• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২০, ০৪:৪৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ৮, ২০২০, ০৪:৪৩ পিএম

প্রসঙ্গ : নারীর সমঅধিকার

প্রসঙ্গ : নারীর সমঅধিকার
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন-ফাইল ছবি

সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে একটি মামলার রায় দেয়া হয়। এই রায়টিতে বলা হয়েছে যে, হিন্দু বিধবা নারীরা তার স্বামীর কৃষি জমিরও ভাগ পাবেন। পূর্বে বিধবা নারীরা শুধু অকৃষি জমির ভাগ পেতেন। হাইকোর্টের রায়ের ফলে নারীদের সমাধিকারপ্রাপ্তির বিষয়টি আরও একধাপ এগিয়ে গেল। ১৯৯৬ সালে খুলনার গৌরদাসী নামে এক নারী তার মৃত স্বামীর কৃষি জমির ভাগ দাবি করেন। ওই নারীকে জমির ভাগ দিতে অস্বীকার করে তার দেবর জ্যোতিন্দ্রনাথ মণ্ডল। গৌরদাসী জমি দখল পেতে চাইলে দেবর জ্যোতিন্দ্র মণ্ডল খুলনা জজ আদালতে তার বিরুদ্ধে একটি দেওয়ানী মামলা দায়ের করেন। জ্যোতিন্দ্র মণ্ডলের দায়ের করায় মামলায় খুলনার বিজ্ঞ জজ আদালত হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার রয়েছে এই মর্মে রায় দেন। ফলে গৌরদাসী মৃত স্বামীর কৃষি জমিরও উত্তরাধিকারী হয়ে যান। জ্যোতিন্দ্র মণ্ডল মামলায় হেরে গিয়ে থেমে থাকেননি। তিনি উচ্চ আদালতে আপীল করেন। ২০২০ সালে হাইকোর্ট জ্যোতিন্দ্র মণ্ডলের আপিলকৃত মামলাটির রায় প্রদান করে। এই রায়টিতেও বলা হয় হিন্দু বিধবা নারীরা তার স্বামীর কৃষি জমিতে উত্তরাধিকারী হবেন।
 
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৭ সালে প্রণীত একটি আইনে হিন্দু বিধবা নারীরা স্বামীর সম্পত্তির কি কি বিষয়ে উত্তরাধিকারী হবেন তার বর্ণনা আছে। ১৯৩৭ সালের আইনানুযায়ী হিন্দু ধর্ম পালনকারী বিধবা নারীরা তার মৃত স্বামীর কৃষি এবং অকৃষি উভয় প্রকার জমির উত্তরাধিকারী হবেন। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রের অজুহাতে তাদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। শাস্ত্রের পণ্ডিতদের মতে, যারা মৃত ব্যক্তির পিণ্ডদান করার অধিকার রাখেন কেবলমাত্র তারাই তার রেখে যাওয়া সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারবেন। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে হিন্দু ধর্ম পালনকারী বিধবা নারীরা ১৯৩৭ সালের আইনানুযায়ী তার মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী হয়ে আসছেন। ১৯৩৭ সালে সিলেট ছিল আসাম প্রদেশের অন্তর্গত একটি জেলা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এই জেলাটির পূর্ব বাংলার অন্তর্গত হয়। কিন্তু ১৯৩৭ সালের আইনানুযায়ী হিন্দু ধর্ম পালনকারী বিধবা নারীরা বাংলাদেশের সিলেট জেলায় উত্তরাধিকারী হয়ে আসছে। বাংলাদেশেই দুই ধরনের নিয়ম, বিষয়টি আশ্চর্য হওয়ার মতো। কারণ একই দেশে একই ধর্ম পালনকারী নারীদের ক্ষেত্রে দুই রকম প্রথা। পৃথিবীর সকল দেশেই দেখা যায় নারীদের অধিকারের বিষয়টি আইনের চেয়ে ধর্মীয় প্রথার মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। তাই দুনিয়াজুড়ে নারীরা তাদের নায্যতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

