• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২০, ০৬:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৩১, ২০২০, ০৭:০৯ এএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি-২৬

হিংস্র সমরনায়কের তাণ্ডব (চার)

হিংস্র সমরনায়কের তাণ্ডব (চার)

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ফারুক-রশীদের হস্তক্ষেপে জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধানের আসনে বসিয়েছিল খন্দকার মোশতাক। এর মাধ্যমে জিয়ার বহুদিনের সাধ মিটে ছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই ফারুক-রশীদ ভেবেছিল জিয়া তাদের প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু জিয়া সেই পথে হাটেননি। বরং ক্ষমতা হাতে পাওয়‍ার পর তিনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করতে তিনি তার পথের কাঁটাগুলো দূর করতে সুপরিকল্পিতভাবে তাণ্ডব চালান। এরই মধ্যে জিয়া তার জীবন রক্ষাকারী পরম বন্ধু কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এখন তিনি ফ‍ারুক-রশীদের প্রতি বৈরি আচরণ করছেন। লিবিয়‍ার বেনগাজী শহরে বসেই ফারুক-রশীদ খবর পেয়েছে জিয়া তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের পরিবারকে এখন আর কোনও টাকা-পয়সা দেয়া হচ্ছে না। জিয়া শুধু তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি— বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নামের তালিকা থেকেও তাদের নাম বাদ দিয়েছেন। অর্থাৎ জিয়া তাদের কোনও কিছু না জানিয়েই অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ‍এখন  সেনাবাহিনীর  ইউনিফর্ম পড়ার কোনও অধিকার তাদের নেই। এমতাবস্থায় তারা দু’জন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এটা জানিয়ে জিয়াকে চিঠি দেয়। কিন্তু কোনও  চিঠির জবাব দেয়নি জিয়া। কেননা জিয়া চান না তারা দেশে ফিরে আসুক। তাই জিয়া তাদের চিঠির বিষয়টি এড়িয়ে যান। এমনকি চিঠির প্রাপ্তির সংবাদটুকু পর্যন্ত জানাননি। এতে ফারুক-রশীদ অপমানিত বোধ করে এবং এই অপমানে তাদের  মাথায় আগুন ধরে যায়। এমতাবস্থায় তারা কি করবে, চিন্তা-ভাবনা শুরু করে।

জিয়াউর রহমান

জেনারেল জিয়া বরাবরই ফারুক- রশীদের দিকে কড়া নজর রাখছিলেন। রশীদ ঢাকায় পৌঁছানোর পর ওইদিন রাতেই তিনি নূরুল ইসলাম শিশুকে নিয়ে রশীদের কোয়াটারে যান এবং তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পাশাপাশি ফারুকের খোঁজ নেন। যদিও ফারুক কোথায় আছে, কি করছে এ বিষয়ে জিয়া অবগত ছিলেন এবং বিষয়টি তিনি সুকৌশলে রশীদকে বুঝিয়ে দেন। ফলে রশীদ আরও সতর্ক হয়।

 ........‘’........ 

সবদিক বিবেচনা শেষে কর্নেল রশিদ ১৯৭৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জেনারেল জিয়ার কাছে একটি চরমপত্র পাঠায়। আর এটি তারা পাঠায় লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ধরে ‘কূটনৈতিক ব্যাগ’ এ।

চিঠিতে রশিদ জানায়, “তাদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই। মনোবলও দ্রুত কমে আসছে। এই অবস্থায় শিগগিরই তারা দেশে ফিরতে চায়। অন্যথায় অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। তাতে যে ঘটনা ঘটবে সে জন্য তারা দায়ী থাকবে না। দায়ী থাকবে বাংলাদেশ সরকার।”

