• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২১, ০৪:৫৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২, ২০২১, ০৬:০৪ পিএম

পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের নামই ধর্ষণ

পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের নামই ধর্ষণ

জানি না, জেনারেশন গ্যাপ জিনিসটা আদতে কী! আমি জানি না, আমার যে অনুভূতি হয়, তাকে আসলে জেনারেশন গ্যাপ বলেই সহজে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় কি না! আমি জানি না, সব হিসাব নিকাশ এত সহজ আর সস্তা কিনা! আমি এও জানি না, এত কথা বলে, লিখে কিংবা চিৎকার করেও সত্যিই আমরা কোনো সমাধানে পৌঁছুতে পারবো কি না!

আমার পরিচিত একজনের কন্যা ক্লাস ফোর থেকে প্রেম করে। সে গভীর রাত পর্যন্ত চ্যাট করে, ফোনে কথা বলে। এই কথাটা যখন জেনেছি, তখন আমার নিজের ক্লাস ফোরে পড়ার স্মৃতিটা সামান্য হাতড়েছি। আমি ফোরে পড়ার সময় গোল্লাছুট খেলতাম, সুকুমার সমগ্র ঝরঝরে মুখস্ত ছিল, স্কুল থেকে ফিরেই গল্পের বই নিয়ে বসতাম বলে আম্মার হাতে প্রায়ই পিটুনি খেতাম।

সময় কি বদলে গেছে খুব? আমি একটু ভাবতে চেষ্টা করি। আসলে বদলে গেছে কারা? আমাদের সন্তানেরা? নাকি আসলে আমরা? বাবা মা, আত্মীয় বন্ধুরা? নাকি বদলে গেছে চারপাশ? এই চারপাশকে বদলে দিচ্ছে কে? এই বদলের কল্যাণমুখী কোনো দিক কি আদৌ আছে?

যে বাচ্চা মেয়েটির উদাহরণ দিয়েছি, তার বাবা মায়ের ভেতরে সদ্ভাব নেই। একটা অস্থির অশান্ত বেদনাময় পরিবেশে বড় হচ্ছে সে। হ্যাঁ, পারিবারিক বেদনাময় পরিবেশে বহু শিশুই বড় হয়। কিন্তু তারপর? একটা খোলা মাঠ, একটা দৌড়ে ছুটে বেড়ানোর জায়গা, সমবয়সী বন্ধু, লাইব্রেরি, বিনোদনের স্থান- এই শহর ঠিক কী কী আমরা দিতে পারে একটা শিশুকে? যে শিশু বাবা মায়ের নিত্য অশান্তি দেখে দেখে মন খারাপ থেকে মুক্তি পেতে কিংবা ধরুন সময় কাটাতেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় মোবাইল ফোনে, ইন্টারনেটে- বদ্ধ ঘরের ভেতরে, যেখানে এক ফোটা আকাশের আনাগোনা নেই! এমনকি যে স্কুলটিতে সে পড়ে, সেটি নামে ডাকে প্রচুর খ্যাতি কামিয়েছে, কিন্তু সে স্কুল বলতে আস্ত এক ইট সিমেন্টের খুপড়ি দালান। মাঠ নেই, খোলামেলা পরিবেশ নেই। ক্লাসরুমেই বসে থাকা!

আর লাইব্রেরি? শিশুদের জন্য কটা লাইব্রেরি আছে এই শহরে? আর বাবা মায়েরই তো পড়ার অভ্যাস নেই। বই পড়া বলে কোনো সুন্দর অভ্যাসই নেই অধিকাংশের। ফেব্রুয়ারি এলে লোক দেখানো মেলায় ঘোরাঘুরি আছে। আর বাদবাকি দিনে?  বাদবাকি দিন কাটে বাবা মায়ের সাথে শপিং-শপিং নেশায়, যে শপিং জুড়ে থাকে ঘরের দামি জিনিস, খাবার, গহনা, পোশাক ইত্যাদি। আর সব বিনোদনের শেষ হয় রেস্টুরেন্টে খাওয়া দিয়ে। আমি সম্প্রতি কিছু ভ্লগের দেখা পেয়েছি, যে ভ্লগে ১১/১২ বছরের বাচ্চা মেয়ে মেকআপ টিউটোরিয়াল করে দেখায়। তার কথাবার্তা অঙ্গভঙ্গি দেখে ভীষণ আহত এবং বেদনার্ত হয়ে বসে থাকি।

যে শিশুদের সামনে সুন্দর কোনো ভবিষ্যতের আলো নেই, যে শিশুদের সামনে আনন্দ আহরণের সঠিক কোনো ঠিকানা নেই, যে শিশু কিশোরেরা দিকভ্রান্ত, বিভ্রান্ত, যারা মিথ্যে বিলাস, পণ্যসর্বস্ব জীবনকেই সত্য বলে জানছে, যাদের সামনে আলো হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সত্য মানুষ নেই, এমনকি বাবা-মাও যাদের সামনে সুন্দর কোনো উদাহরণ রাখতে অক্ষম, সেই শিশুদের কাছে আমরা আসলে কী প্রত্যাশা করি? কী দিতে সক্ষম এইসব শিশু আর কিশোরেরা? তারা যদি বিনোদন খুঁজতে গিয়ে বিকৃত যৌনতাকেই শেষোব্দি খুঁজে নেয়, তাতেই বা আমাদের বলার বা করার কী আছে?

