• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২০, ০১:৫০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৮, ২০২০, ০১:৫৩ পিএম

জনস্বার্থে চাই স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা ও স্বীকৃতি

জনস্বার্থে চাই স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা ও স্বীকৃতি

দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল! বাড়ছে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা। পুরো বিশ্বেই নাজুক হচ্ছে পরিস্থিতি। কভিড ১৯ এর আক্রমনে দিশেহারা পৃথিবী। মাত্র চার মাসেই বদলে দিয়েছে দুনিয়া। অতর্কিত আক্রমনে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে মোকাবেলার জন্য যেন দাঁড়াতেই দিচ্ছে না নভেল করোনা ভাইরাস। 

গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে এই ভাইরাসের আবির্ভাব হলে আমরা বরং হাসাহাসি করেছি আর চীনকে দোষারোপ করেছি তাদের খাদ্যাভাসের জন্য।  দ্রুতই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। সংক্রমনের কেন্দ্র চীন থেকে ইউরোপ ঘুরে পৌঁছে গেছে পৃথিবীর মোড়ল খোদ যুক্তরাষ্ট্রে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সুযোগসুবিধায়  বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই দেশে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ২০০০ থেকে ২৪০০ জন। ঘাটতি পড়েছে স্বাস্থ্য কর্মী ও সরঞ্জামে। 

আর বাংলাদেশে? সংকেত ও সময় পেলেও কাজে লাগাইনি আমরা; এখন আমরা নিরস্ত্র, অসহায়। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে যথেষ্ট টেস্ট না করেই কোটি কোটি মানুষ ঘরবন্দি করে বরং লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কাকেই নিশ্চিত করতে চলেছি। সাথে সাথে দেশকে ঠেলে দিচ্ছি চরম অর্থনৈতিক অন্ধকারের দিকে। বিশ্বাস করতে হবে কভিড-১৯ থেকে মুক্তি সহজে মিলতে নাও পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় এলার্জি ও সংক্রামক রোগ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডাঃ এন্থনি ফাউসি আশঙ্কা করছেন যে, করোনাভাইরাস একটি মৌসুমি রোগে পরিণত হতে পারে এবং ফিরে আসতে পারে প্রতি বছর। এই  প্রাণঘাতী ভাইরাস মোকাবেলায় সম্মুখ ভাগের যোদ্ধা অর্থাৎ ডাক্তার, নার্সসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাই ওঠতে শুরু করেছে নানা প্রশ্ন। শুধু এটুকু বলাই হয়ত যথেষ্ট হবে যে, স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহায্য ছাড়া করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব না।

কভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যকর্মীরা এই কারনেই অত্যাবশ্যক যে একমাত্র উনারাই রোগীদেরকে পেশাদার চিকিৎসা ও সেবা দিতে পারেন, অন্য পেশাজীবীরা পারেন না। তারা সংক্রমিত মানুষের সবচেয়ে কাছে যান, অন্যরা নয়। অন্য সব পেশাজীবীদের কাছে লকডাউন হল বাসায় থাকা, আর স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য তা হল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে সেবা দিয়ে যাওয়া। আর দিন বা রাত শেষে ঝুঁকি নিয়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসা। তাহলে সুরক্ষা কার বেশি প্রয়োজন? যদি পিপিই যথেষ্ট পরিমানে থাকতো তবে সবাই পড়ে বসে থাকতে পারতো কিন্তু যেহেতু প্রথম থেকে এর ঘাটতি ছিল তাই তাদেরই তো পাওয়ার কথা ছিল সবার আগে। কিন্তু আমরা দেখলাম দেশে পিপিই এলো; ডাক্তার, নার্সরা পেল না বরং  কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা, তাদের অনুসারী, পিএস, এপিএস, এএপিএস, ড্রাইভার, প্রসাশনের ক্যাডার 'মহোদয়' এবং তাদের পিয়নরা পিপিই পড়ে ছবি পোস্ট করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। 

এক্ষেত্রে রীতিমত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমি বলবো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে, ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ পিপিই পড়লে তাকে হাসপাতালে পাঠাবেন চিকিৎসা দেয়ার জন্য। তার এই বিবেচনাবোধ যেন অন্যরা ধারণই করোতে পারছেন না। তাহলে তারা কেমন অনুসারী!
 
ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে এ কয়দিনে। অনেক ডাক্তার কসাইয়ের মত আচরণ করে।  টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না। ওষুধ কোম্পানির লোকের সাথে কথা বলতে বলতে রোগী দেখে। রোগীর কথা শোনেই না। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে টাকা খায় বলে অকারনে টেস্ট করায়- ইত্যাদি ইত্যাদি। আসুন মনে করি সব অভিযোগ সত্য। এক্ষেত্রে আমার কথা হল- এক, এখন কি এসব কথা বলার সময় ? দুই, আগে প্রতিবাদ করেননি কেন? এরপরেও তো যান তাদের কাছে। তিন, কি বললেন? আমরা জিম্মি ডাক্তারদের কাছে? তো আমরা কি এখনো জিম্মি না? করোনার চিকিৎসা কি কোন ম্যাজিস্ট্রেট বা ব্যাংকার বা অন্য কেউ করতে পারবে? আগে মেনে নিতে পারলে এখন পারছেন না কেন? এতো ইগো এলো কোত্থেকে? চার, প্রশ্ন তো ডাক্তারদের দায়িত্ত্বে অবহেলা নিয়ে। তো একই অবহেলা যদি অন্য পেশার কেউ, বিশেষ করে ক্ষমতাধর পেশার কেউ করেন, পারবেন একই ভাবে প্রতিবাদ বা সমালচনা করতে? যেমন, কোন ডিসি, এসপি বা আমলা-কর্মকর্তা দায়িত্ত্বে অবহেলা করলে বলতে পারবেন? পারবেন না। আমিও পারবো না। কারন তাদের ক্ষেত্রে 'বিশেষ' কারণে আমাদের দম ফাঁটে । আমরা পারবো নিরস্ত্র ডাক্তারের সাথে, কলমওয়ালা সাংবাদিকের সঙ্গে আর ছোটখাটো পদে চাকরীওয়ালেদের সঙ্গে। আমরা 'শক্তের ভক্ত নরমের জনম'।

