• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২০, ০৫:৪৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২১, ২০২০, ০৭:২০ পিএম

সংবাদযোদ্ধাদের এগিয়ে রাখতে হবে

সংবাদযোদ্ধাদের এগিয়ে রাখতে হবে
সাঈদ আহমেদ

এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে ষোল পাতার দৈনিকটা যেন ছোট্ট এক টুকরো পৃথিবী। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, হিমালয় থেকে এন্টার্কটিকা অথবা আমাজনের গহিন জঙ্গল— সব খবর অনায়াসেই মেলে ধরে চোখের সামনে। অথবা টিভির রিমোটের বোতাম চাপলেই দেশ-বিদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিনোদন এক নিমিষেই ঢুকে পড়ে শোবার ঘরে।

শুধু কি খবর! খবর, খবরের পেছনের খবর, আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা, বিষয়ভিত্তিক সংবাদ, জেলাভিত্তিক খবর, ব্রেকিং নিউজ, আন্তর্জাতিক, উন্নয়ন সংবাদ, ক্রাইম, আরও কত কি! আবার মানুষকে সচেতন করতে ক্রাইমকে ভিত্তি করে নির্মিত হয় ক্রাইম ফিকশন। পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালে, টিভির স্ক্রিনে চোখ রাখলে বা রেডিও তে কান পাতলে পুরো দুনিয়ার সাথে আমরা যুক্ত হয়ে যাই মুহূর্তেই। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি সে মানুষগুলোর কথা যারা এই সংবাদগুলো সংগ্রহ ও উপস্থাপন করেন? সময়ের সাথে আমাদের এগিয়ে রাখতে যারা রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে সন্ত্রাসীদের ডেরা থেকে ল্যান্ডমাইন পোঁতা যুদ্ধ ক্ষেত্রে, চোরাকারবারিদের আস্তানা থেকে করোনাভাইরাসের হাসপাতালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কুড়িয়ে আনেন খবর, তাদের খবর কি আমরা রাখি?

ভাবুন তো মাত্র একদিন সব সংবাদমাধ্যম বন্ধ। কোনও খবর জানার উপায় নেই। ইংলিশ লীগের আপডেট, শেয়ার মার্কেটের সূচক, সিরিয়ার অভুক্ত শিশু, ইয়েমেনের বোমা হামলা, ইউরোপের আবিস্কার আমরা কিছুই জানলাম না। ভাল লাগবে? চলবে জীবন? তাইতো সংবাদ-কর্মীদের কোনও নিজস্ব জীবন নেই। ছুটি নেই, উইকএন্ড নেই, ভয়ডর নেই এমনকি অসুখ বিসুখও হতে নেই। কারণ সংবাদ কর্মীরা কাজে না গেলে, থেমে যায় পৃথিবী, পিছিয়ে পড়ি আমরা। তারা তো ব্রত নিয়েছেন আমাদের হারতে দেবেন না কোনও মতেই। তাইতো আমাদের এগিয়ে রাখতেই নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সাথে তাদের সব সমঝোতা। সংবাদ কর্মীদের কাজ মানে কি শুধুই এসি রুমে বসে নোট নেয়া বা শুট করা? না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় ঢুকে পড়া, ছদ্মবেশে নারী পাচারকারীদের পিছু নেয়া অথবা চোরাকারবারিদের নেটওয়ার্ক ধরতে তাদের সাথে মিশে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করা- সবই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এমন অ্যাসাইমেন্টে অনেক সংবাদ কর্মী হারিয়েছেন অঙ্গ, এমনকি জীবন।

করোনাভাইরাসে বিপন্ন পৃথিবী। উন্নত দেশগুলোও অদৃশ্য এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এই যুদ্ধে সম্মুখভাগের যোদ্ধা সংবাদকর্মীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোভিড- ১৯ এর সংবাদ সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছেন আমাদের। শুধু কি ভাইরাসের আপডেট? না। সংবাদ, আলোচনা, পর্যালোচনা। করোনার কারণে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজ, অর্থনীতি সব জানানো তাদের কাজ। গবেষণার শেষ খবর, টিকা আবিস্কারের অগ্রগতি সবকিছু জানতে পারি তাদের বদৌলতে।

বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে, সময়ের সাথে চলতে যারা আমাদের এগিয়ে রেখেছেন কেমন চলছে সেই সংবাদ কর্মীদের জীবন? লকডাউনে আমরা থাকছি ঘরে, কাটছে অলস জীবন। পরিবারকে সময় দিচ্ছি, বই পড়ছি, মুভি দেখছি, অনেকদিনের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরন করছি এবং অনেকটাই নিরাপদ থাকতে পারছি। কিন্তু সংবাদকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটছে করোনার খবর আনতে। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা, গর্ভবতী স্ত্রী বা নবজাত সন্তান, দায়িত্বের কাছে কিছুই যেন পিছুটান না। সারাদিন হাসপাতাল, ক্লিনিক ঘুরে, ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের বাড়ি হয়ে, শত মানুষের সাথে মিশে যখন তারা ঘরে ফেরেন তখন আরেক দুঃচিন্তা যে সাথে করে করোনা এনে পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেললেন না তো?