রাজধানীর কলাবাগানের ডলফিন গলিতে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেছে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বয়স ১৭। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষের বয়স ১৮। আমাদের গোয়েন্দা জনগণ এরইমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে। এটি ধর্ষণ নাকি সম্মতিক্রমে করা যৌনতা, এটি দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত, এটি গ্যাং রেইপ নাকি না- এরকম সব আলোচনা তো আছেই। সেই সাথে আছে মেয়েটির চরিত্রহনন, পোশাক, বয়স, বয়ফ্রেন্ড, একা বাড়িতে যাওয়া- এরকম সব রগরগে বিষয় দিয়ে মৃত মেয়েটিকে কাঁটাছেড়া করছে যে যার মতো।

জীবনের একটি সুন্দর অংশ যৌনতা, সেই যৌনতাকে কতটা কুৎসিত করে ফেলা যায়, কতটা অস্পৃশ্য আর অশ্লীল করে শিশু কিশোরের সামনে তুলে ধরা যায়, তার এক মোক্ষম উদাহরণ আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, আমাদের অনলাইন পরিবেশ, আমাদের চারপাশ। যে রাষ্ট্রে যৌনশিক্ষার কোনো সুযোগ নেই, সেই রাষ্ট্রেই শিশুদের হাতে হাতে ধরা মোবাইল, আইপ্যাডে অশ্লীল বিকৃত যৌনতার ছড়াছড়ি। যে সমাজে ছেলেমেয়ের বন্ধুত্বকেও নোংরা চোখে দেখা হয়, সেই সমাজেই ছেলেরা ‘মেয়ে’ বলতে এক একটি আস্ত মাংসপিণ্ড—এটি জেনে বড় হয়, তাকে যৌনবস্তুর আসনে বসিয়ে নিজের পুরুষত্বকে জাহির করতে শেখে তারা। যে পুরুষত্ব জাহির করে তার বাবা, চাচা, প্রতিবেশি কাকা, পাশের ফ্ল্যাটের বন্ধু; সেই একই পুরুষত্ব আয়ত্ত্ব করার মধ্য দিয়েই তার বড় হয়ে ওঠা। সেটাই তার বড় হওয়া। বড় মানুষ নয়, বড় পুরুষ। এই দেশে শিশুরা বড় হয়ে হয় পুরুষ হয়, নয়তো নারী হয়। মানুষ হওয়া আজকাল আর শেখে না কেউ।

তো কাঁটাছেড়া তো চলছেই। ইংলিশ মিডিয়াম, বড়লোকের ছেলে, ও লেভেলের ছাত্রী ইত্যাদি। তো সব কাঁটাছেড়াই দিনশেষে থেমে যায়। শুধু শূণ্য হয় মায়ের বুক। যে যোনী থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সেই যোনীর কোনো ইংলিশ কিংবা বাংলা মিডিয়াম নেই। ভাল স্কুল, গরীব স্কুল কিংবা মাদ্রাসা- কিছুই নেই। যে অশ্লীল কদর্যতা এই সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে ধ্বংসের শেষ পথে এনে দাঁড় করিয়েছে, সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পাবে না কেউ। কোনো আধুনিক টেকনোলজি, দামি গাড়ি, ফ্ল্যাট, আইপ্যাড, ফ্ল্যাট স্ক্রিণ টিভি—কোনো কিছুই এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারবে না। বরং দিনে দিনে আরো রক্তপাতের ঘটনা সামনে আসবে।

বারবার একটি পুরোনো কথা বলতে হয়: ধর্ষণকে নিছক যৌনতা হিসেবে দেখবেন না। ধর্ষণ এক পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের নাম। ধর্ষণ আমাদের কদর্য অবদমিত মনোজগতের নোংরা বহিঃপ্রকাশ। ধর্ষণ কেউ হুট ক’রে করে না। ধর্ষণের মানসিকতা গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। চারপাশের পরিবেশ একটি পুরুষকে ধর্ষক হিসেবে তৈরি করে। একটি ১৮ বছরের পুরুষ একটি ১৭ বছরের নারীর সাথে যৌনতা স্থাপন করতে গিয়ে এতটাই তীব্র পৌরুষ আর আধিপত্য নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে যে মেয়েটি মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মরে যায়। মেয়েটির মৃত্যু আমাদের মুখোমুখি করে এই সত্যের যে- একটি ফাঁপা, ভণ্ড, বুদ্ধিহীন, মেধাহীন, কুৎসিত সমাজ ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তিলে তিলে, যে সমাজে প্রেম, ভালোবাসা, ভালোলাগা, আনন্দ- এই শব্দগুলোর মানেই বদলে গেছে। সবগুলো শব্দ হতকুচ্ছিত চেহারা নিয়ে দাঁত খিচিয়ে ঘাপটি মেরে আছে আমাদের ভেতরে। আমরা এক একটা পণ্যলোভী, বিকৃত যৌনতাকাতর এবং একইসাথে মূর্খ এক জনগোষ্ঠী, যারা একের পর এক আমাদেরই মতো অসভ্য সন্তান জন্ম দিয়ে চলেছি।  

 

লেখক: সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর