• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২১, ০২:৫২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২১, ২০২১, ০৩:১৮ পিএম

স্মরণ

উপেন তরফদার: মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক

উপেন তরফদার: মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক শব্দসৈনিক উপেন তরফদার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আকাশবাণীর ‘সংবাদ বিচিত্রা’ বিভাগের প্রযোজক ছিলেন। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের খবর আকাশবাণীতে প্রচার করাই ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। খবর সংগ্রহে তিনি বারবার ছুটে গিয়েছেন রণাঙ্গনে। তাঁর কর্মজীবনের উজ্জ্বলতম সময় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ—এমনটাই বলতেন তিনি। মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনও উপস্থিত থেকে খবর সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে জন্মেছিলেন উপেন তরফদার। দেশভাগের পর ওপার বাংলায় চলে গেলেও শেকড়ের টান ছিল এ দেশের পরতে পরতে। যার দৃষ্টান্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনন্য অবদান এবং তাঁর কর্মশৈলী। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার উপেন তরফদারকে সম্মাননা দিয়েছে। 

উপেন তরফদার সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। এই উপেন তরফদার ছিলেন আমার দুঃসময়ের কম্পাস। উপেন তরফদার যত দিন বেঁচে ছিলেন, আমাদের দুজনের মধ্যকার বন্ধুত্বের সম্পর্কের একটুও ছেদ পড়েনি। উপেনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মনে পড়ে তাঁর সঙ্গে আমার কখন, কীভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যালয় পাকিস্তানি বাহিনীর বিধ্বংসী আক্রমণের শিকার। ওই রাতে আমি সেখানেই ছিলাম। সেই তাণ্ডবলীলার ধ্বংসস্তূপ থেকে নিজেকে রক্ষাও করি। ২৭ মার্চ সান্ধ্য আইন কিছুটা শিথিল হলে তিন ঘণ্টার জন্য আমি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন জায়গায় সেই ধ্বংসলীলা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলাম আর সেই অগ্নিকুণ্ডের বলয় থেকে পাকিস্তানি সেনাদের রক্তচক্ষুকে আড়াল করে কোনোরকমে এঘাট-ওঘাট, এবাড়ি-সেবাড়ি করে, সারাক্ষণ মৃত্যুদূতের তাড়া খেয়ে, নৌকায় ভেসে ভেসে প্রায় দীর্ঘ এক মাস পর একসময় সীমান্ত অতিক্রম করি। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল—যে করেই হোক আমি আকাশবাণীতে পৌঁছাব এবং আমার কথাগুলো বলব। কারণ, বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার উপযুক্ত মাধ্যমটি ছিল বেতার। যাহোক, আজ মনে পড়ে সে সময়ের ভয়ানক অস্থির অবস্থার কথা। চারদিকে ট্রেসার বোমা, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, মানুষের আহাজারি কেবল আতঙ্ক আর আতঙ্ক। আমাদেরকে পাকিস্তানি ঘাতক সেনারা, অবাঙালি ঘাতকরা খুঁজে বেড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরের আঞ্চলিক কমান্ডার থাকায় তাদের লক্ষ্যবস্তুও ছিলাম আমি। দেশের সব অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের যেখানেই পাচ্ছে, সেখানেই শেষ করে দিচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা। এভাবে ক্রমাগত বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি, আবার সেখানে হামলা চালাচ্ছে, আবার পালাতে হচ্ছে। যেখানেই আমাদের চলাচল, আশ্রয়; সেখানেই ঘাতক সেনাদের ট্যাংকের আনাগোনা, গুলিবর্ষণ, ধ্বংসলীলা। দেশটাকে একটা শ্মশানে পরিণত করছে।