আমি কিন্তু ডাক্তারদের অন্যায় কে সমর্থন করছি না। তারা দায়িত্ত্বে অবহেলা করলে শাস্তি দিন। যেমন কিছুদিন আগে বাংলাদেশের তরুণ সাংসদ ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক মাশরাফী বিন মরতুজা তার এলাকার ডাক্তারকে শাস্তি দিলেন দায়িত্ত্বে অবহেলার জন্য। আমরা তাকে সাধুবাদ জানালাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা তো ডাক্তারকে কাজের পরিবেশ দিচ্ছি না। প্রয়োজনীয় ন্যুনতম সুরক্ষা দিয়ে তাদেরকে কাজ করতে দিতে হবে। এর পরে হবে কাজের বিচার। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে স্বাস্থ্য কর্মীদের কে আগে নিজেদেরকে সুরক্ষিত করতে হবে নিজের ও অন্যের স্বার্থে যেমন বিমানে সংকটময় অবস্থায় আগে নিজের অক্সিজেন মাস্ক পড়ে অন্যকে সাহায্য করতে হয়, ঠিক তেমনটাই।
   
কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে শত শত ডাক্তার ও নার্স মারা যাচ্ছে। সম্মুখ ভাগের এই বীর শহীদদের তালিকা করেছে মেডস্পেস। তাদের মতে ত্রিশ মার্চ পর্যন্ত শুধু ইতালিতেই ৬১ জন ডাক্তার মারা গেছেন। সে দেশে সকল স্বাস্থ্য কর্মীর শতকরা ২০ ভাগ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রন ও নিরাময় কেন্দ্রের (সিডিসি) মতে, সেদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৯০০০ এর বেশি স্বাস্থ্যকর্মী এবং মারা গেছেন কমপক্ষে ২৭ জন। 

নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে  যে, স্পেনে মোট আক্রান্তদের ১৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী। দ্য স্টার  লিখেছে, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ২৫ জন ডাক্তারের মৃত্যু হয়েছে।  দ্য ল্যান্সেট বলছে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এর তথ্য অনুযায়ী মার্চ মাসের শুরু নাগাদ ৩৩০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী করনায় আক্রান্ত হন। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায় ফেব্রুয়ারি নাগাদ দেশটিতে ২২ জন ডাক্তারের মৃত্যু হয়।  

বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০০৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে চিকিৎসক সহ সব স্বাস্থ্য কর্মীর চরম ঘাটতি রয়েছে; এছাড়াও শহরের তুলনায় গ্রামে ডাক্তারের সংখ্যা আনুপাতিক হারে অনেক কম। সংস্থাটির হিসাবে দেশে প্রতি ১০,০০০ জন মানুষের জন্য ৩.০৫ জন চিকিৎসক আছেন। অর্থাৎ, দেশে স্বাস্থ্য কর্মী ও সুযোগসুবিধার ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে যদি আমরা তাদের হারাই তবে এই ভাইরাসের মোকাবেলা করবে কারা?

আমরা যারা অন্য পেশায় আছি তারা তো রোগীর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারবো না। এরইমধ্যে আমরা হারালাম সম্মুখ ভাগের এমনি এক যোদ্ধা কে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডাঃ মঈন উদ্দিন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় চরম অব্যবস্থার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রশ্ন হল- মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক হয়ে যদি তিনি সুযোগ সুবিধা না পান তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য কি ব্যবস্থা আছে

সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদেরকে উৎসাহিত করতে ও তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানি পন্য ও সেবা বিনামুল্যে দিচ্ছে তাদেরকে। আর আমরা তাদের অরক্ষিত রাখছি আর আক্রমন করছি। মনে  রাখতে হবে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, বরং এমন একজন জ্ঞানী ও প্রশিক্ষিত  মানুষের মৃত্যু যে আরো অনেক মানুষকে তার জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে সেবা দিতে পারত এবং এ রকম একজন কর্মীকে কিন্তু আমরা রাতারাতি তৈরি করতে পারবো না। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই তাদেরকে নিরাপদ রাখতে হবে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক ও যন্ত্রপাতির যোগান দিতে হবে। এছাড়াও তাদেরকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার জন্য সরাসরি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের প্রশংসা করতে হবে ও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। 

কভিড-১৯ এভাবে মোকাবেলা করতে হবে যে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের আক্রান্ত পরিজনদেরকে সেবা দেবে হাসপাতালে আর আমরা প্রস্তুত থাকব স্বাস্থ্য কর্মী ভাইবোনদের প্রয়োজনে। 

লেখকঃ শিক্ষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন