• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২০, ০৪:৫১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ৮, ২০২০, ০৪:৫১ পিএম

ধর্ষণ মামলার সাজার পরিবর্তন ও কিছু কথা

ধর্ষণ মামলার সাজার পরিবর্তন ও কিছু কথা
শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল

আমাদের দেশের মধ্যে একশ্রেণির মানুষ আছেন, যাদের পেটে ভাত না থাকলেও মামলা-মোকদ্দমা চালাতে খুবই আনন্দ পায়। টাকা-পয়সা সুদে এনে কিংবা ঘরের গরু-ছাগল বিক্রি করে কিংবা অনেক সময় ঘরবাড়ি, জমিজমা বিক্রি করে মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে খেলা করতে করতে এক সময় নিঃস্ব হয়ে যায়, তা মামলাবাজ মানুষ বুঝতেই পারে না। আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করছি, যে সময়ে মানুষ নিজের লাভ-লোকসানের জন্য অন্যের বিরাট ক্ষতিসাধন করতে যেমন পিছপা হয় না, তেমনি করে তাতে যে মামলাবাজ মানুষটিরও ক্ষতি হয়, তা মামলাবাজ মানুষজন বুঝতেই পরে না। এমনভাবে একশ্রেণির মানুষ আজ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে, যে নিয়ন্ত্রণের মাঝে একশ্রেণির লোভী মানুষ চায় অন্যের ক্ষতিসাধন করে নিজের লাভের বিরাট অংশ ঘরে তুলতে। 

এক সংবাদভাষ্যে বলা হয়েছে যে, ধর্ষণ মামলার জেরে আমাদের দেশের এক গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, সংশ্লিষ্ট পুরুষশূন্য হওয়া গ্রামের এক মহিলা মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার কারণে গ্রামের মানুষ তার প্রতিবাদ করলে, মাদক ব্যবসায়ী মহিলাটি গ্রামবাসীর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দেখা যায় যে ব্যাক্তি মহিলার মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করে তার বিরুদ্ধে ওই মহিলা নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের মামলা দায়ের করে ফেলে। শেষকালে দেখা যায় মানসম্মনের ভয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মাদক ব্যবসায়ী মহিলার সাথে টাকা-পয়সা দিয়ে আপস করে মামলা-মোকদ্দমা থেকে রক্ষা পেতে হয়। মামলাবাজ মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, মামলাবাজ মহিলার কাজই হচ্ছে গ্রামের যে কারো বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে নিরপরাধ মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। এ মহিলার দাপটে গ্রামের অনেক যুবক ছেলেরা কিংবা নিরীহ ঘরের মানুষরা গ্রামছাড়া হয়ে অন্য গ্রামে বসবাস করছে। এই মহিলার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হচ্ছে, মাদক ব্যবসায়ী মহিলাটি তার স্বামীর বিরুদ্ধেও ধর্ষণের মামলা দায়ের করে। দেখা যায় মহিলাট এতই বেপরোয়া যে, তার স্বার্থের জন্য তার স্বামীকেও মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কোথায় আছি? আজ দেশের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। যা দেখলে মানষের অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। পাঠক-পাঠিকা চিন্তা করে দেখুন আপনার আশপাশে একজন পুরুষ কিংবা মহিলা মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু আপনি তার প্রতিবাদ করতে পারছেন না। আপনি অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করলে মাদক ব্যবসায়ী কিংবা অনৈতিক কাজে অভ্যস্ত ব্যক্তিটি আপনার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। মাদক ব্যবসা আর অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করার অপরাধে নষ্ট মানুষের দল আপনার বিরুদ্ধে এমন সব বিষয় নিয়ে মামলা দায়ের করে ফেলে, যার কারণে আপনাকে থানাপুলিশ দ্বারা হয়রানি হতে হচ্ছে কিংবা আপনাকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে যখন আপনাকে হয়রানি হতে হচ্ছে, তখন কি আপনি চাইবেন আপনার আশপাশের সকল অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করতে। নির্দোষ মানুষ আইনের মারপ্যাঁচে হয়রানি হয় যেখানে, সেখানে আইনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কিংবা আইনের পরিবর্তন করে কি সম্ভব পাপ কিংবা অন্যায়ের বিনাশ করা। আমার তো মনে হয় শুধু আইনের পরিবর্তন করে পাপ কিংবা অন্যায়ের বিনাশ করা যাবে না। অভিযোগ আছে, একশ্রেণির পুলিশ সদস্যরা যারা টাকা-পয়সার জন্য মামলাবাজ নষ্ট মানুষদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে থাকে।

নির্দোষ মানুষ আইনের মারপ্যাঁচে হয়রানি হয় যেখানে, সেখানে আইনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কিংবা আইনের পরিবর্তন করে কি সম্ভব পাপ কিংবা অন্যায়ের বিনাশ করা। আমার তো মনে হয় শুধু আইনের পরিবর্তন করে পাপ কিংবা অন্যায়ের বিনাশ করা যাবে না।

দেশের মাঝে ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সরকার ধর্ষণের সাজার ব্যাপারে আইনগত দিক দিয়ে একটা বিরাট পরিবর্তন আনয়ন করেছেন। সরকার কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের ধারণা, ধর্ষণের মতো অপরাধের বিনাশ ঘটাতে হলে ধর্ষণের সাজার দিকটাকে আরও কঠিনতর করতে হবে। তাই সরকার ধর্ষণের মতো অপরাধের সাজা মৃত্যুদন্ড করেছেন। তাতে ধর্ষকরা যদি মৃত্যুভয় থেকে ধর্ষণের মতো অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু সচেতন মানুষের প্রশ্ন হলো, আইন করে কি কখনো অপরাধের বিনাশ ঘটানো যাবে। যদি না অপরাধীদের মনোজগতের মাঝে কোনো ধরনের শুভ পরিবর্তন না ঘটে। যুগে যুগে অর্থাৎ প্রত্যেক কালেই মানুষ তার বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন বিষয়ের মাঝে পরিবর্তন আনয়ন করেছেন। এই পরিবর্তন তখনই মানুষের কাজে লেগেছে, যখন মানুষের আনয়ন করা পরিবর্তন মানুষের মনোজগৎকে শুভদিকে নির্দেশনার মাধ্যমে পরিবর্তন করেছে। মানুষের শুভ পরিবর্তন যখন মানুষের মনোজগতের শুভ পরিবর্তন নিয়ে আসে, তখনই আমাদের সমাজ-সংসার সুন্দর হয়ে ওঠে। 

আমাদের একটা কথা একবাক্যে স্বীকার করে নিতে হবে যে, দেশের মাঝে ধর্ষণসহ বিভিন্ন রকমের অপরাধ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এই বেড়ে যাওয়া অপরাধসমূহের যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে আছে। তাই সরকার যখন ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদন্ড করলেন, দেখা গেল দেশের মানুষ তাতে খুশি হলো শুধু অপরাধের বিনাশের কথা চিন্তা করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ হয়তো এ কথা ভাবেনি যে, যারা মামলাবাজ, যারা মিথ্যা মামলা করে মানুষকে বিপদে ফেলে কিংবা জেলহাজত খাটায় কিংবা মিথ্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে সাজা পর্যন্ত করিয়ে ফেলে তাদের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে। লেখার প্রথমে বলেছিলাম ধর্ষণ মামলার জেরে গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে গেছে। আজ মাদক ব্যবসায়ী এক মহিলার মিথ্যা মামলার জন্য মানুষ আতঙ্কিত। এ রকম মাদক ব্যবসায়ী পুরুষ/মহিলা দেশের সর্বত্রই বসবাস করে থাকে। মাদক ব্যবসায়ী কিংবা অন্য অপরাধীরা যখন দেখবে তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে কেউ বাধা দিচ্ছে, তখন তারা অর্থাৎ মাদক ব্যবসায়ী কিংবা অন্যান্য অপরাধীরা রাস্তা থেকে যৌনকর্মীকে ধরে এনে বাদিনী সাজিয়ে কিংবা সংশ্লিষ্ট অপরাধীরা যদি মহিলা হয়, তাহলে সে নিজেই বাদিনী হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো মামলা দায়ের করছে। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন, এদেশে মিথ্যা মামলার চার্জশিট হয়ে থাকে। তাতে অনেক মানুষের সাজা পর্যন্ত হয়। এমন অভিযোগও আছে, মিথ্যা মামলার চার্জশিট হয়ে থাকে শুধু একশ্রেণির অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার সততার অভাবের জন্য। 

আমরা পত্রপত্রিকায় দেখে থাকি, অনেক ব্যক্তি মিথ্যা খুনের মামলায় হাজত খাটছে। এমনকি নিরীহ মানুষের ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানমতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে। শেষে দেখা যায় মৃত ব্যক্তি ফিরে এসে বলছে, না আমি খুন হইনি। আমি বাড়ি থেকে রাগ করে চলে গিয়েছিলাম। তখন কেউ প্রশ্ন করে না, এই মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেবার জন্য কি করে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার কোনো নির্দোষ আসামিকে কোর্টে পাঠায় কিংবা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার চাকরি থাকে কি করে? অনেকে বলেন পুলিশের মারধর থেকে বাঁচার জন্যই নিরীহ লোকেরা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকে। এমন মিথ্যা মামলায় একজন বা তারও অধিক মানুষ জেলহাজত খাটে। তার জবাব তো সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার কিংবা তার সিনিয়র কর্তৃপক্ষ দেয় না। অনেক সময় এমন অভিযোগও করা হয়ে থাকে, একশ্রেণির অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এমন সব কাজ করে থাকেন যার খেসারত দিতে গিয়ে নিরীহ মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। হয়তো কোনো মামলায় কোনো আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য। একশ্রেণির অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা তখন নাকি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে চালান দেয়া আসামিকে বলে দেন, উনার শেখানো কথামতো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি না দিলে অন্য মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে এনে অত্যাচার করা হবে। একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তার মনোবৃত্তি যদি এত নীচু ধরনের হয়ে থাকে, সেখানে আইনের পরিবর্তন করে কি দেশ থেকে অপরাধ নির্মূল করা যাবে। প্রশ্নটা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছেই রাখলাম। 

তাই বলছিলাম, ধর্ষণের মতো অপরাধ কিংবা যে কোনো অপরাধের বিনাশ ঘটাতে হলে অবশ্যই আমাদের দেশের অপরাধীদের মনোজগতের একটা শুভ পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে। যদি আমরা অপরাধীদের মনোজগতে একটা শুভ পরিবর্তন আনয়ন করতে পারি, তবেই সম্ভব হবে ধর্ষণসহ যে কোনো অপরাধের বিনাশ ঘটানো। তখন দেখা যাবে কোনো অপরাধের সাজা মৃত্যুদন্ড করতে হচ্ছে না। মানুষ তখন আপন ইচ্ছে থেকেই অপরাধ থেকে লাখ লাখ মাইল দূরে থাকছে।


লেখক : আইনজীবী, কবি ও গল্পকার