• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২০, ০৭:২৭ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৫, ২০২০, ০৮:৫০ এএম

শ্রমিক যে হয় সে মানুষ কি নয়?

শ্রমিক যে হয় সে মানুষ কি নয়?

একদিকে সাধারণ ছুটির ঘোষণা (কার্যত লকডাউন), সেই সঙ্গে সামাজিক দূরত্বের আহ্বান, বিশেষ অফারে থাকছে রাস্তায় নামলে আর্মি বা পুলিশের ঠ্যাঙানি। জরিমানা আর মামলার বিধানে আবদ্ধ গণপরিবহণ ব্যবস্থা। এই সবই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে নেয়া কড়াকড়ি। তাহলে এরমাঝেই কেন পশুর চেয়েও অমানবিকভাবে লাখ লাখ গার্মেন্টস কর্মীদের রাজধানীর বুকে টেনে আনা! কারা করলেন এই কাজ? সরকারের প্রতিটি কাজকে পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এমন প্রতি মুহূর্তের ব্যস্ততা কাদের? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেখানে চুন থেকে পান খসলে নেমে আসে অবরুদ্ধকরণ খড়্গ, সেখানে প্রকৃতপক্ষে যারা বেপরোয়া কাজকর্মে সদা মত্ত, তাদের লাগাম পড়াতে কেন অপারগতা! এমনই নানা প্রশ্নে এখন সরব দেশ।

শুক্রবার (৪ এপ্রিল) আকস্মিকভাবেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকামুখী গার্মেন্টসকর্মীদের ঢল নামে। গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় পায়ে হেঁটেই তারা রওনা দেন রাজধানীর উদ্দেশে। কারণ? কোন একটি পর্যায় থেকে নাকি জানানো হয়েছে, ৫ এপ্রিল কর্মক্ষেত্রে যোগ না দিলে ছাটাই চলবে, দেয়া হবে না বেতন। কিন্তু কে দিলো এই ঘোষণা? আগ পিছ যাচাই না করেই একদল কথিত সুশীল গালমন্দ শুরু করলেন খেটে খাওয়া এই 'অশিক্ষিত, গেঁয়ো, বোধ-বুদ্ধিহীন' গার্মেন্টস শ্রমিকদের। ভুলে গেলেন এই অশিক্ষিতের দলই যে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডটা সোজা করে রেখেছেন। আরেক দল বরাবরের মতই সরকারের কান মলতে শুরু করলেন। মাঝ থেকে যেই অবাঞ্চিতের দল সরকারি অনুদানের ভাগ-বাটোয়ারা নিশ্চিত করতে এই কীর্তি ঘটালেন তারা নিরবে নিরাপদেই রইলেন। আর যখন থলের কথা বেরিয়ে এলো তখন তাদের বক্তব্য, ছাঁটাইয়ের গুজব ছড়িয়ে নাকি এ কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। বেশ সহজ একটি পথ পাওয়া গেছে দেশে এই 'গুজবতত্ত্ব' খাটিয়ে তস্করের মস্করা ঢাকার।

সরকার যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়লে দোষী আবার রোগি কম হলেও দোষী, ঠিক এমন পরিস্থিতিতে এই সমালোচনার বিশ্বসেরা মঞ্চে রীতিমত লড়াই চলছে বিব্রতি আর বিভ্রান্তিকে নিত্য সঙ্গী করে করোনা জয়ের। যতই চেষ্টা চলছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের মাধ্যমে করোনার বিস্তার প্রতিরোধের ততই যেন ভিড় আর গা ঠাসাঠাসির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সর্বত্র। মক্কা-মদীনায় ঈমানের ঢাক প্রাণের দাবিতে নিরব থাকলেও, বাংলাদেশের মসজিদে মসজিদে শুক্রবার জুম্মার জামাতে সেই ঢাকের বাড়ি রীতিমত আতঙ্ক বাড়িয়ে তুললো। আর সেটা বলতে গেলে অনেকের আঁতে ঘা লাগে। তার ওপর সংক্রমণের বিস্ফোরণ সম্ভাব্য পরিস্থিতির মাঝে ফেলা হল এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে! অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেল, না তো সরকার আর না তো বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ- কেউই ৫ এপ্রিলের এই কর্মস্থলে যোগদানের বাধ্যবাধকতার কোনো কথা নিজেরা তো বলেই নি, কারা বলেছে তাও জানেন না! কিন্তু এই মানুষগুলো নিশ্চয় কম পীড়নে এই অমানবিক যাত্রার ধকল নেননি! কুরবানীর হাটে যে পশুগুলো আসে, তাদেরও তো পরিবহন সুবিধা দেয়া হয়। অথচ এই মানুষগুলোর সঙ্গে এ কেমন আচরণ করা হলো! তীর্থযাত্রা তো ছিল না সেটা! তা হলে কি এমন কারণে হলো এ আতঙ্ক জাগানিয়া ঢাকা মুখী লংমার্চ?