রশীদ খুব স্পস্টভাবে জানিয়ে দেয়, ৭ মার্চের মধ্যে অবশ্যই তাকে জবাব দিতে হবে। রশীদের এই চরমপত্র কাজ হলো। ফারুক-রশীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য জেনারেল জিয়‍া ১৯৭৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নূরুল ইসলাম শিশুকে পাঠায় লিবিয়ার বেনগাজীতে। নূরুল ইসলাম তাদের জানায়, ‘‘এই মুহূর্তে তোমাদের দেশে ফেরা ঠিক হবে না। তোমরা বিদেশেই থাকো। বাংলাদেশ সরকার তোমাদের দেখবেন। তোমাদের ভালো চাকরি দেবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে এই চাকরি হতে পারে।”

কিন্তু রশীদ এসব মানতে নারাজ, তার সাফ জবাব— “না, আমরা বিদেশে চাকরি চাই না, ওই চাকরি যতো ভালোই হোক না কেন। আমরা দেশে ফিরতে চাই।”

নূরুল ইসলাম একটু থেমে আবার বলল, “বেশ তো, এ চেষ্টাও আমি করবো। তবে সেজন্য আমাকে কিছুটা সময় দিতে হবে।”

রশীদ এতে রাজি হলো। সে জিয়াউর রহমানকে আরেকটি চিঠি দিল। 

রশীদ চিঠিতে লিখলো, ‘আপনাদের জবাবের জন্য আমরা ২০ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। মনে রাখবেন, ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের দেশ ছেড়ে পালানোটা ঠিক হয়নি। এতে আমাদের কাপুরুষতারই প্রকাশ ঘটেছে। তাই দেশে ফিরে আমরা সেই কলঙ্ক দূর করতে চাই।”

এবারও আগের মতোই সেই নীরবতা। ২১ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করে রশীদ তার চিঠির কোনও জবাব পেলো না। এবারও চিঠিপ্রাপ্তি সংবাদটুকু পর্যন্ত স্বীকার করা হলো না। তাই এবার তারা দেশ থেকে শত শত মাইল দূরে বসে জিয়া উৎখাতের নীলনকশা তৈরির কাজে মন দেয়।

ফারুক ও রশীদ

 

ফারুক, রশীদ ও ডালিম ঢাকায় আসায় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে হওয়া কিছুটা গরম হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গোলন্দাজ বাহিনীর লোকরা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে ফারুক-রশীদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করে। এসব কিছু জানা সত্ত্বেও জিয়া কিছুই বললেন না। চুপ করে রইলেন। গোলমাল চূড়ান্ত রূপ নিল ২৭ এপ্রিল। বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের ট্যাঙ্কবাহিনীর কাছ থেকে সেদিন একটি চরমপত্র পেলেন। তাতে বলা হয়— ‘‘ফারুককে বগুড়া পাঠান। নয়তো আমরা ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢাকায় আসছি।”

........‘’........ 

এক্ষেত্রে দূরত্বকেই  তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচনায় নেয়। কেননা তখনও ঢাকার টেলিফোন ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত হয়নি। একটু ঝড়-বৃষ্টি হলেই লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আর ক্রস কানেকশন ও আড়িপাতার বিষয়টি তো আছেই।  তবুও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফারুক জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে যায়। তার ধারণা ফ্রাঙ্কফুট থেকে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ হবে। এরই মধ্যে বেনগাজীতে রশীদের হাতে বাংলাদেশ সরকারের পাঠানো একটি বার্তা পৌঁছায়। তাতে বলা হয়— ‘‘ হ্যাঁ রশীদ অল্প কয়েকদিনের জন্য সপরিবারে দেশে আসতে পারে। কিন্তু অন্য কেউ নয়। তবে ফারুকের স্ত্রী যদি চায় তাহলে সেও কিছুদিনের জন্য ঢাকা ঘুরে যেতে পারে।”

