• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২০, ০১:৪৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৭, ২০২০, ০৩:০৪ পিএম

বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা

বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

৭ জুন ৬-দফা দিবস হিসেবে আমরা পালন করি। ২০২০ সাল বাঙালির জীবনে এক অনন্য বছর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণের জন্য এ বছরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাঙালিরাও প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ইউনেস্কো এ দিবসটি উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলিও প্রস্তুতি নিয়েছিল। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে একটি স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে।

যখন এমন ব্যাপক আয়োজন চলছে, তখনই বিশ্বব্যাপী এক মহামারি দেখা দিল। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামক এক সংক্রামক ব্যাধি বিশ্ববাসীকে এমনভাবে সংক্রমিত করছে যে, বিশ্বের প্রায় সকল দেশই এর দ্বারা আক্রান্ত এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক- সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও এ ভাইরাস থেকে মুক্ত নয়। এমতাবস্থায়, আমরা জনস্বার্থে সকল কার্যক্রম বিশেষ করে যেখানে জনসমাগম হতে পারে, সে ধরনের কর্মসূচি বাতিল করে দিয়ে কেবল রেডিও, টেলিভিশন বা ডিজিটাল মাধ্যমে কর্মসূচি পালন করছি।

১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা ঘোষণা দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, শ্রদ্ধা জানাই আমার মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেসাকে। ৭ই জুনের কর্মসূচি সফল করতে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্মরণ করি, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে শাহাদাৎবরণকারী আমার পরিবারের সদস্যদের। শ্রদ্ধা জানাই জাতীয় ৪-নেতাকে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও নির্যাতিত মা-বোনকে।

৬-দফা দাবির আত্মপ্রকাশ

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে বিরোধীদলের সম্মেলন শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির এই সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়-দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাব গৃহীত হয় না। পূর্ব বাংলার ফরিদ আহমদও প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।

৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা এ দাবি সম্পর্কে উল্লেখ করে বলে যে, পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই ৬-দফা দাবি আনা হয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংবাদিক সম্মেলন করে এর জবাব দেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। বিমান বন্দরেই তিনি সাংবাদিকদের সামনে ৬-দফা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন।

৬-দফা দাবিতে পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রদেশকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দল এ দাবি গ্রহণ বা আলোচনা করতেও রাজি হয়নি। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন ঢাকায়।

আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ৬ দফা দাবি পাস করা হয়। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এ দাবি গ্রহণ করা হয়। ব্যাপকভাবে এ দাবি প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় দলের নেতৃবৃন্দ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সফর করে জনগণের কাছে এ দাবি তুলে ধরবেন। ৬ দফা দাবির ওপর বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি পুস্তিকা দলের সাধারণ সম্পাদকের নামে প্রকাশ করা হয়। লিফলেট, প্যাল্ফম্ফলেট, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমেও এ দাবিনামা জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়।

কেন ৬ দফা দাবি

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, সে যুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গ বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এ অঞ্চলের সুরক্ষার কোনো গুরুত্বই ছিল না। ভারতের দয়ার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল পূর্ব বাংলাকে। ভারত সে সময় যদি পূর্ববঙ্গে ব্যাপক আক্রমণ চালাত, তাহলে ১২শ' মাইল দূর থেকে পাকিস্তান কোনোভাবেই এ অঞ্চলকে রক্ষা করতে পারত না। অপরদিকে তখনকার যুদ্ধের চিত্র যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে আমরা দেখি পাকিস্তানের লাহোর পর্যন্ত ভারত দখল করে নিত, যদি না বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকেরা সাহসের সঙ্গে ভারতের সামরিক আক্রমণের মোকাবিলা করত।

পূর্ব পাকিস্তানে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কোনো শক্তিশালী ঘাঁটি কখনও গড়ে তোলা হয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের একটা হেডকোয়ার্টার ছিল খুবই দুর্বল অবস্থায়। আর সামরিক বাহিনীতে বাঙালির অস্তিত্ব ছিল খুবই সীমিত। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ডন পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বাঙালিদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে- সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে অফিসার পদে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছিল ২১২৭ জন। আর পূর্ববঙ্গ থেকে ছিল মাত্র ৬০ জন। তাও জেনারেল, মেজর জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার পদগুলোতে একজনও পূর্ববঙ্গ থেকে ছিলেন না। কর্নেল পদে যদিও একজন ছিলেন, তিনি বাংলা বলতেন না। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে সর্বোচ্চ পদে তা-ও লে. কর্নেল পদে মাত্র ২ জন বাঙালি অফিসার ছিলেন। অথচ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় বাঙালি সৈনিকেরাই সব থেকে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই যুদ্ধের পর তাসখন্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা তাসখন্দ চুক্তি নামে পরিচিত। সেখানেও পূর্ববঙ্গের স্বার্থের বা নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়।

একটু পিছন ফিরে তাকালে আমরা দেখি যে, বাঙালির বিরুদ্ধে সব সময় পাকিস্তানের শাসক চক্র বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ করেছে। তারা প্রথম আঘাত হানে বাংলা ভাষা, যা আমাদের মাতৃভাষার ওপর। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত শুরু করে। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করে বাঙালিরা। সে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে। মূলত তখন থেকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে হবে।

বাঙালিরা সব সময়ই পশ্চিমাদের থেকে শিক্ষা-দীক্ষা, সাংস্কৃতিক চর্চায় সমৃদ্ধ ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল এ অঞ্চলের মানুষের। জনসংখ্যার দিক থেকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি। ৫৬ ভাগ মানুষের বসবাস ছিল পূর্ববঙ্গে।

পূর্ববঙ্গের উপার্জিত অর্থ কেড়ে নিয়ে গড়ে তোলে পশ্চিম পাকিস্তান। বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করাই ছিল শাসকদের একমাত্র কাজ। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে জয়লাভ করে। মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু ৯২ক ধারা অর্থাৎ ইমার্জেন্সি জারি করে নির্বাচিত সরকার বাতিল করে দেয়। পূর্ববঙ্গে চালু করে কেন্দ্রীয় শাসন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখনও ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করেন। এভাবেই বারবার আঘাত আসে বাঙালিদের ওপর।

৬ দফার প্রতি জনসমর্থন

আইয়ুব খানের নির্যাতন-নিপীড়নের পটভূমিতে যখন ৬ দফা পেশ করা হয়; অতি ত্রুত এর প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে এ এক বিরল ঘটনা। কোনো দাবির প্রতি এত দ্রুত জনসমর্থন পাওয়ার ইতিহাস আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমগ্র পূর্ব বাংলা সফর শুরু করেন। তিনি যে জেলায় জনসভা করতেন, সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতো, গ্রেপ্তার করা হতো। জামিন পেয়ে আবার অন্য জেলায় সভা করতেন। এভাবে পরপর ৮ বার গ্রেপ্তার হন মাত্র দুই মাসের মধ্যে। এর পর ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ঢাকায় ফিরে আসার পর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ৯ মে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করে। একের পর এক মামলা দিতে থাকে। একই সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয়। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ছাত্রনেতা, শ্রমিক নেতাসহ অগণিত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে মামলা দায়ের করে।

 


১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ দিবস পালন উপলক্ষে জনসভা করে। জনসভায় জনতা ৬ দফার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। ৩০ মে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির (ওয়ার্কিং কমিটি) সভা হয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী। ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয় এবং হরতাল সফল করার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের অনেক সভা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িতে অনুষ্ঠিত হতো।

৭ জুনের হরতালকে সফল করতে আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে তিনি দিকনির্দেশনা দেন। শ্রমিক নেতা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের দমন-পীড়ন-গ্রেপ্তার সমানতালে বাড়তে থাকে। এর প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। ৬ দফা আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব বাংলার সকল স্তরের মানুষ- রিকশাওয়ালা, স্কুটারওয়ালা, কলকারখানার শ্রমিক, বাস-ট্রাক-বেবিট্যাক্সিচালক, ভ্যানচালক, দোকানদার, মুটে-মজুর- সকলে এ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান যে কোনো উপায়ে এই আন্দোলন দমন করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেয় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে। কিন্তু তাদের শত নির্যাতন উপেক্ষা করে বাংলাদেশের মানুষ ৭ জুনের হরতাল পালন করে ৬ দফার প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়ে দেন। পাকিস্তান সরকার উপযুক্ত জবাব পায়। দুঃখের বিষয় হলো, বিনা উস্কানিতে জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন নিহত হন। আন্দোলন দমন করতে নির্যাতনের মাত্রা যত বাড়তে থাকে, সাধারণ মানুষ তত বেশি আন্দোলনে শামিল হতে থাকেন।

৭ জুন হরতাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন :'১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছেন। তাঁরা ৬ দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তিস্বাধীনতা চায়; শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তাঁরা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল' (কারাগারের রোজনামচা পৃ. ৬৯)।

১৯৬৬ সালের ১০ ও ১১ জুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় হরতাল পালনের মাধ্যমে ৬ দফার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করায় ছাত্র-শ্রমিক ও সাধারণ জনগণকে ধন্যবাদ জানানো হয়। পূর্ববঙ্গের মানুষ যে স্বায়ত্তশাসন চায়- তারই প্রমাণ এই হরতালের সফলতা। এ জন্য সভায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ১৭, ১৮ ও ১৯-এ জুন নির্যাতন-নিপীড়ন প্রতিরোধ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীর বাড়ি বাড়ি কালো পতাকা উত্তোলন এবং তিন দিন সকলে কালো ব্যাচ পরবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। হরতালে নিহতদের পরিবারগুলোকে আর্থিক সাহায্য এবং আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একটা তহবিল গঠন এবং মামলা পরিচালনা ও জামিনের জন্য আওয়ামী লীগের আইনজীবীদের সমন্বয়ে একটি আইনগত সহায়তা কমিটি গঠন করা হয়। দলের তহবিল থেকে সব ধরনের খরচ বহন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আন্দোলনের সকল কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

