• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০, ১১:২৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০, ০২:৪১ পিএম

বায়ু দূষণ

যান্ত্রিক যানবাহনই বায়ু দূষণের জন্য বেশি দায়ী

যান্ত্রিক যানবাহনই বায়ু দূষণের জন্য বেশি দায়ী
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, স্টামর্ফোড ইউনিভার্সিটি বাংলাদশে। ফাইল ছবি

২০১৮ সালে আমাদের এই প্রাণের শহর ঢাকাকে বসবাস অযোগ্য ঘোষণা করেছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট। আর এই বসবাস অযোগ্য হওয়ার একটি অন্যতম কারণ ঢাকার পরিবেশ। ঢাকার পরিবেশ দিনে দিনে আরও বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদানটি হলো বায়ু, যেই উপাদান ছাড়া আমরা বেঁচে থাকার কথা চিন্তা করতে পারি না। সেই উপাদানটি আমাদের অসচেতনার কারণে অনেক বেশি ক্ষতিগস্ত। সবাই জেনেও এমন সব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছি যার কারণে বায়ু দূষণের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঠিক তেমনি দূষণের কারণে আমাদের ভোগান্তির পরিমাণ ও বেড়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন যৌথ উদ্যোগে State of Global Air–2019 প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন আনুযায়ী বিশ্বের দশটি দেশের মধ্যে বায়ু দূষণে মৃত্যুর সংখ্যায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে বায়ু দূষণের কারণে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। রিপোর্টে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহারের জন্য পঞ্চম ঝুঁকির কারণ হিসেবে বায়ু দূষণকে দায়ী করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন আনুযায়ী বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ। প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং আরও বলা হয় উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলি চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি চগ ২.৫ দূষণের শিকার হয়। বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী গড় আয়ু ১ বছর ৮ মাস কমিয়ে ফেলে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় আয়ু আরও কমে গিয়ে ১ বছর ৭ মাসে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বের অনেক অংশে বায়ু দূষণের মাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক। World Health Organization (WHO)এর তথ্যানুযায়ী ৯০% মানুষ দূষিত বায়ু গ্রহণ করছে। ফলস্বরূপ, প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ বহিরাগত বায়ুদূষণ এবং গৃহস্থলীর বায়ু দূষণের পার্টিকুলেট ম্যাটারের এক্সপোজারের কারণে মারা যায়। এগুলির মধ্যে, বহিরাগত বায়ু দূষণের কারণে ৪.২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। বায়ু দূষণের কারণে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। Do‘t Pollute Our Future!!Ó  রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী, সারাবিশ্বে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত বায়ু দূষণের ফলে প্রতিবছর ৫ বছর বয়সের নিচে ৫ লাখ ৭০ হাজার শিশু শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, যেমন- নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগের কারণে মারা যায়। সর্বশেষ Air Quality Database-2018 অনুসারে, মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ৯৭% শহরের বায়ু মান WHO এর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে। WHO এর তথ্যানুযায়ী প্রতিবছর বায়ু দূষণের ফলে ২১% নিউমোনিয়া, ২০% স্ট্রোক, ৩৪% হৃদরোগ, ১৯% ঈঙচউ এবং ৭% ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণে মারা যায়।

World Air Qualitz Report-2018 অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এয়ারভিজ্যুয়ালের বিশ্বমান প্রতিবেদন ২০১৮ অনুযায়ী শহরের তালিকায় ঢাকা ও রাজধানী হিসেবে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বাতাসে চগ ২.৫ এর গড় মানমাত্রা ৯৭.১ ক্রস/স ৩। বিশ্বে প্রত্যেকটি দেশ বায়ু দূষণের কবলে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের এয়ারভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ুর দেশ গুলোর তালিকায় রয়েছে এশিয়া এবং মধ্য প্রাচ্যের ১০টি দেশ। বিশ্বের ৭৩টি দেশের বায়ুর মানের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। চগ ২.৫ এর গড় মান মাত্রার উপর নির্ভর করে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়। বাংলাদেশের এর পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পাকিস্তান (৭৪.৩ ক্রস/স ৩ ), তৃতীয় অবস্থানে আছে ভারত (৭২.৫৪ ক্রস/স ৩ )। চতুর্থে রয়েছে আফগানিস্তান (৬১.৮ ক্রস/স ৩)তারপর বারহাইন (৫৯.৮০ ক্রস/স ৩ )। এরপর রয়েছে যথাক্রমে মঙ্গোলিয়া, কুয়েত, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নাইজেরিয়া। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দূষিত দেশ হিসেবে তালিকার নিচের দিকে রয়েছে যথাক্রমে আইসল্যান্ড (৫.০৫ ক্রস/স ৩ ) ফিনল্যান্ড (৬.৫৭ ক্রস/স ৩ ), অস্ট্রেলিয়া (৬.৮২ ক্রস/স ৩ ), এস্তোনিয়া (৭.২ ক্রস/স ৩ ) ও সুইডেনের (৭.৩৭ ক্রস/স ৩ )। এছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ৩০ শহরের মধ্যে ২২টি ভারতের ৫টি চীনের, ২টি পাকিস্তানের ও ১টি বাংলাদেশের। শহরের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ভারতের গুরু গ্রাম, যার চগ ২.৫ গড় মান মাত্রা ১৩৫.৮ ক্রস/স ৩ নরওয়ে ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিলু (ঘওখট) এর সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৬ সালে বায়ুদূষণের উৎস চিহ্নিত বিষয়ক এক গবেষণা করে। গবেষণা অনুযায়ী বায়ু দূষণের জন্য দায়ী উৎস সমূহের পরিমাণ যথাক্রমে ইটের ভাটা ৫৮ শতাংশ, যানবাহনের ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জ্বালানি বা কাঠ পোড়ানোর ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ৬ শতাংশ। এসব উৎস থেকে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, পার্টিকুলেট ম্যাটার (চগ), কার্বন মনোক্সাইড (ঈঙ), সালফার অক্সাইডসমূহ (ঘঙ ঢ ) এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ (ঝঙ ঢ ) যা বায়ুকে দূষিত করছে। 