এরই মধ্যে ষোল জনের মত সংবাদকর্মী (বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে) করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকের পরিবারের সদস্যরাও এই ভাইরাসে আক্রান্ত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও সরকার বা সংবাদ মাধ্যম থেকে তাদের দেয়া হচ্ছে না সুনির্দিষ্ট কোন প্রণোদনা বা পিপিইসহ অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা।আর সরকারকেই যদি সব করতে হয় তাহলে মালিক পক্ষের দায়িত্ব কি, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকে যাচ্ছে।

তথ্য ও সত্যের পেছনে ছোটাই জীবনের একমাত্র ব্রত। এত ত্যাগের পরেও যদি তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হতেন তবে হয়ত জীবনটা কিছুটা সহজ হত। আজ করোনাভাইরাসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য বেশ কয়েকটি পেশার মানুষ পেয়েছেন সরকারি প্রণোদনা। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সম্মুখভাগের যোদ্ধা হয়েও সংবাদকর্মীরা এর আওতাভুক্ত নন কেন? যখন অন্য পেশাজীবীরা বাড়তি হিসাবে সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন, তখন দেড় মাসের বেতন না পেয়ে গত ১৭ এপ্রিল বিবৃতি দিয়েছেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে এর নেতা-কর্মীরা। তারা অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো সংবাদ কর্মীদের বেতন দিচ্ছে না, কেউ কেউ আবার বেতন কমানোর পায়তাঁরা করছে। ১১ এপ্রিল (শনিবার) তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য এবং তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলো্র প্রতি আহবান জানান। পুরো জাতির জন্য এটা লজ্জাজনক। যারা আমাদের জন্য এত ত্যাগ করছেন তারা সংসার চালাতে হিমশিম খান। সময় মতো বেতন হয়না অনেক সংবাদ মাধ্যমেই। সময় মতো ভাড়া দিতে না পারায় এবং গভীর রাতে বাসায় ফেরায় বিশেষ করে ঢাকার অনেক বাড়িওয়ালা সংবাদকর্মীদের বাসা ভাড়া দিতে চান না।

সংবাদকর্মীদের আর্থিক সম্বল নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ্ থেকে নেই কোনও প্রণোদনা, এমন কি অভিভাবকত্ব। ডিইউজে এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি আবু জাফর সূর্য তার প্রবন্ধ ‘যদি কেউ আমলে নেয়’ তে আমাদের দেশের সাংবাদিকদের দুর্দশা তুলে ধরেছেন সুচারুভাবে। তার মতে, দেশের পেশাজীবী সাংবাদিকদের শতকরা ২০ ভাগ গড়পড়তায় সারা বছর বেকার থাকেন। হাতে গোনা কয়েকটা মূল ধারার সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল ছাড়া অন্যগুলোতে যে বেতন কাঠামো তাতে কারও পক্ষে পরিবার নিয়ে ঢাকায় বাস করা সম্ভব না। অথচ সংবাদ মাধ্যমের মুনাফায় ফুলে ফেঁপে ওঠে মালিকদের সম্পদ। মূল সমস্যা বলতে তার মনে হয়েছে সংবাদকর্মীদের প্রতি মালিক পক্ষের চরম অবহেলা এবং সরকারের সাথে ধনী মালিক পক্ষের সমঝোতা। যেখানে সরকার সংবাদকর্মীদের অভিভাবক হয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মালিকদের সাথে বোঝাপড়া করবেন সেখানে তারাই মালিক পক্ষের হয়ে নিসচুপ থাকেন। অসহায় হয়ে পড়ে সংবাদকর্মীরা। তাদের বেতন বকেয়া থাকে মাসের পর মাস। বছরের পর বছর বেতন বারে না এক টাকাও।

জাতিকে উন্নত করতে হলে জাতির বিবেক খ্যাত সংবাদকর্মীদের আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সুরক্ষিত রাখতে হবে তবেই তারা সংবাদ সংগ্রহ, গবেষণা ও পরিবেশনে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে জাতিকে সঠিক তথ্য ও দিক-নির্দেশনা দিতে পারবে। আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদেরকে সাহাজ্য করতে পারি। নীতি-নির্ধারকরা তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও নিয়মিত করনে ভূমিকা রাখতে পারেন। যারা প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা সংবাদকর্মী আছেন তাদের ও তাদের পরিবারের খোঁজ খবর রাখতে পারেন। আমাদের প্রয়োজনে তারা যখন ছুটে বেড়াচ্ছেন বাহিরে তখন তাদের পরিবারের প্রয়োজনে আমরা থাকতে পারি তাদের পাশে।

লেখক ● শিক্ষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন