• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০, ০৪:২৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০, ০৪:২৭ পিএম

জাতিসংঘে জাতির জনকের মহৎকণ্ঠ

জাতিসংঘে জাতির জনকের মহৎকণ্ঠ
বর্ষীয়াণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংসদ তোফায়েল আহমেদ - ফাইল ফটো।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরসঙ্গী হিসেবে আন্তর্জাতিক ফোরামে তাঁর হিমালয়সম উপস্থিতি চাক্ষুষ করার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, ওআইসি সম্মেলন, কমনওয়েলথ সম্মেলন ও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মাঝে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। দুনিয়ার মেহনতী মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক জাতির জনকের জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সেদিন মুগ্ধ হয়েছিল। করোনা মহামারীর এই দুঃসময়ে সীমিত আকারে জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ তথা গৌরবময় ‘মুজিববর্ষ’ পালনের দিনগুলোতে স্মৃতির পাতায় সযতনে সঞ্চিত অনেক কথাই আজ আমার মানসপটে ভেসে উঠছে। 

চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে সদস্যপদপ্রাপ্তির ৪৬ বছর পূর্ণ হলো বাংলাদেশের। এ উপলক্ষে মনে পড়ছে ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কথা। যেদিন জাতির জনক জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ৪৬ বছর আগের সেই দিনটি ছিল বুধবার। জাতির জনকের সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯-তম অধিবেশনে যোগদান স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো জ¦লজ¦লে করে। বছর ঘুরে দিনটি এলে অনুপম সেই স্মৃতিময় দিনগুলো আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। আমাদের জাতীয় জীবনে দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একাধিকবার যোগদান করেছেন। জাতির জনকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করেছেন। প্রিয় মাতৃভাষার প্রতি আমাদের এই প্রগাঢ় ভালোবাসার ফলেই ১৯৫২-এ সংঘটিত মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি-বিজড়িত শহীদ দিবস ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ১৯৯৯ সন থেকে বিশ্বজুড়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে উদযাপিত হচ্ছে। এর শুভ উদ্বোধনটি হয়েছিল মূলত মানব জাতির সর্বোচ্চ ফোরাম জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ প্রদানের মধ্য দিয়ে। ঐতিহাসিক এই দিনটির শুভ সূচনা হয়েছিল ’৭৪-এর ১৭ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬-তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এই ঘোষণাটি শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।’ স্বাধীন বাংলাদেশের এই অর্জন মূলত বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্যেরই প্রতিশ্রুতি। এই শুভসন্ধিক্ষণকে সামনে রেখেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর সফরসূচি ঠিক করা হয়। সেই হিসেবে ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল সাড়ে সাতটায় বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে আমরা ঢাকা ত্যাগ করি। সর্বমোট ২৪ সদস্যের সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ডঃ নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ নূরুল ইসলাম, গ্যাস ও ওয়েল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ডঃ হাবিবুর রহমান, এম আর সিদ্দিকী এমপি, আসাদুজ্জামান খান এমপি, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং আরো অনেকে। লন্ডনে যাত্রাবিরতির পর ওইদিন রাতে প্যান অ্যামের নিউইয়র্ক ফ্লাইটে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে আটটায় আমরা কেনেডি বিমান বন্দরে অবতরণ করি। বিমান বন্দরে সংবর্ধনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এস এ করিম। বিমান বন্দর থেকে আমাদের হোটেল ‘ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া’য় নিয়ে যাওয়া হয়। 

‘ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া’য় বঙ্গবন্ধুর হোটেল কক্ষে দর্শনার্থীদের আগমন ছিল চোখে পড়ার মতো। অধিবেশনে আগত প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ লোকজনও বঙ্গবন্ধুর দর্শনপ্রার্থী ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার হোটেল কক্ষে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর আসে প্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সদ্য সদস্যপদপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা। নিউইয়র্ক সময় বিকাল ৩টায় এবং বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় যখন বক্তৃতা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষিত হয়, তখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে চতুর্দিকে তাকিয়ে পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতৃবৃন্দকে সম্বোধন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে ‘মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।’ তিনি আরো বলেন, ‘জাতিসংঘের সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে তারই জন্যে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’ সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন, আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি বর্তমানে দেশটির রাষ্ট্রপতি আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা। তাঁকে আমি ইতোপূর্বেই কাছ থেকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে ওআইসি সম্মেলনে নেওয়ার জন্য ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারে বুমেদিনের বিশেষ বিমান নিয়ে যে পাঁচজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। বক্তা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণার সাথে সাথে পরিষদের সভাপতি স্বীয় আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নিয়েছিলেন। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৪৫ মিনিট বক্তৃতার শেষে সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ বিপুলভাবে করতালি দিয়ে আলিঙ্গন করে অভিনন্দিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। অভাবনীয় সেই দৃশ্য। নিজ চোখে না দেখলে লিখে বোঝানো সম্ভবপর নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। আমার মনে পড়ে, অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যগণ আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তোমরা গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছো, যিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতা নন, এশিয়ার নেতা নন- তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’

বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজীতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ কারণ, মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সংগ্রাম তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন। ১৯৫২-এর অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনেও তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম।... কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না?... পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’ পৃষ্ঠা-২২৮। নিজের কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সদাজাগ্রত বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষায় বক্তৃতা প্রদানের সিদ্ধান্তটি আগেই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজী ভাষান্তর করার গুরু দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল জনাব ফারুক চৌধুরীর (প্রয়াত) উপর। তিনি ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার। ছুটিতে দেশে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, ‘ফারুক, তোমার ছুটি নাই। তোমাকে এখানে কাজ করতে হবে।’ কাজগুলি হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর আসন্ন বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ; বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) সাথে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করতে প্রতিনিধি দল নিয়ে বার্মায় গমন। বার্মা থেকে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু ফারুক চৌধুরীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার লন্ডন যাওয়া চলবে না। তুমি আমার সাথে নিউইয়র্ক যাবে এবং জাতিসংঘে আমি বাংলায় যে বক্তৃতাটি করবো, তাৎক্ষণিকভাবে তুমি সেই বক্তৃতার ইংরেজী ভাষান্তর করবে।’ ফারুক ভাই সুন্দর ইংরেজী বলেন ও লিখেন। প্রথমে ফারুক ভাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখন পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে যেন তুমিই প্রধানমন্ত্রী। তবে, পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।’

মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদানের বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তটি ছিল তাঁর সমগ্র জীবনের স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক পরিণতি। সেদিন বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, তিনি যেন বহুযুগ ধরে এমন একটি দিনের অপেক্ষায় নিজকে প্রস্তুত করেছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ, ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন সর্বাগ্রে। তাঁর নেতৃত্বেই সেদিন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ সফল ধর্মঘট পালন করেছিল। এরপর ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা আন্দোলনের ২য় পর্বে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে তিনি কারাগারে বন্দী অবস্থাতেই আমরণ অনশন শুরু করেন। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালে ছাত্ররাই এককভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল। এবার আমার বিশ্বাস ছিল, জনগণ এগিয়ে আসবে। কারণ জনগণ বুঝতে শুরু করেছে যে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করতে পারলে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খল আবার পরতে হবে।’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃষ্ঠা-১৯৭)। সংগ্রামী এই বোধ থেকে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব মাতৃভাষার শৃঙ্খল মোচনে অনশনরত অবস্থায় দৃপ্ত অঙ্গীকারে স্বীয় অভিপ্রায় ব্যক্ত করে লিখেছেন, ‘ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। ঊরঃযবৎ ও রিষষ মড় ড়ঁঃ ড়ভ ঃযব লধরষ ড়ৎ সু ফবধফ নড়ফু রিষষ মড়.’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৯৭)। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় এমনি মরণপণ অঙ্গীকার ছিল তাঁর। এই প্রতীজ্ঞার বলে বলবান হয়েই জাতিসংঘের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন নিজ ইচ্ছার কথা তথা মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদানের কথা।

মাতৃভাষায় বঙ্গবন্ধু মুজিবের এই ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর অধিবেশনে সমাগত পাঁচটি মহাদেশের প্রতিনিধি এবং সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুল পঠিত জাতিসংঘের ‘ডেলিগেট বুলেটিন’ বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তীর নায়ক মুজিব’ বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া পত্রস্থ করা হয়। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘এযাবৎ আমরা কিংবদন্তীর নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাঁকে কাজের মধ্যে দেখতে পাবো।’ জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘বক্তৃতায় ধ্বনিত হয়েছে মুজিবের মহৎকণ্ঠ।’ জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক এবং অর্থবহ।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভূয়সী প্রশংসা করে বুলেটিনটির ভাষ্য ছিল, ‘অতীতের অনগ্রসরতা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহ ফলশ্রুতি হিসেবে যে অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে তা বাংলাদেশের নেতা মুজিব তাঁর বক্তব্যে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন।’ বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করেছে। বাস্তবিকই তিনি এক শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব।’ বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যান এল সেøন্ড বলেন, ‘শেখ মুজিবের মহৎকণ্ঠ আমি গভীর আবেগ ভরে শুনেছি।’ যুগোশ্লাভিয়ার উপ-রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. মিনিক জাতির জনকের বক্তৃতার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে, ‘অতীতের অনগ্রসরতা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহ ফলশ্রুতি হিসেবে যে অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তা বিশেষ গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়েছে।’

এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতিজনিত সমস্যা এবং বাংলাদেশে সর্বনাশা বন্যার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জাতিসংঘের মহাসচিবের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনায় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল অংশগ্রহণের। কাছ থেকে দেখেছি অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে স্বদেশের প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার পর জাতিসংঘ বাংলাদেশের ত্রাণকার্যে ৭০ লাখ ডলার সহায়তা প্রদান করেছিল এবং উপ-মহাসচিব ডঃ ভিক্টর উমব্রাইখটকে বাংলাদেশের সমস্যার প্রতি বিশেষ নজর রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে অক্টোবরের ১ তারিখ সকাল ১০টায় আমরা নিউইয়র্ক থেকে ওয়শিংটনের এন্ড্রুজ বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করি। ওয়াশিংটনে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতির অতিথিশালা ব্লেয়ার হাউজে। সকাল ১১টায় ব্লেয়ার হাউসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম স্যাক্সবি। বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সাথে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন। প্রায় দেড় ঘন্টা স্থায়ী উভয়পক্ষের সফল বৈঠকের পর বিকাল সাড়ে ৪টায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বিকাল ৫টায় সাক্ষাৎ করেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে নিউইয়র্ক সিটি হলে আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় নিউইয়র্কের মেয়র বঙ্গবন্ধুকে নগরীর চাবি উপহার দেন এবং বলেন, ‘এই উপহার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের প্রতি আমেরিকার জনগণের শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের নিদর্শন।’ প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা আত্মদান করেছেন সেইসব শহীদের আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর পক্ষ থেকে এই চাবি গ্রহণ করে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন।’ বক্তৃতায় তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমেরিকার জনগণ যেভাবে সমর্থন যুগিয়েছিলো আমি চিরকাল তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো।’ নিউইর্য়ক নগরীর মেয়রের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নিউইর্য়ক নগরীতে জাতিসংঘের সদর দপ্তর অবস্থিত বিধায় এই নগরীর বিশ্বের সকল দেশের প্রতি এক বিশেষ দায়িত্ব আছে।’ পরদিন অক্টোবরের ২ তারিখ সকালে সিনেটর কেনেডী ও জর্জ ম্যাকভার্ন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধুর সম্মানে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির পক্ষে নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই সফর ছিল অসংখ্য কর্মসূচীতে ঠাসা। সদ্য-স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার আগমনকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্ক নগরীর বিদ্ব্যৎসমাজে বিশেষ ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়। মনে পড়ে, হোটেল ‘ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া’র রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছি। আমার সামনেই উপবিষ্ট একটি পরিবার। পরিচয়ের শুরুতেই তারা আমায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কোন দেশ থেকে এসেছো?’ আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তখন তাদের মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি কথাই উচ্চারিত হয়, ‘ও, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব! তিনি একজন মহান নেতা।’ পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি তাঁর পলিটিকাল সেক্রেটারী। কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে পারলেন না। আমার মতো অল্পবয়সী একজন কী করে বিশ্বখ্যাত নেতা শেখ মুজিবের পলিটিকাল সেক্রেটারী হতে পারে! কেবল বললেন, ‘আর ইউ শিওর?’ আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। তখন তারা বলেছিলেন, ‘আমরা মুজিবকে শ্রদ্ধা করি।’ তারপরে যখন বঙ্গবন্ধুকে আমি ঘটনাটি ব্যক্ত করি তিনি বললেন, ‘তাদেরকে নিয়ে এসো।’ তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে এলাম। অপার বিস্ময়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপে মগ্ন হলেন। শুধুমাত্র বাঙালীদের কাছে নয়, বিদেশীদের কাছেও বঙ্গবন্ধু পরম শ্রদ্ধার আসনে আসীন।

লেখক  : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।