এ খবরে রশীদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। সে ভাবলো জিয়া উৎখাতের নীলনকশা বাস্তবায়নে এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। কেননা রশীদ একাও যদি ঢাকায় আসে তাহলে এখানকার বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে। তাই বাংলাদেশ থেকে সরকারের বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রশীদ ফ্রাঙ্কফুটে ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। খবরটা শুনে ফারুকের মন আনন্দে ভরে ওঠে। ফারুক এ ব্যাপারে রশীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য শিগগিরই বেনগাজীতে আসছে বলে জানায়।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ফারুক ফ্রাঙ্কফুট থেকে লন্ডন হয়ে বেনগাজীতে আসে। আর লন্ডনে তার সঙ্গে বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল এমজি তোয়াবের সঙ্গে দেখা হয়। ফারুক তাদের পরিকল্পনার কথা তোয়াবের কাছে গোপন রাখে। তবে লন্ডনে দু’জনের মধ্যে তিনটি বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে এয়ার মার্শাল এমজি তোয়াব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে ফারুককে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। তাই খুশি মনে ফারুক লন্ডন থেকে বেনগাজীতে ফেরে। জিয়া উৎখাতের নীলনকশা বাস্তবায়নে তারা আরও বেশি তৎপর হয়ে ওঠে।

এয়ার মার্শাল এমজি তোয়াব তাকে জান‍ায়, জেনারেল জিয়া ট্যাঙ্ক বাহিনীকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। এই দু’ভাগেরই অবস্থান ঢাকা শহরের বাইরে। একটি ঢাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সাভার ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে আছে ১৪টি ট্যাঙ্ক ও ৫০০ সেনা। বাকি ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে।

তোয়াব আরও জানায়, শিক্ষানবীশদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিদিন সকালে ট্যাঙ্ক বের হয়। প্রশিক্ষণের সময় ভোর ৫টা থেকে সকাল ৯টা। এ খবরে ফারুক খুব খুশি হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই সাভার ক্যান্টনমেন্টে যাবে। সেখান থেকে পরদিন সকালে ট্যাঙ্কবাহিনী নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর দখল করবে। ট্যাঙ্কবাহিনী বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় লোকে ভাববে এটা হলো দৈনন্দিন মহড়া। তাই কেউ এতে কিছু মনে করবে না। কোনওরকম সন্দেহ করবে না। অন্যদিকে রশীদ আগেই ঢাকায় গিয়ে তার লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করবে। সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখবে। তারপর তারা সবাই নির্দিষ্ট দিনে বিমানবন্দরে এসে ফারুকের সঙ্গে মিলিত হবে।

জিয়াউর রহমান

 

ফারুক, রশীদ ও ডালিম ঢাকায় আসায় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে হওয়া কিছুটা গরম হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গোলন্দাজ বাহিনীর লোকরা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে ফারুক-রশীদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করে। এসব কিছু জানা সত্ত্বেও জিয়া কিছুই বললেন না। চুপ করে রইলেন। গোলমাল চূড়ান্ত রূপ নিল ২৭ এপ্রিল। বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের ট্যাঙ্কবাহিনীর কাছ থেকে সেদিন একটি চরমপত্র পেলেন। তাতে বলা হয়— ‘‘ফারুককে বগুড়া পাঠান। নয়তো আমরা ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢাকায় আসছি।”

........‘’........ 

কিন্তু এতো বড় কাজের জন্য তো টাকা-পয়সা লাগবে অনেক, এই টাকা আসবে কোত্থেকে? বেনগাজীর দুই ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তাদের একজন বেনগাজীর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মেজর সেলিম ইব্রাহিম, অন্যজন লিবিয়ার সাইরেনিকা প্রদেশের প্রশাসনিক প্রধান মেজর সুলেমান। তারা দু’জনেই রশীদ এবং ফারুককে তাদের কাজের প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের আশ্বাস দেয়। এই আশ্বাসের পরেই শুরু হয় জিয়াউর উৎখাতের নীলনকশা বাস্তবায়নের অভিযান। ১৯৭৬ সালের ২০ এপ্রিল রশীদ ব্যাংকক হয়ে ঢাকায় আসে। তারা যেহেতু সরকার উৎখাতের মতো একটি বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে, তাই রশীদ স্ত্রী-পুত্র কাউকে সঙ্গে আনেনি। সে এসেছে একা, একেবারেই একা। বিমানবন্দরে এদিন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে তার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিল। ছিল সাদা পোশাকে সামরিক বাহিনীর একদল গোয়েন্দা। বিমানবন্দর থেকে রশীদ সরাসরি যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তার কোয়াটারে।

