• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২০, ০৮:০৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৬, ২০২০, ০৮:৩৯ এএম

হে বীর, জানি সিনহা ফিরে আসবে ওদের একজন হয়ে

হে বীর, জানি সিনহা ফিরে আসবে ওদের একজন হয়ে

"আঠারো বছর বয়স যার, যুদ্ধে যাবার তারই তো শ্রেষ্ঠ সময়।"

কবি সুকান্ত কি জানতেন যে কোনো একদিন এই অপরাজেয় বাংলার কোনো এক অদম্য তরুণ তার দেশমাতৃকার তরে নিবেদিত হবেন পরিণত বীর যোদ্ধারূপে? কবির হয়তো জানা হয়নি চির প্রস্থানকালে যে, তার সেই কাব্যের বিদ্রোহী মশালের বিচ্ছুরিত স্ফুলিঙ্গ হয়ে কোন এক অষ্টাদশী তরুণ সত্যিই বাংলার সার্বভৌমত্ব অর্জনের দুর্নিবার প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সশস্ত্র রণাঙ্গণে। হয়তো তার দেখে যাওয়া হয়নি সেই উদীয়মান তারুণ্যের মুঠোয় ধরা জিউসের বজ্রবাণ; যার আঘাতে বিপর্যস্ত শত্রু সেনার বঙ্গভোগের বিলাসী স্বপ্নের পতন হয়েছিল, এসেছিল স্বাধীনতা। কিন্তু আঠারোর ঘর ছুঁই ছুঁই সেই তরুণের চঞ্চল তর্জনীর ঠেসে ধরা ট্রিগারের ইশারায় ছুটে যাওয়া তপ্ত শিশার আঘাত শত্রুর বুক চিড়ে ঠিকই ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন বাংলার মানচিত্র। অষ্টাদশী তারুণ্যের তরে নিবেদিত চিরঞ্জীব কবি সুকান্তের সেই অদ্বিতীয় কাব্যের প্রতিটি চরণে তা ঢেলে ছিল অমরত্বের সুধা। শুধু মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনেই থেমে থাকেনি তার দেশপ্রেমবোধ। অর্জিত সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমৃত্যু এই মাতৃভূমির অতন্দ্র প্রহরীর গুরুদায়িত্ব পালনে সেই দুঃসাহসি তরুণ নিজেকে গড়ে তুলেছিলো স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম মিলিটারি লংকোর্সের কমিশনপ্রাপ্ত একজন  সুপ্রশিক্ষিত সৈনিক হিসেবে।

আজ আমার খুব মনে পড়ে, জাতশত্রুর তপ্ত বুলেটের নির্মমতায় ঝরে পড়া সুদর্শন সেই তারুন্যোদ্দীপ্ত সৈনিকের কথা। বিনিদ্র রজনীতে জেগে থাকা প্রাণহীন দু'চোখ শূন্য আকাশের পটে চেয়ে দেখে- দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লেফট্যানেন্ট শেখ জামালের উদ্দীপ্ত তারুণ্যে উদ্ভাসিত সেই হাসিমুখ। যার নাতিদীর্ঘ জিয়নপটে লেখা এক অকুতোভয় বীরের মহাকাব্যিক আত্মকথায় অনুপ্রাণিত  হয়ে আজো গগন কাঁপানো হুঙ্কার ছেড়ে, দৃপ্ত বাহুর ঝাঁকুনি তুলে লাল-সবুজের ঐ উড়ন্ত পতাকার তরে সগৌরবে সালাম ঠুকে দেয় বাংলার সূর্যসেনারা। 

বিস্তীর্ণ চরাচরজুড়ে থাকা রাতে আমার অজান্তেই ছলকে ওঠে বুকের রক্ত, আবেগের প্রলয়বাণে দৃপ্ত চোয়াল ঠেসে ধরে অসহ্য যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ৷ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে- "কি অপরাধ ছিল আমার ভাইয়ের?- হে বীর, তোমার পদাঙ্ক অনুসরণে সহন আর সামর্থ্যের সীমালঙ্ঘণ করেছিল সে। দেশের প্রতি নিবেদিত হতে তোমারই মত নিষ্ঠাবান, সেনাদর্শের অনুসারী সেই সুপ্রশিক্ষিত প্রজন্ম-সেনানির শক্ত মুঠোয় ধরা শাণিত তরোয়ারির ঝলকে প্রতিফলিত হয়েছিল তোমার দুর্বিনত তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি। যার অর্জনে বিমোহিত আমি মাথা উঁচু করে জানান দিয়েছিলাম- ''শহীদ লেফট্যান্ট শেখ জামাল, তুমি ঘুমাও শান্তিতে। তোমার দেখানো সেই পথে  ঐ দেখ বীরদর্পে এগিয়ে আসছে বেঙ্গল ইনফ্রেন্টি ডিভিশনের চৌকস যোদ্ধা, প্রজন্মের অতন্দ্র প্রহরী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুরন্ত কম্বেট মার্ক্সম্যান মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান!" আজ সেই প্রাপ্তি আমার পতনের প্রহারে যাতনার প্রলয় তোলে অস্তিত্বে।  ও এসেছিলো আলোকিত আগামী হয়ে। কিন্তু হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