১৯৭১ সালের ১২ কিংবা ১৩ মে আমি কলকাতায় ‘আকাশবাণী’ খুঁজে খুঁজে বের করি এবং সেখানে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটাই—তা হলো, একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত সেই ভয়ংকর মৃত্যু, নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, সেই অন্ধকার কাঁপানো মানুষের গগনবিদারী আহাজারির কথা সেখানে জানানো। আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করি। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের বক্তব্যের চেয়ে একজন সাংবাদিকের বক্তব্য তাঁদের কাছে বেশিই গ্রহণযোগ্য এবং সত্য ভাষণ বলে বিবেচিত হবে—এই চিন্তা করে আমি আমার সাংবাদিক পরিচয়টি ব্যবহার করেই সেখানে কথা বলার সুযোগটি তৈরি করতে চেয়েছি। আমার মনে হচ্ছিল, আকাশবাণীই হচ্ছে একমাত্র জায়গা, যেখানে বললে পুরো পৃথিবী জানতে পারবে। ভারতের যে বেতার মাধ্যমটি আছে, সেটি আমাদের অতি নির্ভরযোগ্য জায়গা। বিশেষ করে কলকাতায় বিভিন্ন সময়ে যে কথাবার্তাগুলো শুনেছি ’৭১ নিয়ে, তাতে মনে হয়েছে যে এখানে কিছু বললে নিশ্চয় আমার নিজের যে অভিজ্ঞতা বা আমার চাক্ষুষ যে ঘটনাগুলো, সেগুলো যদি আমি জানাতে পারি, তাহলে অন্তত পৃথিবীর কাছে পৌঁছে যাবে। আর একজন কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে আমার জন্য এটা ছিল পেশাগত দায়িত্ব এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যেন আমার সংযোগটি স্থাপন করতে পারছিলাম না। সম্পূর্ণ অচেনা জগৎ আমার কাছে। চেনাশোনা কেউ নেই। অথচ আমার কথাগুলো যে করেই হোক বলতেই হবে—এমন একটা ক্ষিপ্রতা তখন আমার মধ্যে কাজ করছিল।

আমি একটা সাধারণ প্যান্ট এবং টি-শার্ট পরিহিত একটা ছেলে। আকাশবাণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর কড়াকড়ি ছিল জায়গাটিকে ঘিরে। সেখানে দেখি, একেকজন করে বেরিয়ে আসছেন। কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছেনও না। কিছু শুনছেনও না। আমি যে কিছু একটা বলতে যাব, ভেতরে সে রকম বলার সুযোগও আমি পাচ্ছিলাম না। এটা ছিল আমার প্রথম দিন। সেদিন আমি কিছু না করেই ফেরত চলে যাই। পরের দিন আবার সেখানে যাই। একটাই পরিকল্পনা যেন আমি কোনো-না-কোনোভাবে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটা যেন তাদের জানাতে পারি। তখনও কিন্তু বাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে আমরা কিছু জানতাম না বা পত্রপত্রিকায় যা কিছু বের হয়েছে, সেটাকে এভাবে প্রচার করা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই টুকুই। এর বাইরে তখনো সেইভাবে কোনো কিছু প্রচারিত হতে পারেনি। অবশেষে তৃতীয় দিনে আমি দেখলাম হঠাৎ এক ভদ্রলোক, সুদর্শন। তাঁর হাতের মধ্যে একটি ক্যামেরা, মাইক এবং রেডিয়োর কিছু ধারণযন্ত্র নিয়ে আকাশবাণীর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন। আমার দিকে তাঁর চোখ পড়ল। তখন আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন, আমি খুব ব্যস্ত। কিন্তু আগে বলুন আপনি কে?’ তখন আমি তাঁকে গড়গড় করে সব বললাম, আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক। দৈনিক ইত্তেফাকে আমি সাংবাদিকতা করি। দৈনিক ইত্তেফাকে একাত্তরের সেই ২৫ মার্চের রাতটায় আমি সেখানে ছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনী কামান দিয়ে ধ্বংস করেছে সবকিছু। আমি বাংলাদেশের সেই ধ্বংসস্তূপটা দেখেছি। এই জিনিসটা আমি আপনাদের মাধ্যমে প্রচার করতে চাই। পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচারের সঠিক চিত্রটি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চাই। এই হলো উপেনদার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ।

