ অপেক্ষাকৃত কম, তাই চারপাশের অজস্র বিষয়ের মধ্য থেকে সমসাময়িক, জনগুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় বিষয়টি বেছে নিয়ে একাধিক রিপোর্ট, ডকুমেন্টারি, টক-শো, বিতর্ক অনুষ্ঠান নির্মাণ করা যেতে পারে। আর এই অনুষ্ঠানগুলো ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে একাধিক ভাষায় সম্প্রচারের ফলে খুব দ্রুত একটি বেতার অনুষ্ঠান দেশে বিদেশে মুহূর্তেই সাড়া জাগাতে পারে। এ জাতীয় ধারণা সকলের অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সক্ষম। 

বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহৎ গণমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ বেতার অধিক সমাদৃত। দেশব্যাপী সমগ্র শ্রোতাদের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ নানা রকমের বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করলেও ক্রীড়া ধারাভাষ্য সম্প্রচার বেতারের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রোতানন্দিত অনুষ্ঠান। দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ইভেন্ট সরাসরি সম্প্রচার করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতার এ দেশের ক্রীড়ান্নয়নে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ইদানিং বিদেশের মাঠ থেকে বাংলাদেশ বেতার জাতীয় দলের ম্যাচগুলো সরাসরি সম্প্রচার করছে না। ফলে বেতারের ক্রীড়া ধারাভাষ্যের মান এবং জনপ্রিয়তা দুটোই হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব বেতার দিবসের এই শুভক্ষণে বাংলাদেশ বেতারের অগনিত শ্রোতা এব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয় ও বেতার কর্তৃপক্ষের শুভ উদ্যোগ কামনা করেন এবং ক্রীড়া ধারা বর্ণনার মান অক্ষুন্ন রাখতে অনুরোধ জানান। 

বিশ্ব বেতার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্যের সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি সকল রেডিও স্টেশনগুলি তাদের সংবাদ এবং অনুষ্ঠান প্রনয়ন ও পরিকল্পনায় সকল পর্যায়ে বৈচিত্র্যতাকে প্রাধান্য দেবে এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক:  ক্রীড়া ভাষ্যকার, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন এবং প্রিন্সিপাল লাইব্রেরীয়ান, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।