মুসলিম রীতি অনুসারে একজন বিধবা নারী তার স্বামীর সম্পত্তির কতটা পাবেন তা বলা আছে। একজন মুসলিম বিধবা নারী যদি তার স্বামীর সন্তান থাকে, তা হলে তিনি স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদের আট ভাগের এক ভাগ পাবেন, আর স্বামী সন্তানহীন হলে চার ভাগের এক ভাগ। অপরদিকে স্বামীর ক্ষেত্রে বলা আছে , স্বামী পাবেন স্ত্রীর রেখে যাওয়া সম্পদের (যদি সন্তান থাকে) চার ভাগের এক ভাগ, আর সন্তান না থাকলে অর্ধেক। অপরদিকে মৃত পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারীর ক্ষেত্রে ছেলেসন্তান যা পাবে, মেয়েসন্তান পাবে তার অর্ধেক। হিন্দু ধর্ম পালনকারী কোনো নারী তার পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না। সম্পদের উত্তরাধিকার হিসেবে ধর্ম পালন অনুসারে একমাত্র নারীদের ক্ষেত্রে রয়েছে ধর্মভেদে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম। পুরুষের ক্ষেত্রে প্রায় সব ধর্মের নিয়মের একটি মিল পাওয়া যায়। মানুষ হিসেবে সমাজে নারী-পুরুষ সমান বলা হলেও সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্য। আর এ ধরনের বৈষম্য থাকায় নারীরা সমাজিক মর্যাদা পায় না। এই কারণেই সমাজে নারীদের সমাধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। 

সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং কথিত নারীবাদীরা সমাজে নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। তারা জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। কিন্তু হতবাক হওয়ার বিষয়টি হলো, তারা নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী প্রথাটি ভাঙতে তেমন কোনো কাজ করতে দেখা যায় না। বর্তমানে কিছু মানুষ নিজেকে Feminist দাবি করেন। তাদেরকে Human Activist  বলে মনে হয় না। তারা যদি প্রকৃত হতেন Human Activist, তা হলে তারা সমাজ এবং ধর্মীয় রীতি অনুসারে নারীরা যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তা নিয়ে আন্দোলন করতেন, বিশেষভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিতেন। জেন্ডার সমতার নামে এই সংগঠনগুলো নারীদের পুরুষবিদ্বেষী করে গড়ে তুলছে। নানা ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে বাড়ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত । ফলে নারীরা তাদের প্রকৃত ন্যায্যতা থেকে আরও বঞ্চিত। নারী এবং পুরুষের মধ্যে একটি দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতেই আজকে নারীবাদ এবং পুরুষতান্ত্রিকতা নামক তাত্ত্বিক কথাটির জন্ম হয়। কথিত জেন্ডার সমতার কর্মসূচির দিয়ে নারীদেরকেই কৌশলে সংগ্রামী বানানোর চেষ্টা করা হয়, আর এ ধরনের দীর্ঘকালীন নারী ও পুরুষের দ্বন্দ্বে নারীদের অংশগ্রহণ করানোর মাধ্যমে সামাজিককে আরও প্রকট করছে। নারী ও পুরুষের এ ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টির করে পরোক্ষভাবে নারীকে পণ্যেই রূপান্তরিত করা হয়। 

একজন নারীকে স্বল্প কাপড়ে রেম্পে হাঁটানোর মাধ্যমে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা পায় না, বরং এ ধরনের কার্যক্রমে নারীর দৈহিক সৌষ্ঠবতা প্রদর্শিত হয়। আর এ প্রদর্শনের মাধ্যমে নারীও পণ্যেই পরিণত করা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীর দেহকে প্রদর্শন করা একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন পণ্যের বিজ্ঞাপনই নারী ছাড়া হয় না। অনেক বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থিতিটা বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যহীন। অথচ নারীকে নানা ভঙ্গিমায় প্রদর্শিত করা হচ্ছে বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন মিডিয়াতে। কিছু কথিত Feminist-রা নারীর রেম্পে হাটার বিষয়কেও বলে থাকেন নারী তার অধিকার পাওয়ার পথে একধাপ এগিয়ে গেল। 

