করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে ছুটি। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের প্রথম ধাপ কিছুটা কমলেও দ্বিতীয় ধাপের আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাই ধারণা করা হচ্ছে, সহসাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না। এখনো প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তবে কিছুটা কমছে আক্রান্তের হার। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আবার করোনার প্রকোপ বাড়তে পারে, অর্থাৎ সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হওয়ার আশঙ্কা। বাংলাদেশে এত দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল না। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতে সরকারি-বেসরকারি এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চলছে। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেক দেশই আক্রান্তের হার বেড়ে যাওয়ায় আবার বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ স্কুল খুলে দেয়ায় ওই সমস্ত দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নতুন করে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেও পৃথিবীর অন্য দেশের অভিজ্ঞতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। করোনার প্রভাবে সারা দেশে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম । যার জন্য দেখা যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত স্কুল-কলেজগুলোর পাঠ্যক্রমের সিলেবাস শেষ করাটা সম্ভব হবে না। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের পাঠদানে বিকল্প পন্থা অবলম্বন করেছে। করোনা মহামারীর কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলছে ভার্চুয়াল শিক্ষাদান পদ্ধতি। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করছেন। দেশের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও চালিয়ে যাচ্ছেন অনলাইনে পাঠদান। প্রযুক্তির ব্যবহার করে অনলাইনে দেশে সামগ্রিকভাবে শিক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে কতটা বাস্তবসম্মত হচ্ছে, তা ভেবে দেখা দরকার। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থাটা এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়। যে সমস্ত পরিবার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে শিক্ষার্থীরা এসেছে, সেই পরিবারগুলো মোবাইলের খরচ চালানোর আর্থিক সঙ্গতি নেই বললেই চলে। দেশে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠদান একটা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় এখন আর মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের সন্তানরা পড়ে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরিদ্র পরিবারের শিশুরাই এখন পড়াশোনা করে। কিছু মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বেশি হওয়ার কারণে দেখা যায়, দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেন নামক প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান যাচাই না করেই, ভালো মানের শিক্ষার আশায় অভিভাবকরা সন্তানদেরকে পাঠান এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোয়। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক, শিক্ষিকাদের এবং শিক্ষা বিভাগে কর্মরত কর্মীদের সন্তানরাও এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে না। এর ফলে সহজেই বোঝা যায় যে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের বড় অংশটাই এসেছে আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারগুলো থেকে।
সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা ২ কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৩৮ জন। দেশের মোট শিক্ষার্থীর একটি বৃহৎ অংশ এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। করোনা মহাদুর্যোগে দেশের কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনলাইনে পাঠ দান করছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনলাইনে শিক্ষণ প্রক্রিয়াটি কি শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করতে পারছে? এটা মনিটরিং করা প্রয়োজন। সারা দেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি হবে; তবে এনড্রয়েড মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত এর সঠিক পরিসংখ্যন জানা নেই। প্রায় সোয়া দুই কোটি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর পরিবারে কতগুলো পরিবারের এনড্রয়েড মোবাইল আছে তা জেনে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো উচিত। পড়ুয়ারা যে পরিবারগুলোয় অবস্থান করছে, এ পরিবারগুলো অনলাইন ব্যবহার করাটা কতটুকু জানে? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের বয়স ৫-১১ বছরেরর মধ্যে। সুতরাং তাদের পক্ষে এনড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করা সম্ভব নয়। অপরদিকে শিক্ষার্থীর অভিভাবকরাই কি জানেন এনড্রয়েড মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করা। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত যে শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন, তারা নিজেরাই কতটুকু প্রযুক্তির ব্যবহার জানেন এটাও বিবেচনায় নেয়া দরকার। করোনার মতো মহাদুর্যোগ অতিক্রম করছে বাংলাদেশ । এই দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। করোনা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার দিয়েছে বিভিন্ন সেক্টরে আর্থিক প্রণ্যোদনা। করোনার সময় এনড্রয়েড মোবাইলের মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রদানের যে প্রচেষ্টাটা চলছে , এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের বড় অংশের শিক্ষার্থীরাই তা গ্রহণ করতে পারবে না আর্থিক সঙ্গতি না থাকার জন্য। তাই সরকারিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের পরিবারগুলোকে ইন্টারনেট খরচের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করার পাশাপশি প্রশিক্ষণও দেয়া দরকার।
মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও এই অনলাইন পদ্ধতিতে পাঠদান সম্ভব চলছে। এই পাঠদান প্রক্রিয়ার সাথে আদৌ কি শিক্ষার্থীরা সম্পৃক্ত হতে পারছে? মাধ্যমিক স্তরের বেশির ভাগ অভিভাবকরাই শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিতেন না। আবার কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এনড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করা ছিল নিষেধ। উচ্চ মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের অনেক শিক্ষার্থীদের এনড্রয়েড মোবাইল ছিল না। তাই অনলাইনে পাঠদানের বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখা দরকার।
করোনা দুর্যোগে নানা পদ্ধতিতে মোবাইল কোম্পানিগুলো ইন্টারনেটের মেগাবাইটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনার জন্য নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর আয় কমেছে। তাই এই নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে মেগাবাইট কিনে অনলাইনে সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করাটা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের বহু অঞ্চল রয়েছে, যেখানে সঠিক এবং কার্যকরভাবে সার্বক্ষণিক মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়া যায় না। তাছাড়া বাংলাদেশে যে কয়টা মোবাইল কোম্পানি রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক সব জেলায় সমানভাবে নেই। সরকারি মোবাইল কোম্পানি বিটিসিআরএলের নেটওয়ার্কের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। কল রেট এবং ইন্টারনেটের মেগাবাইট এর দাম কম-বেশি রয়েছে কোম্পানিগুলোর মাঝে। সুতরাং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অনলাইনে সরকারি প্রাথমিক স্তরের পাঠদান ব্যবস্থা চালু করা কতটা বাস্তবসম্মত হচ্ছে তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন। বর্তমানে দেশে অনলইন ব্যবস্থায় যে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে, এ প্রক্রিয়ায় পাঠদান কার্যক্রমে সকল প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীর অংশ নিতে পারছে না।
করোনার অবস্থাটা সার্বিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। করোনাকালে কমপক্ষে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা অনলাইনে প্রদান না করাটা হবে শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো। যদি প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে করোনা চলে যাওয়ার পর, শিক্ষা বর্ষটা আরও চার মাস বাড়িয়ে দিয়ে করোনা ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া যেতে পারে। কারণ বর্তমানে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্র্থী সুফলটা ভোগ করতে পারছে; অপরদিকে বড় একটা অংশ বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে। তাই প্রাথমিকের শিক্ষা প্রদানটি অনলাইনে না দিয়ে বিকল্প পন্থাটা অবলম্বন করাই হবে সবার জন্য মঙ্গলজনক।
লেখক : কলামিস্ট