জেনারেল জিয়া বরাবরই ফারুক- রশীদের দিকে কড়া নজর রাখছিলেন। রশীদ ঢাকায় পৌঁছানোর পর ওইদিন রাতেই তিনি নূরুল ইসলাম শিশুকে নিয়ে রশীদের কোয়াটারে যান এবং তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পাশাপাশি ফারুকের খোঁজ নেন। যদিও ফারুক কোথায় আছে, কি করছে এ বিষয়ে জিয়া অবগত ছিলেন এবং বিষয়টি তিনি সুকৌশলে রশীদকে বুঝিয়ে দেন। ফলে রশীদ আরও সতর্ক হয়। সে অত্যন্ত গোপনে তার সঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ২নং গোলন্দাজ বাহিনী এবং সাভার ও বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের ট্যাঙ্কবাহিনীর সঙ্গে আবার তার যোগসূত্র গড়ে ওঠে। ২৩ এপ্রিল ফারুক ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছে। রশীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী একদল সৈন্য ফারুককে বিমানবন্দর থেকে সাভার ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সাভারে ফারুক পায় বিপুল সংবর্ধনা। প্রায় দুই হাজার সৈন্য তাকে কাঁধে নিয়ে স্লোগান দেয়— কর্নেল ফারুক জিন্দাবাদ।

খবরটা দ্রুতই পেয়ে যান জেনারেল জিয়া। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা তাকে জানায়, সাভার ক্যান্টনমেন্টের সৈন্যদের বেশিরভাগই এখন ফারুকের পক্ষে। এ অবস্থায় জিয়া চুপ করে থাকাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলেন। অন্যদিকে মেজর ডালিম ঢাকায় এসে পৌঁছায় ২৫ এপ্রিল। ঘটনাচক্রে এয়ার মার্শাল তোয়াবও তার সঙ্গে একই বিমানে ঢাকায় পৌঁছান। ডালিমের সঙ্গে তোয়াবের এ যোগাযোগ আকস্মিক। আসলে জিয়া উৎখাতের পরিকল্পনার সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগই ছিল না‌। এই আচমকা যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে জিয়া পরে তোয়াবকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল।

ফারুক, রশীদ ও ডালিম ঢাকায় আসায় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে হওয়া কিছুটা গরম হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গোলন্দাজ বাহিনীর লোকরা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে ফারুক-রশীদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করে। এসব কিছু জানা সত্ত্বেও জিয়া কিছুই বললেন না। চুপ করে রইলেন। গোলমাল চূড়ান্ত রূপ নিল ২৭ এপ্রিল। বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের ট্যাঙ্কবাহিনীর কাছ থেকে সেদিন একটি চরমপত্র পেলেন। তাতে বলা হয়— ‘‘ফারুককে বগুড়া পাঠান। নয়তো আমরা ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢাকায় আসছি।”

এ ব্যবস্থায় জিয়া ধীরে চলার নীতি নিলেন। ফারুককে তিনি বগুড়া পাঠালেন ঠিকই, একই সঙ্গে ঢাকা রক্ষারও ব্যবস্থা নিলেন। তিনি একদল সৈন্য পাঠালেন আরিচা ফেরিঘাটে। বগুড়া থেকে ঢাকার পথ ধরতে হলে তাদের যমুনা নদী পেরিয়ে এখানে আসতে হবে। ঘটনা যদি এইদিকে মোড় নেয় তাহলে ওই নদীপথে পথেই হানতে হবে জোড় আঘাত। আরিচা থেকে ঢাকার পথে প্রথমে সাভার ক্যান্টনমেন্ট, তারপর ঢাকা। সুতরাং বিদ্রোহীদের এই পথে ঢাকা আসা সহজ কথা নয়।

মেজর ডালিম

ফারুক সম্পর্কে জিয়া অন্য ফন্দি করলো। তাকে সে ঢাকায় আসতে বললো। ফারুক এতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললো, সে বগুড়াতেই থাকবে। তাই জিয়া অন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্য আনিয়ে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রাখলো। এরপর বগুড়ায় পাঠিয়ে দেয়া হলো ফারুকের বাবা ও তার এক বোনকে। এতে ফারুক হার মানলো। সে তার বাবা ও বোনের সঙ্গে বগুড়া ছেড়ে এলো। ফারুক ঢাকায় ফিরলেও ট্যাঙ্কবাহিনীর সদস্যরা লড়াইয়ের পথেই থেকে গেল।

 ........‘’........ 

এদিকে ২৭ এপ্রিল বিকেলে রশীদ বুঝতে পারলো, প্রকৃতপক্ষে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। তার কোয়াটারের চারপাশে পাহারা বসেছে। সে বের হতে পারছে না। তার কাছেও কেউ আসতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে সে একটা গোপন লাইনে বার্তা পাঠালো সাভারে ও বগুড়ায়। সে জানালো “তৈরি হও সংগ্রামের জন্য। ধূর্ত জিয়া আঘাত হানছে। আমি এখন গৃহবন্দী‌।”

পরদিন সকালেই রশীদকে নেয়া হয় সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় দফতরে। সেখানে একটি কক্ষে তাকে প্রায় ৬ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। এরপর তাকে ডাকা হয়।

জিয়া তাকে বলল, ‘‘দেশের স্বার্থে তোমার আর দেশে থাকা চলবে না।”

কেন?

জিয়া বলল, “এর জবাব আমি দেবো না‌। যদি কাজ চাও, বাইরে বাংলাদেশের দূতাবাস আছে। এর যে কোনও একটিতে তুমি ভালো চাকরি পেতে পারো।”

রশীদ- না না বলে চেঁচিয়ে উঠলো। সে বলল, ও কাজ আমি চাই না।

জিয়া রহস্যময় হাসি হেসে বলল, তাহলে শূন্য হাতেই তোমায় যেতে হবে। ঘণ্টা দুয়েক পরেই তোমার ফ্লাইট। তোমাকে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেয়া হবে। ব্যাংককে গিয়ে তোমার যেখানে যেতে মন চায় যেও।”

রশীদের সঙ্গে গার্ড দিয়ে তাকে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এরই মধ্যে বিমানবন্দরের ডালিমকেও নেয়া হয়েছে। তার প্রতিও জিয়ার একই আদেশ, “দেশের স্বার্থেই তাকে দেশের বাইরে যেতে হবে।”

ফারুক সম্পর্কে জিয়া অন্য ফন্দি করলো। তাকে সে ঢাকায় আসতে বললো। ফারুক এতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললো, সে বগুড়াতেই থাকবে। তাই জিয়া অন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্য আনিয়ে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রাখলো। এরপর বগুড়ায় পাঠিয়ে দেয়া হলো ফারুকের বাবা ও তার এক বোনকে। এতে ফারুক হার মানলো। সে তার বাবা ও বোনের সঙ্গে বগুড়া ছেড়ে এলো। ফারুক ঢাকায় ফিরলেও ট্যাঙ্কবাহিনীর সদস্যরা লড়াইয়ের পথেই থেকে গেল। পরদিন সকালেই তারা ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তায় বের হলো। কিছু সাধারণ সৈন্য তাদের অনুসরণ করল। এদিকে গোটা ১১ ডিভিশন জিয়ার পক্ষে। তাদের কাছে ছিল মেশিনগান ও কামান। ফলে বিদ্রোহী সাধারণ সৈন্যরা ভয়ে পালিয়ে যায়। ধরা পড়ে ট্যাঙ্কবাহিনীর লোকরা। তাদের বিচার হয়। কয়েক জনের ফাঁসি হয়। কয়েকজনের হয় কারাদণ্ড। এভাবেই ব্যর্থ হয় রশীদ ও ফারুকের জিয়া উৎখাতের প্রচেষ্টা। দু’মাস পরে ১৯৭৬ সালের ১৫ জুলাই জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের সৈন্য বাহিনী থেকে ট্যাঙ্কবাহিনী তুলে দেন।

আবেদ খান ● সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

আরও পড়ুন