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেশ ঝুঁকিতে পড়ে গেল। আমাদের শুরু থেকেই দাবি ছিল বেতনসহ ছুটি নিশ্চিত করতে হবে। আজকে শ্রমিকরা যেভাবে ঢাকায় ফিরছে সেটা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। এতে করে মালিকরা যদি ভাবে তারা রক্ষা পেয়ে যাবেন তাহলে সেটা বৈজ্ঞানিক হয় না। তিনি এও বলেন, আমরা বলছি খুলে দেওয়ার কথা, কিন্তু অনেক কারখানা বন্ধই হয়নি সেগুলো নিয়ে কথা বলছি না। শতভাগ কারাখানা তো বন্ধ হয়নি।
সরকার যেখানে মজুরি বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে, সেখানে পুরো সময়টা ছুটি কাটাতে দেওয়া যাবে না কেন প্রশ্ন করে জলি বলেন, মালিকরা যে পরিমাণ অর্ডার বাতিল হওয়ার কথা বলছেন, বাস্তবে সে পরিমাণ অর্ডার বাতিল হয়নি। অর্ডার না থাকলে মালিকরা শ্রমিকদের টেনে আনতো না। সবার প্রতি বড় ধরনের অন্যায় করা হচ্ছে।

মূল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যখন জানিয়ে দিলো যে এই টাকা অনুদানের চালের বস্তার মত যেন কারো বাড়ির গুদামে বা রাইস মিলের স্টোরে না ঢোকে সেজন্য শ্রমিকদের ব্যাংক একাউন্ট বা মোবাইল ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি চলে যাবে, মুঠো করে দিয়ে দেয়া হবে না মালিকের হাতে, তখনই মাথায় বাজ পড়েছে অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিকদের। দেশের শিক্ষক, ইতিহাস গবেষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ স্পষ্টতই এ কথা দাবি করছেন। তারা বলছেন, এই অনুদানের টাকা যাতে এই বিপর্যয়ের মাঝে নির্বিঘ্নে শ্রমিকদের হাতে পৌঁছায় সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যে চমৎকার একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে যা বাংলাদেশ ব্যাংক বিস্তারিত জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু লাখ লাখ শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা নিশ্চিত হলেও এক্ষেত্রে মালিকপক্ষের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। আর তাই এত এত মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা সচেতনভাবে উপেক্ষা করেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এতে করে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে দেশে কত বড় মহামারীর প্রলয় সৃষ্টি হতে পারে তা তারা বিবেচনাই করেননি। তবে এদের বিরুদ্ধে কার্যত কি ব্যবস্থা নেয়া হবে আর এই মুহূর্তে করোনা না কি এদের নিয়েই মাথা খাটানো হবে সে প্রশ্নের উত্তর কেবল সময়ই দিতে পারে।

সারা বিশ্বের মানুষ যখন সমন্বিতভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি রাষ্ট্র যখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে রোধ করার চেষ্টা করছে এই মৃত্যুপ্রলয়। আর প্রতিটি স্তরের মানুষ সে কাজে তাদের সাহায্য করছে, ঠিক তখন দুর্ভাগিনী বঙ্গজননীর বুকে চলছে মানবেতর কীর্তিকলাপ। একদিকে দেশের সরকার প্রশাসন যখন পাগল পাড়া মানুষের জীবন রক্ষায়, অন্যদিকে তখন জনাকয়েক আমলার জটিলতন্ত্র চর্চায় সৃষ্ট হচ্ছে বিপত্তি। সেই সঙ্গে মানুষের অসচেতন চলাফেরা, সমালোচনা আর সর্বশেষ এই শুক্রবারের ঘটনা।

এভাবে যদি পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে অবিবেচকের মত রাষ্ট্রের এগিয়ে চলার পথে প্রতি পদে পদে বাধা সৃষ্টি করা হয়, তবে বাংলাদেশের বুকে হাহাকার তুলতে করোনার প্রয়োজন পড়বে না। এভাবে আমরাই খুবলে নেব আমাদের আজ ও আগামীর সকল সম্ভাবনা।

এসকে