• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২০, ০৬:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ১৮, ২০২০, ০৮:১৮ পিএম

পেঁয়াজ-আলুর পর আবার কোন পণ্য?

পেঁয়াজ-আলুর পর আবার কোন পণ্য?

দেশে এই মুহূর্তে অনেক কিছু নিয়েই তোলপাড় চলছে। চলছে আন্দোলন-সংগ্রাম। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন অন্যতম। এ আন্দোলনের চাপে নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দাম কিছুদিন জনগণের মন থেকে দূরে ছিল। দেশের অবস্থা এখন এমন যে, যে কৃষক খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন, সেই কৃষকও ন্যায্যমূল্যে তার পণ্য বিক্রি করতে পারেন না। একই সঙ্গে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারেন না দেশের সাধারণ ক্রেতারাও। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও চাল-ডাল, আলু-পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলছে। চাল ও আলুর দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামের ধার ধারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বড় সমস্যায় রয়েছে। গত বছর ছিল পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড। সে সময়ও কর্তৃপক্ষের নানা কসরত সত্বেও পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির ঝাঁজ কমানো যায়নি। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি স্বাধীন দেশের সরকারের অসহায়ত্ব এর চেয়ে আর কী হতে পারে? 

শুধু পেঁয়াজ-আলুর মূল্যবৃদ্ধিই নয়, দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম ও মসলার দাম বাড়ে কারণে-অকারণে। রমজান মাস এলে তো কথাই নেই! নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ জিজ্ঞাসা করলে খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ চাপান বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের ঘাড়ে। আর বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা আমদানি করা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করেন আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধিকে। দেশে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করে থাকেন পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে। এ ধরনের চিত্রনাট্যের মঞ্চায়ন এ দেশে চলছে বছরের পর বছর। 

টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক একটি কৃষিব্যবস্থা দেশের সাধারণ মানুষের দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য অপরিহার্য। অথচ আমাদের দেশে খাদ্যচাহিদা নিরূপণ করে চাষাবাদের বিজ্ঞানসম্মত রীতি সর্বস্তরে আজও গড়ে ওঠেনি। অথচ দারিদ্র্যবিমোচন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগসূত্র রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদের। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে জনগণের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, তার বার্ষিক চাহিদা নিরূপণে খাতওয়ারি সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। অবশ্যই রাষ্ট্রকে জানা দরকার, দেশের মানুষের বার্ষিক লবণ, পেঁয়াজ, আদা, মরিচ, জিরা, চাল, ডাল, আটা, আলু, মাছ-মাংস ভোগ্যপণ্য হিসেবে কতটা পরিমাণ লাগবে। একই সঙ্গে জানতে হবে, ভোগ্যপণ্যের কতটা বহির্বিশ্ব থেকে আমদানি করতে হবে। আরও জানতে হবে, দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্যের কোনটি রফতানি করা সম্ভব। রাষ্ট্র এ কাজটি সঠিকভাবে করতে না পারার কারণেই কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন। 

দেশের কৃষক বাঁচাতে এবং চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ‘উৎপাদন কৃষকের, ধান সরকারের’ নীতির ভিত্তিতে এগোনো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে ধানের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারিভাবে নতুন প্যাডি ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট (পিএমআই) বা ধান ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। সরকার কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি উন্নয়ন, কৃষি গবেষণা, ধান গবেষণা, বীজ প্রত্যয়ন, মৃত্তিকা, পাট গবেষণা, হর্টিকালচার উন্নয়নে আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য ধান ব্যবস্থাপনায় কোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেনি। এ কারণেই ধানের দাম নিয়ে কৃষককে এবং চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মধ্যবিত্তকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা যায়।

স্বাধীন দেশে বাজারব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরানো অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সবার স্বার্থেই একটি সুশৃঙ্খল বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা অপিরিহার্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের বাজারব্যবস্থায় কোনো শৃঙ্খলা নেই। প্রায় সময়ই এ দেশের বাজারব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা দৃষ্টিগোচর হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা উদ্যোগ কার্যকর থাকলেও এখন তা একবারেই নিষ্ক্রিয়। হাজারো ঢাকঢোল পেটানো সত্ত্বেও গড়ে ওঠেনি সমবায় বাজার। নিভু নিভু কার্যক্রম পরিচালনা করছে টিসিবি, কিন্তু পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে এর তেমন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার সুযোগ বুঝে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় সিন্ডিকেট। তারা ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম হাঁকান। 

স্বাধীনতার পর পণ্যদ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ছিল কনজ্যুমার সাপ্লাই করপোরেশন (কসকর), সমবায় মার্কেটিং সোসাইটি এবং সর্বশেষ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির মডেল ধারণায় ভেস্তে গেছে এসব ফলদায়ক উদ্যোগ। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা দেশের মোড়লদের নির্দেশনায় সরকার বাজারব্যবস্থার অনেক কিছুই দেখে না দেখার ভান করে থাকে।

উন্নত দেশের বাজারব্যবস্থার একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হলো- ধনী-গরিব প্রায় সবাই উৎসবের সময় অপেক্ষাকৃত কম দামে দ্রব্যসামগ্রী কেনার অপেক্ষায় থাকেন; যা আমাদের দেশের বাজারব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। উন্নত দেশের বাজারব্যবস্থায় পরিবারের খরচ যে খুব কম হয় তা কিন্তু নয়। এসব দেশে ব্যবসায়ীরা যে মুনাফা কম অর্জন করেন, তাও নয়। তবে বড় বড় উৎসবের সময় দ্রব্যমূল্য কম থাকে বলে সামগ্রিকভাবে সমাজে একটি স্বস্তিদায়ক পরিবেশ বিরাজ করে, যা দেশের অর্থনীতি এবং বিশেষ করে যে কোনো উৎসবের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা ছাড়া উন্নত দেশের বাজারব্যবস্থায় সরকারি সংস্থাগুলোর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকায় ব্যবসায়ীদের বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ খুবই কম। প্রতিযোগিতা বেশি থাকায় মুনাফার হার কমাতে বাধ্য হতে হয়, বাজার-সম্পর্কিত তথ্যপ্রবাহ অবাধ থাকায় ভোক্তারাও সচেতন থাকে।

ব্যতিক্রম মনে হয় শুধু আমাদের দেশকে। স্বাধীনতার পর পণ্যদ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ছিল কনজ্যুমার সাপ্লাই করপোরেশন (কসকর), সমবায় মার্কেটিং সোসাইটি এবং সর্বশেষ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির মডেল ধারণায় ভেস্তে গেছে এসব ফলদায়ক উদ্যোগ। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা দেশের মোড়লদের নির্দেশনায় সরকার বাজারব্যবস্থার অনেক কিছুই দেখে না দেখার ভান করে থাকে। কিন্তু স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দেশের ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সরকারের হাত। ইচ্ছা করলেই ব্যবসায়ীদের কোনো পণ্যের দাম বাড়ানো সম্ভব ছিল না। তখন ডিলারের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় পণ্য বিক্রি করত সরকার। সাবান থেকে শুরু করে চাল, ডাল, আটাসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য বিদেশ থেকে সরকারিভাবে আমদানি করে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিত। কিন্তু এখন বাজারে নিত্যদিন সংকট বিরাজ করলেও নিধিরাম সর্দারের মতো টিসিবির ট্রাকসেল ছাড়া সরকারের বিকল্প কোনো সরবরাহ ব্যবস্থা নেই। 

মানুষের কল্যাণের জন্যই ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন সুলতান আলাউদ্দীন খলজি। একটি স্বাধীন দেশে ভোক্তারা এমন একটি বাজারব্যবস্থাই প্রত্যাশা করেন। প্রায় গোটা ভারতবর্ষের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬ খ্রি.) জনগণের কল্যাণে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, পশু এবং অন্যান্য দ্রব্যের বাজারদর বেঁধে দিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদরা লিখেছেন, তার বাজার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি মধ্যযুগের রাষ্ট্রনীতির অঙ্গনে অন্যতম বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। আর আমরা স্বাধীন দেশে একটি সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় হিমশিম খাচ্ছি।

বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি কার্যকর বাজার-নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে- যেখানে সুস্পষ্টভাবে সরবরাহ ও মজুদের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা থাকবে। আমদানি মূল্য থেকে পাইকারি মূল্যের পার্থক্য কত হবে এবং পাইকারি থেকে খুচরা মূল্যের কত পার্থক্য, তাও নির্ধারণ করে দিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি বাজারেই একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতালিকা টাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যে মূল্যতালিকা অনুসারে বাজারের দ্রব্যমূল্যের দাম নির্ধারিত হবে এবং এই মূল্যতালিকাটি একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দ্বারা প্রতিদিন পরীক্ষিত হতে হবে। কোনো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে যাতে অতি মুনাফালোভীরা বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে, তার ব্যবস্থাও সরকারকে নিতে হবে। 

ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা লাভের মানসিকতাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য তাদের নৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে মসজিদের ইমামরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এসব পদক্ষেপ যত দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব হবে, তত দ্রুত বাজারব্যবস্থায় স্বস্তি ফিরে আসবে বলেই মনে হয়। নতুবা পেঁয়াজ, চাল বা আলুর মতো নাকানিচুবানি আমরা দিনের পর দিন খেতেই থাকব।

লেখক : সাংবাদিক

জাগরণ/এমইউ