ঢাকার বিভিন্ন যায়গায় অপরিকল্পিত ভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ ও রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত এবং সংস্কারের কার্যক্রমের নামে রাস্তাঘাট খোঁড়ার কারণে বায়ুতে ধূলিকণা মিশ্রিত হয়ে যায়। ড্রেন পরিষ্কারের পর বর্জ্য সমূহ রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা হয় যা ধূলা-দূষণের জন্য দায়ী। উপরন্তু ড্রেনের বর্জ্যে প্যাথজেনের উপস্থিতি থাকার দরুন নির্মল বায়ু হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর। এছাড়াও বায়ুতে সীসা, ফরমালডিহাইড, তামা, সীসা ও ক্যাডমিয়াম ইত্যাদির উপস্থিতি বায়ুকে দূষিত করে। বায়ু দূষক গুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। গ্যাসীয় ও পার্টিকুলেইট ম্যটার এর ফলে নাক মুখ জ্বালা পোড়া করা, মাথা ঝিম ঝিম করা, মাথা ব্যাথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি সমস্যা ছাড়াও ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, যক্ষা কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, হার্ট অ্যাটাক, যকৃত সমস্যা ও নিউমোনিয়া রোগ হয়। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত Cancer Facts & amp;Figures-2018 এর তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সালে প্রায় ৬,০৯,৬৪০ জন ক্যান্সার রোগী মৃত্যুর ঝুঁকিতে ছিল। এছাড়াও শুধুমাত্র শ্বাসন্তন্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা প্রায় ২,৫৩,২৯০ জন এবং শ্বাসন্তন্ত্রে ক্যান্সারে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ১৫,৮৭৭। National Institute of Cancer Research & Hospital (NICRH) এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৮ সালে মোট ২৬৯ জন ক্যান্সারের কারণে মারা যায়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী মৃত্যু হয়েছে ফুসফুস ক্যান্সারে (৫৪ জন)। UNICEFএর এক গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু বায়ু দূষিত অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে, যার মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস করে। 

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে ঢাকার ১২টি স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে চগ ২.৫ এর পরিমাণ পর্যালোচনা করে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, যেসব এলাকায় গাড়ি নেই সে সব এলাকায় চগ ২.৫ এর মান সবচেয়ে কম (৪০ চগ ২.৫ ), কিছু এলাকায় অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচল করে সেই এলাকা গুলোতে চগ ২.৫ এর পরিমাণ সব তুলনামূলক কম (৪৬.০ চগ ২.৫ ), অন্যদিকে যে সব এলাকায় যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক উভয় গাড়ি রয়েছে সে এলাকাতে চগ ২.৫ এর পরিমাণ তুলনামূলক একটু বেশি (৮৪.৭ চগ ২.৫ ), যেসব এলাকাতে যান্ত্রিক গাড়ি চলাচল করে সেখানে চগ ২.৫ এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি (১৭২.২ চগ ২.৫ )।

গবেষণা থেকে বলা যায় যে সব এলাকায় যান্ত্রিক গাড়ির পরিমাণ বেশী সেসব এলাকায় বায়ু দূষণের পরিমাণও বেশী।

আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আইনীভাবে বায়ু দূষণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদের নিজেদের বায়ু দূষণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং অন্যদেরকে বায়ু দূষণের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভার্টর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজি গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি ও ফিটনেস বিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ী ব্যবহার না করে পাবলিক পরিবহন ব্যবহারের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করতে হবে। সকলকে সাইকেল ব্যবহারের ব্যপারে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শিশু স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি এই বায়ুদূষণ এবং এ থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে সুসমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। একইসঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ একান্তভাবে প্রয়োজন। জনগণকে বায়ু দূষণের সামগ্রিক বিষয়ে তথ্যপ্রদান, শিক্ষিতকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণ অত্যন্ত জরুরি। সব কিছুর পাশাপাশি সকলকে সাইকেলিং এর ব্যপারে উৎসাহী করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, স্টামর্ফোড ইউনিভার্সিটি বাংলাদশে এর বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, বাংলাদেশ এর পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যুগ্ম সম্পাদক এবং বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক।

আরও পড়ুন