আজ আমার ক্লান্ত দু'কাঁধের ওপর মাথাটা নুয়ে পড়েছে। এলোমেলো পায়ে যখন হেঁটে গেছি গোরস্তানের পথে, আমার কাঁধে তখন হিমালয়ের মত ভারি বোঝা হয়ে চেপে বসেছিলো চারকোনা কাঠের কফিনে বদ্ধ এক অকাল প্রয়াত স্বপ্নের লাশ। কেন? কি দোষ ছিল তার মাঝে জাগ্রত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়? অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা শাপদের বিষবাণে কেন জর্জিত সত্ত্বা আমার? বাংলাকে ঘিরে কেন এত ষড়যন্ত্রের নাগপাশ? মুহূর্তে কেড়ে নিয়ে গেল বৃদ্ধা মায়ের একমুঠো জিয়ন পুঁজি। বিতর্কিত করলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের বীর যোদ্ধাদের সোনালী ঐতিহ্য। মর্মাহত করলো কোটি বাঙালিকে, কাঁপিয়ে দিল বীর সেনানিদের অস্তিত্ব! আর অবাঞ্চিত সংঘাতের অশনি সংকেতে বাজালো অজানা আতঙ্কের সাইরেন!

আমি বাংলা মায়ের বুকে চির শান্তির নিদ্রায় সঁপে এসেছে আমার দুরন্ত সিনহার প্রাণহীণ লাশ। ক্লান্ত হয়েছি, মর্মাহত চিত্তের ভারে। কিন্তু এখনও হারিনি, আমি হার মানিনি। শত্রু জানুক, আমি পচে গেলে বিলিন হতে মাটি চেপে আসিনি তারে৷ আমি এক অদম্য সাহসী সিনহার দেশাত্মবোধ আর দুঃসাহসি দুরন্তপনার বীজ বপন করেছি দেশমাতৃকার গর্ভে। কোনো এক উদ্ভাসিত আগামীর ভোরে উদীত সূর্যের স্বর্গীয় চুম্বনে উন্মোচিত হবে তার ভ্রূণ। শিশিরস্নাত সতেজ পল্লবের প্রস্ফুটনে বিকশিত হবেই সে। ক্রমেই সুবিশাল বীরাঙ্গ মহিরুহ হবে, সুবিস্তৃত শাখা-প্রশাখা আর অজস্র পত্র-পল্লবের পরতে পরতে প্রতিধ্বনিত হবে জাগরণের রণসঙ্গীত। সিনহারা আসবেই বীর। যতকাল তোমার দুঃসাহসি মহাকাব্যের বিদ্রোহী চরণের আবৃতি ধ্বনিত হবে, ওরা আসবে। ওরা আসবে সেই প্যারেড গ্রাউন্ডের বুকে দৃপ্ত পদাঘাতে শত্রুবিনাশী আগামীর বার্তা নিয়ে।

এ আঁধার কাটবে জানি। এখনো জাগ্রত বাংলার বুকে কোটি বাঙালিরে মমতায় পোষে জনকের উত্তরসূরী। মৃত্যুর সাথে যে সন্ধি করে ফিরে এসেছে জাতিসত্ত্বার কাণ্ডারি হতে। সর্বহারানো শোকের মাতম বুকে চেপে এ মাটির তরে আবির্ভূত হয় সেই বঙ্গনন্দিনী। শত্রু বিনাশে যার প্রলয়ভূষণ জাগে শত্রুবিনাশী এক আগ্রাসী বাঘিনীর মত। আমি ব্যথা ভুলি তার ছায়ে। আর প্রজ্জ্বলিত জিয়ন মন্ত্র কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে আমার রক্তের বিদ্রোহী বহ্নিদাহে আরো উজ্জ্বল হয় জয় বাংলা। চোখে ভাসে আমার আদনান সিনহার লাশ, অবাঞ্চিত শোক সঞ্চিত শক্তিরূপে আবর্তিত হয় পূঞ্জিভূত দ্রোহের বিস্ফোরণের অপেক্ষায়।

আমার সিনহার আত্মহুতিতে প্রতিটি বদ্ধভূমি হতে, প্রতিটি গোরস্তানের অন্ধকার কবরের বুক চিরে, প্রতিটি সৈনিকের মৃত সত্ত্বার পুনর্জাগরণে, উজ্জীবিত তারুণ্যের অনীর্বাণ শিখা হয়ে জ্বলবে জীবন্ত মশাল। ওরা আসবে বাংলার সীমান্ত জুড়ে দুর্ভেদ্য বলয় গড়ে দিতে। ওরা আসবে হে বীর, তোমার রক্তের ঋণশোধে; সার্বভৌম বাংলার কোনো রত্নগর্ভা জননীর জঠর জুড়ানো কীর্তিমানের রূপে।

ওরা স্বপ্নচারী প্রজন্মযোদ্ধা হয়ে আসবে ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন জাতিসত্ত্বার ত্রাতা হতে। ওরা অকুতোভয়, মৃত্যুঞ্জয়ী দামালের মত রুখে দেবে সকল মিথ্যার বেসাতী। আমি প্রতিটি নির্ঘুম রাতে তোমার গল্প শোনাবো তাদের। ওরা আসবে, আমি জানি। সেদিন ওদের মাঝেই না হয় খুঁজে নেব আমার ডানপিটে সিনহার মুখ। আমার জিয়ন সায়াহ্নের সূর্যাস্ত অবদি আমি তাদের বুকে শত্রুবিনাশী দীক্ষার বার্তা দিয়ে যাবো এমনই ক্লান্তিহীন লেখনিতে। আর শোনাবো সেই মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র-
"উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই,
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।"

লেখক: সহ-সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।

মতামত অংশে প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজেস্ব অভিমত। এর যেকোনো বিষয়ের দায়বদ্ধতা লেখকের একান্ত নিজেস্ব।