একজন নারীকে স্বল্প কাপড়ে রেম্পে হাঁটানোর মাধ্যমে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা পায় না, বরং এ ধরনের কার্যক্রমে নারীর দৈহিক সৌষ্ঠবতা প্রদর্শিত হয়। আর এ প্রদর্শনের মাধ্যমে নারীও পণ্যেই পরিণত করা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীর দেহকে প্রদর্শন করা একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুঁজিবাদী দুনিয়ায় পুঁজি বিকাশের এবং মুনাফা আহরণের লক্ষ্যে নারীকেও তারা অধিকার আদায় করার নামে পণ্যে রূপান্তরিত করছে। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থাযনে তৃতীয় বিশ্বে কিছু বেসরকারী সংস্থা পরিচালিত হয়। এরা নারীর সমঅধিকারে কাজ করছে বলে দাবিদার। এই সংস্থাগুলোয় রয়েছে কিছু পুরুষকর্মী। যারা নিজেদের Feminist হিসেবে দাবি করেন। এরা কিছু নারীকে হঠকারী বানিয়ে সমাজে এক ধরনের বিরোধ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের তথাকথিত বাঙালি নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন, তার এক লেখায় তিনি বলেছেন, পুরুষের অণ্ডকোষে কষে মারো লাথি। তসলিমা নাসরিনের পুরুষের এই বিশেষ অঙ্গে এই লাথির মারার মাধ্যমে বাঙালি নারীরা কি সমঅধিকার পেয়ে যাবে? তিনি জোরালোভাবে নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরছেন না। কোন প্রক্রিয়া আন্দোলন করলে নারী ও পুরুষ উভয়েই সম্পত্তির সমভাগিদার হবেন, তার কথা তিনি লেখেন না। তা হলে নারীরা কি করে সমাজে সমঅধিকার পাবেন। মানুষের সামাজিক ভিতটা গড়ার পেছনে তার সম্পদ বড় ধরনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সমাজের কোনো ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারিত হয়ে থাকে তার সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি পাওয়ার বিষয়ে রয়েছে বৈষম্য, আর এই বৈষম্যের প্রতিফলনটা সমাজে প্রতিফলিত হয়। ফলে নারীরা সামাজিকভাবেও বৈষম্যের শিকার হন। 

নারীরা অফিস আদালতে কাজ করছে এ বিষয়টি নারীর সমঅধিকার আন্দোলনের ফসল। তবে এ দেশে প্রাচীনকাল থেকেই কিন্তু নারীরা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। গ্রামের দরিদ্র নারীরা বহুযুগ আগ থেকেই কৃষি কাজ করছেন, এ রকম ঘরের বাইরে কাজ করার পরও কি নারী তার সমঅধিকার পেয়েছেন? বর্তমান সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে, নারী বৈমানিক থেকে শুরু করে নানা ধরনের বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন, এ ধরনের নারী পেশাজীবী হওয়ার পরও কি নারীরা সমঅধিকার পাচ্ছেন? বিভিন্ন পেশায় নারীর যোগদানের বিষয়টিকে সমঅধিকারের একটি প্রক্রিয়া। তবে এটা কোনো প্রকার করুণা বা দয়া নয়। নারীরা এ রকম পেশায় জড়িত হতে পেরেছেন নারী তার নিজস্ব যোগ্যতায়। নারী অর্থ উপার্জন করে নিজের নামে সম্পদ করছেন। তবে তিনি মারা গেলে তার রেখে যাওয়া সম্পদ তার কন্যাসন্তানটি পাবে পুত্রসন্তানের অর্ধেক। তা হলে বিষয়টি কি দাঁড়াল, নারীর সামাজিক অবস্থান যে তিমির আছে, সেই তিমিরেই থেকে যায়। তার আর অবসান হয় না। শহর বা গ্রামে, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত প্রতিটি পরিবারে নারীর অবস্থানটা দুর্বল হওয়ার মূল কারণ তার সম্পত্তি কম থাকায়। নারী সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীদের সম্পদের উত্তরাধিকার সমান করতে হবে। 

উত্তরাধিকারী হিসেবে নারী সম্পদে সমান না হলে সমাজে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। রাষ্ট্রীয় আইনে নারী বা পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার বিষয়টি সবার সমান হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণের প্রথাগত বিষয়টির ওপর নির্ভর করা ঠিক না। রাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে, প্রতিটি নাগরিক সমঅধিকার ভোগ করবেন, আবার অন্যদিকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হচ্ছে ধর্মীয় রীতিনীতির মাধ্যমে। এর ফলে নারী ও পুরুষের মধ্যেকার বৈষম্যটি থেকেই যাচ্ছ। 

নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়ার বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে ধর্ম র্বণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সমান হওয়া উচিত। 

লেখক : কলামিস্ট