• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২১, ১০:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ৯, ২০২১, ১০:২৬ পিএম

দশই জানুয়ারি ও আমাদের দায়

দশই জানুয়ারি ও আমাদের দায়

বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসের দশ তারিখে বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মাটিতে পা রাখলেন। এটা তো এই জাতির জন্মকথার সঙ্গে উৎকীর্ণ হয়ে আছে। মৃত্যুগুহা থেকে মাতৃভূমির মাটিতে পা রাখার দিবসটি তো উৎসবরেই দিন। কিন্তু দেশে প্রত্যাবর্তনের আগের তিনটি দিন কী হয়েছিল, কী ধরনের গোপন ঘটনা ঘটেছিল পর্দার অন্তরালে- তার ওপরে একটু আলো ফেলা যাক।


বাহাত্তরের আট জানুয়ারির আগে পাকিস্তানের রাজনীতির তুখোড় খেলোয়াড় জুলফিকার আলী ভুট্টো - কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা, কিছু সংখ্যক বিশ্বস্ত আমলা এবং বিদেশি দু’একজন কূটনীতিকের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করলেন। সেখানে কয়েক স্তরের গুপ্ত বৈঠক হলো। কোনও কোনও বৈঠকে আলোচনা হলো- কী হবে যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি। হতোদ্যম পাক সামরিক কর্মকর্তারা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়- পাকিস্তানের রাজনীতিও দিকভ্রান্তিতে নিমজ্জিত- পুরো দায়িত্ব স্কন্ধে নিয়েছেন সর্বশিরোমণি জুলফিকার আলী ভুট্টো। একটি গোপন মন্ত্রক বৈঠকে তিনি বললেন, শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করে তার দেশে ফেরত পাঠাবেন।


পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকরা অন্তত এটা অনুমান করতে পারতেন যে ভুট্টো  সাহেব সব সময় নানা ধরনের পরিকল্পনা এবং ষড়যন্ত্রের নকশা প্রণয়নে অতিশয় পারঙ্গম। অন্তর্নীহিত পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলেও তারা অন্তত এটা অনুমাণ করতে পারছিলেন যে, লারকানার যুবরাজের নতুন গেমপ্ল্যান বাইরে ছাড়া হলো। অবশ্য তখন ভুট্টোর চক্রান্ত উদঘাটন বা প্রতিরোধ করার মতো কোনো লোক বা শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। অতএব ভুট্টোর পরিকল্পনা অবাধে কার্যকর করার আয়োজন করা হলো। মুহূর্তের মধ্যেই সক্রিয় হয়ে গেলো অনেকগুলো চক্র। একটি চক্র শুরু করলো প্রচারমাধ্যমে ভুট্টোবন্দনা।


ভুট্টোর উদারতা, মহানুভবতা, ক্ষমাশীলতা এমনভাবে প্রচার করা শুরু হলো  যেন এমন ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ভুট্টো সাহেব তার ‘বন্ধু’ মুজিবকে অনিবার্য মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তার স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এই প্রত্যাশায় যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে মুজিব নিশ্চয় সেটা নিরসনের উদ্যোগ নেবেন।


বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে হাড়ে হাড়ে চিনতেন। আর চিনতেন বলেই তার পাতা ফাঁদে পা ফেলেননি। আর ওদিকে ভুট্টোও জানতেন যে, শেখ মুজিবকে এত সহজে আটকানো যাবে না। এখানে অন্যভাবে ছক সাজাতে হবে। পাকিস্তানের কারাগারে চক্রান্তমূলকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর তাই দেশি-বিদেশি প্রচারমাধ্যমে নানা ধরণের কল্পকাহিনীর গল্প সাজিয়ে ভুট্টোকে বিশাল বিচক্ষণ ব্যক্তি প্রমাণের চেষ্টা করা হলো এবং একই সঙ্গে অতিশয় সঙ্গোপনে দেশের মাটি স্পর্শ করার আগেই বঙ্গবন্ধুর প্রাণ সংহারের জন্য একটি গুপ্তঘাতকের দল একই বিমানে ছদ্মবেশে পাঠানোর আয়োজন করা হলো।


কিভাবে সেই গুপ্তঘাতকের দলকে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী করা হয়েছিলো? ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে যেই বিমান লন্ডনে নিয়ে যায় সেই বিমানে যাত্রী ছিল পাকিস্তানী জাতীয় হকি টিম। সেই হকি টিমের মধ্যেই ছদ্মবেশে ঢুকে গিয়েছিল একদল গুপ্তঘাতক। এই গুপ্তঘাতকের দলটিতে বাঙালি মুখও ছিল ঘাতকদের অন্যতম নেতা হিসেবে। সে বঙ্গবন্ধুর পূর্বপরিচিত হিসেবে যাত্রাপথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার বিষয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টি ছিল ভারতীয় ও বৃটিশ গোয়েন্দাদের। সেই ব্যুহ ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর নিকটবর্তী হওয়ার সামান্যতম সুযোগ না পাওয়ায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনাটিও নস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু সেখানেই এই চক্রান্তের শেষ হয়নি। ওই বাহাত্তরেরই ফেব্রুয়ারি মাসের একটা তারিখে বঙ্গবন্ধু তখন কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে বিশাল সমাবেশে যোগদানের জন্য যান। তখনো ভুট্টোপ্রেরিত ঘাতকদল হাম্বরা ষড়যন্ত্র করে, সেই চেষ্টাও ভারতীয় গোয়েন্দারা ব্যর্থ করে দেয় এবং ঘাতকদের কয়েকজনকে আটক করে। ওই চক্রের কথিত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে জবানবন্দীতে তার নিজের পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্তির কথা স্বীকার করে।

গোয়েন্দাদের কাছে ফুলস্কেপ কাগজের ১৭২ পৃষ্ঠাব্যাপী জবানবন্দীতে নিজের পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সুদীর্ঘকাল সংশ্লিষ্ট থাকার কথা জানায়। বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফরের সময় তার কাছে সবকিছু তুলে ধরা হলে তিনি তাকে বংলাদেশের হাতে প্রত্যার্পণের অনুরোধ করেন। সম্ভবত বাংলাদেশের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রক এবং তথ্যমন্ত্রকের পরামর্শক্রমে তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সময় সে দীর্ঘসময় কারাগারে ছিল। পরবর্তীকালে সে মুক্তি পায় এবং জিয়াউর রহমানের আমলে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। 

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যবর্তনের ঐতিহাসিক দিনটির কথা মনে এলেই মনে পড়ে যায় এই কথাটি। পাকিস্তানি বন্দীশালা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ঘাতকচক্রের হাতে স্বপরিবারে শাহাদাৎবরণের সময় পর্যন্ত প্রতিমুহূর্তে তাঁকে একের পর এক ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র কেবলমাত্র পাকিস্তানী সামরিকচক্রের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকেনি। তাদের নিয়োজিত এদেশিচক্রের মুঠি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তখনো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসমেত বঙ্গবন্ধুর আদেশে নিবেদিত নেতাকর্মীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে বহুমুখী ষড়যন্ত্রের।

 
স্বাধীনতার এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জীয়নকাঠি হচ্ছে জাতির জনকের আদর্শ এবং বিশ্বাসের নির্ভরযোগ্য সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নানাভাবে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ক্ষতবিক্ষত করার চক্রান্ত চলছে। তাই এটাকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করাই জাতীর জনকের অনুসারীদের একমাত্র কর্তব্য।
 

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