৬ দফা দাবির ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন আরও ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সভা-সমাবেশ, প্রতিবাদ মিছিল, প্রচারপত্র বিলিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই দাবির প্রতি ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু হয়।

এদিকে সরকারি নির্যাতনও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে যত বেশি নির্যাতন আইয়ুব-মোনায়েম গং চালাতে থাকে, জনগণ তত বেশি তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সকল নিপীড়ন উপেক্ষা করে আরও সংগঠিত হতে থাকেন।

১৯৬৬ সালের ২৩ ও ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং আন্দোলন দ্বিতীয় ধাপে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ আন্দোলন কেন্দ্র থেকে জেলা, মহকুমা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্রতর হতে থাকে। সরকারও নির্যাতনের মাত্রা বাড়াতে থাকে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্তদের একের পর এক গ্রেপ্তার করতে থাকে। অবশেষে একমাত্র মহিলা সম্পাদিকা অবশিষ্ট ছিলেন। আমার মা সিদ্ধান্ত দিলেন- তাঁকেই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হোক। আওয়ামী লীগ সে পদক্ষেপ নেয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

পাকিস্তান সরকার নতুন চক্রান্ত শুরু করল। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে নিয়ে যায়। অত্যন্ত গোপনে রাতের অন্ধকারে সেনাবাহিনীর দ্বারা এ কাজ করানো হয়। এর পর তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেওয়া হয়, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে অধিক পরিচিতি পায়। এই মামলায় ১ নম্বর আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে আরও ৩৪ জন সামরিক ও অসামরিক অফিসার এবং ব্যক্তিদের আসামি করে।

অপরদিকে ৬ দফা দাবি নস্যাৎ করতে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু নেতা দিয়ে ৮ দফা নামে আরেকটি দাবি উত্থাপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। তবে এতে তেমন কাজ হয় না। উঁচু স্তরের কিছু নেতা বিভ্রান্ত হলেও ছাত্র-জনতা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রতিই ঐক্যবদ্ধ থাকেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা অর্থাৎ রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান মামলার মূল অভিযোগ ছিল- আসামিরা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তব্য ছিল :আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ, সংখ্যাগুরু। আমরা বিচ্ছিন্ন হবো কেন? আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই, স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। যারা সংখ্যালগিষ্ঠ, তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারে; সংখ্যাগরিষ্ঠরা নয়।

এই মামলা দেওয়ার ফলে আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। বাংলার মানুষের মনে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও চেতনা শানিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়। ছাত্ররা ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জেলা, মহকুমায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেই কোর্ট বসিয়ে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা শুরু হয়। অপরদিকে জেল-জুলুম, গুলি, ছাত্র হত্যা, শিক্ষক হত্যাসহ নানা নিপীড়ন ও দমন চালাতে থাকে আইয়ুব সরকার।

পাকিস্তানি সরকারের পুলিশি নির্যাতন, নিপীড়ন ও দমনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে। তাঁরা রাস্তায় নেমে আসে। সরকারপন্থি সংবাদপত্র থেকে শুরু করে থানা, ব্যাংক, সরকারের প্রশাসনিক দপ্তরে পর্যন্ত হামলা চালাতে শুরু করে। সমগ্র বাংলাদেশ তখন অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়।

'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করো', 'জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব', 'শেখ মুজিবের মুক্তি চাই'- এ ধরনের স্লোগানে স্লোগানে স্কুলের ছাত্ররাও রাস্তায় নেমে আসে। এরই এক পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এই মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দিখানায় হত্যা করা হয়। মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাঁদের আশঙ্কা হয়- এভাবে শেখ মুজিবকেও হত্যা করবে। সাধারণ মানুষ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। জনতা মামলার বিচারক প্রধান বিচারপতির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান।

প্রচণ্ড গণআন্দোলনের মুখে ২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে একটা সামরিক জিপে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ধানমন্ডির বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। অন্য বন্দিদেরও মুক্তি দেয়।

ভাষা আন্দোলন-স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা : ৬ দফার সফলতা

গণআন্দোলনে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতা দখল করে সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান। ৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন- পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে 'বাংলাদেশ'। কিন্তু বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পায়; পায় জাতিরাষ্ট্র স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক ● আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী

আরও পড়ুন