• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২০, ১০:০১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৭, ২০২০, ১০:০১ পিএম

পোশাক শ্রমিকদের অভিভাবক কে?

পোশাক শ্রমিকদের অভিভাবক কে?
সাঈদ আহমেদ

একজন ব্যক্তি যদি ২৫ বছর বয়সে হঠাৎ ‘ওয়ান ফাইন মর্নিং’ জানতে পারেন যে যাদের তিনি জন্মের পর থেকে মা-বাবা হিসাবে জেনে এসেছেন তারা আসলে তার কেউ নন এবং তারা তার প্রকৃত মাতা-পিতামাতা ‘কে’ তাও জানেন না, তাহলে তার মনের অবস্থা কী হতে পারে? এমনটা আমরা নাটক-সিনেমায় দেখেছি, গল্প-উপন্যাসে পড়েছি কিন্তু বাস্তবে এমন একটি প্লটের ওপর ভিত্তি করেই একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল। সেটা বাস্তব জীবনের নাটক। ৫ এপ্রিল (রোববার) সারা দেশের ছড়িয়ে থাকা লাখ লাখ দরিদ্র, অসহায়, নিম্ন আয়ের পোশাক-শ্রমিকরা চাকরি বাঁচানোর জন্য নিজেদের ও দেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবন ঝুঁকিতে রেখে একেবারে নিরুপায় হয়ে রওয়ানা দিলেন ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে, তাদের চাকরি স্থলে। লকডাউনের কারণে পরিবহন বন্ধ ছিল। নিজেদের দু’টি পা আর দুই ফিতার স্যান্ডেল পরে পাড়ি দিয়েছে কয়েকশ কিলোমিটার। কখনও সাময়িক পরিবহন ,কখনও শুধুই হাঁটা। সাথে ব্যাগ, কারও কারও কোলে শিশু।

৫ এপ্রিল কাজে যোগ না দিলে বেতন কাটা যাবে, এমনকি চাকরিটাও হারাতে হতে পারে কারখানা মালিকদের এমন হুঁশিয়ারির কারণে হাজারো দুর্ভোগ পোহানের পরে তারা যখন ঢাকা পৌঁছান তখন সরকার বাহাদুরের ঘুম ভেঙে গেছে। তারা বুঝে ফেলেছেন লাখ লাখ পোশাক শ্রমিকদের কাজে ফেরা মানে লকডাউনের লবডংকা। এগিয়ে দিলেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে । “ঠেকাও ওদের, কারখানা বন্ধ।’’

সারারাত নাওয়া-খাওয়াবিহীন পথচলা, সাথে ভারি ব্যাগ, কারও কারও কোলে শিশু— অসহায় পোশাক শ্রমিকদের পা দুটো যেন আর শরীরের ভার সইতে পারে না। বুকের সামনে পুলিশের বন্দুক, চোখে কাঁদানে গ্যাস আর মাথার ওপর চাকরি হারানোর ভয়। সেই মুহূর্তে কি ওই পোশাক শ্রমিকদের কাছে ঢাকাকে লসঅ্যাঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক, ভেনিস বা সিঙ্গাপুর মনে হয়েছিল। দেশের অর্থনীতির শতকরা ৮৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি যোগকারী শিল্পের শ্রমিকরা সবচেয়ে অসহায়।

যে কারখানা মালিকদের ব্যক্তিগত ব্যাংক ব্যালেন্স, বাড়ি-গাড়ি, সহায়-সম্পত্তি, আরাম-আয়েশ বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকরা বছরের পর বছর স্বল্প মজুরিতে শ্রম ও ঘাম দিল, তারা এই অসহায় মানুষদের দায়িত্ব নিলো না এক মাসের জন্যও এমনকি এমন একটা সময়ে যখন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে পুরো পৃথিবী বিপণ্ণ। আমাদের পোশাক কারখানাগুলো কি এতটাই প্রান্তিক পর্যায়ের মুনাফা করে যে কোনও দুর্যোগের কারণে কারখানা বন্ধ থাকলে তারা শ্রমিকদের বেতন দেয়ার ক্ষমতা রাখে না? প্রশ্ন হচ্ছে টাকা থাকলেও কেন দেবে? দেবে এ কারণে যে এই শ্রমিকরা বছরের পর বছর তাদেরই কাজ করে। আরও দেবে মানবিক কারণে। যদি মুনাফা এতটাই কম হয় তবে কী করে এক কারখানা থেকে পাঁচ কারখানা হয়, এক ব্যবসা থেকে ১০ ব্যবসা হয়? কিভাবে পরিবার ও টাকা পাচার হয় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা সহ ইউরোপের দেশগুলোতে? বৃদ্ধ বয়সে আরাম-আয়েশের জন্য দুবাইয়ের সমুদ্রতীরে বাড়ি বা মালয়েশিয়ায় “সেকেন্ড হোম”? আর সুইস ব্যাংক তো উন্মুক্ত আছেই।

সারারাত নাওয়া-খাওয়াবিহীন পথচলা, সাথে ভারি ব্যাগ, কারও কারও কোলে শিশু— অসহায় পোশাক শ্রমিকদের পা দুটো যেন আর শরীরের ভার সইতে পারে না। বুকের সামনে পুলিশের বন্দুক, চোখে কাঁদানে গ্যাস আর মাথার ওপর চাকরি হারানোর ভয়। সেই মুহূর্তে কি ওই পোশাক শ্রমিকদের কাছে ঢাকাকে লসঅ্যাঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক, ভেনিস বা সিঙ্গাপুর মনে হয়েছিল।

...........‘’...........

ডয়চেভেলের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বিজিএমইএ এর সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, তারা ডব্লিউএফপি অর্থাৎ বিশ্ব খাদ্য সংস্থার কাছে শ্রমিকদের জন্য এক মাসের খাবারের খরচ চেয়েছিলেন। কেন? এই শ্রমিকরা কি ডব্লিউএফপি-এর জন্য কাজ করে? তারা কি বেকার? তারা কি কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আক্রান্ত? তারা তো কাজ করে পোশাক কারখানায়। তাদের বিপদে কি সেই কারখানাগুলোর মালিকদেরই আগে এগিয়ে আসা উচিত নয় কি? যদি এমন হতো, বিপর্যয় প্রলম্বিত হচ্ছে এবং কারখানা মালিকরা কয়েক মাস শ্রমিকদের সাহায্য করেছে তারপর তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বললো সাহায্যের জন্য তবে ভিন্ন কথা ছিল। দ্বিতীয়ত, পোশাক কারখানাগুলো তো লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অলাভজনক, সেচ্ছাসেবী, দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয় যে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এত দ্রুত এগিয়ে আসবে। এগিয়ে এসেছিল সরকার। দিতে চেয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা হিসাবে। শুধু বলেছিল টাকাটা কারখানা মালিকরা নেবে ঋণ হিসাবে আর সুদ হবে মাত্র ২%। আর টাকাটা শুধু শ্রমিকদের বেতন দিতেই ব্যবহার করা যাবে যা শ্রমিকদেরকে পাঠিয়ে দিতে হবে যার যার মোবাইল বা ব্যাংক  অ্যাকাউন্টে। পছন্দ হয়নি কারখানা মালিকদের। তারা চান নিঃশর্ত প্রণোদনা, ঋণ নয়। তাদের হাতে ছিল দুটো ট্রাম কার্ড। এক- দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প; দুই- লাখ লাখ শ্রমিক। সরকারের ওপর প্রতিশোধ ও নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে লাখ লাখ নিরুপায় শ্রমিককে জরুরি ভিত্তিতে তলব করলেন ঢাকায়।

অনেক দেরিতে হলেও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকার যে ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করছিল এক ঝটকায় ভেঙে পড়ল সব। সেই সকাল থেকেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকল লাফিয়ে লাফিয়ে।

সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে সারা দেশকে ঝুঁকিতে ফেলে, লাখ লাখ দরিদ্র শ্রমিককে জিম্মি করার এই ঔদ্ধত্যের সাহস কোথায় পেলেন কারখানা মালিকরা? এটা সত্য, আমাদের অর্থনীতি তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তার মানে এই নয় যে, এই শিল্পের মালিকরা আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তামাশা করবেন। জীবনের বিনিময়ে হলেও কি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন? পোশাক কারখানার মালিকদের এমন সিদ্ধান্তে যদি দেশ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, যদি হাজার হাজার মানুষ মারা যায় সে দায়িত্ব কি মালিকরা নেবেন?

লেখক ● শিক্ষক, কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়