 

তিনি তখন গুরুত্বটা উপলব্ধি করলেন এবং আমাকে বিশ্বাস করলেন। কিন্তু সেসময় একটা সতর্কতা ছিল যে আমাকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়! কারণ, পাকিস্তানি চরেরা তো চারদিকেই সোচ্চার ছিল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ওই ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘আপনি ভেতরে আসুন।’ আমি অভ্যর্থনা কাউন্টারের সামনে অপেক্ষা করলাম এবং তিনি ভেতরে গেলেন আর আমার জন্য একটা পাস জোগাড় করে দিলেন। আমি ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র পেলাম! ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সময়গুলোয় যখন যেখানে রেডিয়োতে আকাশবাণী ধরা হতো, আকাশবাণীর বিভিন্ন সময়ের খবর ও অনুষ্ঠান শুনে শুনে কুশীলবদের কারও কারও নামও জেনেছিলাম। তার মধ্যেই উপেন তরফদার এবং দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নাম দুটি আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। উপেনদা তখন ‘সংবাদ পরিক্রমা’ করতেন এবং দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ‘সংবাদ পরিক্রমা’ দুর্দান্তভাবে পাঠ করতেন। এই নাম দুটি আমার খুব পরিচিত ছিল। আমি যখন আকাশবাণীর ভেতরে ঢুকে পড়লাম, আমাকে উপেন তরফদার প্রথমেই সরল গুহ নামের একজন ভদ্রলোক, ওখানকার একজন বড়োকর্তা, তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে দেখিয়ে তাঁকে বললেন, ‘ইনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, ওখানকার যুদ্ধ থেকে এসেছেন এবং কিছু কথা বলতে চায়। আমার মনে হয় যে তাঁর কাছ থেকে বক্তব্য নেওয়া যেতে পারে।’ যা হোক, সরল গুহ আমার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন এবং ঘটনাক্রমে দেখা গেল যে আমার একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও বাংলার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন, তাঁর নাম ছিল অজিত কুমার গুহ। আর সরল গুহ তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্র! সেই হিসাবে আমাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হলো। তিনি আমাকে সোজা স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন এবং উপেন তরফদারকে পরিষ্কারভাবে বলে দিলেন, ‘এর একটা সাক্ষাৎকার নাও, দেখি কী বলতে চায়।’ তখনই আমার সুযোগটি এলো এবং সেখানে আমি পুরো বক্তব্যটি বললাম। একাত্তরের ২৫ মার্চ আমি কী কী দেখলাম, কীভাবে সংবাদমাধ্যমগুলোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ২৬ মার্চ কী করে আমি বাড়ি পৌঁছলাম। ২৭ মার্চ কী করে আমি পুরো ঢাকা শহরটা সেই জগন্নাথ হল থেকে শুরু করে সমস্ত পুলিশ প্রশাসনের জায়গাগুলোর কোথায় কী অবস্থা আমি দেখে এসেছিলাম— সবকিছু আমি বললাম। তাঁরা খুব চমকিত হলেন এই কারণে যে, এই ব্যাপারে এত বিস্তারিত বিবরণ একজন কর্মরত সাংবাদিকের মুখ থেকে নিজস্ব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা এখনো কেউ শোনেননি। আমি তাদের বললাম, আমি তো আসলে মুক্তিযুদ্ধই করতে চাই; কিন্তু শুধু এই জিনিসটা জানিয়ে দিতেই আপনাদের কাছে আসা। তারপর আমাকে পরের দিন যেতে বলা হলো। যথারীতি পরের দিন গেলাম এবং দেখলাম যে আমাকে দিল্লি কেন্দ্র থেকে ইন্টারভিউ করানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা আমার ভাষণ মতে আমার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন।

একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে কিছু সংগ্রামী মানুষকে নিয়ে আমার একটি ধারাবাহিক লেখা সেসময় দৈনিক ইত্তেফাকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল। তারই কিছু কপি সেসময়ে তাঁদের অফিসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল ফাইলে জায়গা করে নিয়েছিল। যা হোক, বরুণ হালদার, যিনি কি না ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতেন, তিনিও এখন প্রয়াত। তিনি আমাকে ইন্টারভিউ করলেন ইংরেজিতে। এটা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হলো। সেই বক্তব্য সেসময় তুমুল আলোড়ন তৈরি করেছিল। আমি শুনলাম কলকাতায় বসেই আমার ইন্টারভিউ বারবার প্রচার করা হচ্ছে যে একজন সাংবাদিক তিনি বাংলাদেশ থেকে এসে পূর্ব বাংলার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের কথা, তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোকে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, এর বিস্তারিত বিবরণ ছিল আমার সেই বক্তব্যে। পরে সরল গুহ আমাকে বললেন যে, ‘তুমি কোথায় থাকো?’ আমি বললাম, ‘আমি থাকি হাকিমপুর সীমান্তে। সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি। সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছি। ওখানে আমি থাকছি এবং একই সঙ্গে কিছু রাজনৈতিককর্মী আমার সঙ্গে যারা আছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি এবং সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছি। উনি আমাকে বললেন, আমি যেন কোথাও না যাই এবং আবার আকাশবাণীতে আসি। পরে আবার আমি আকাশবাণীতে গেলাম এবং সরল গুহ আমাকে বললেন, ‘তুমি তো সুন্দর বাংলা বলো এবং লেখ, তুমি কি একটা ‘কথিকা’ লিখতে পারবে এবং সেটা পড়তে পারবে? তবে তোমাকে কিন্তু স্বনামে পড়তে হবে। স্বনামে পড়লে বাংলাদেশে তোমার আত্মীয়স্বজনের জীবননাশ বা ক্ষতির আশঙ্কা থাকতে পারে।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই আমি স্বনামেই পড়ব।’ তখন সেটার নাম ঠিক হলো ‘জবাব দাও’। তারপর আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে এই ‘জবাব দাও’ অনুষ্ঠান শুরু হলো এবং তারপর একসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রমও শুরু হয়। সেখানে এম আর মুকুল অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সাহস, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

যাহোক, এভাবেই আমাদের সূচনা এবং আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় উপেন তরফদারের। উপেন তরফদার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতেন, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় আমার সঙ্গে কথা হতো। আর আস্তে আস্তে আকাশবাণীর বার্তা বিভাগের আমি একজন হয়ে গেলাম। আনুষ্ঠানিকভাবে নয় যদিও। কিন্তু আমি যে ফিচারটা পড়তাম, বলতাম, আবৃত্তি করতাম, সেগুলো আমাকে ওখানে বেশ পরিচিতি এনে দিল। শেষ পর্যন্ত আমার আরো দুইজন বন্ধু হলো। একজন প্রণবেশ সেন, যিনি ওখানে ‘সংবাদ পরিক্রমা’ লিখতেন। তিনি একজন অসাধারণ মেধাবী মানুষ এবং অসাধারণ লেখক। প্রণবেশ সেন আমাদের কামাল লোহানীর বন্ধু ছিলেন। সিরাজগঞ্জের মানুষ। উপেন তরফদার ছিলেন মানিকগঞ্জের মানুষ। অর্থাৎ সবাই পূর্ব বাংলার। সরল গুহ, তিনিও ছিলেন কুমিল্লার। অর্থাৎ তাঁরা বাংলাদেশের মানুষ হওয়ায় ঘনিষ্ঠতার সুযোগটি শুরু হলো বেশি করে এবং আমি তাদেরই একজন হয়ে গেলাম।

সেখানে দেখা পেলাম আরেকজনকে, তিনি হলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বাড়ি বরিশালে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো। ‘আপনি’ থেকে সম্পর্কটা ‘তুমি’তে এসে পড়ল। তারপর আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে সংযুক্ত হলাম, তখন অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে আসতে হতো কেবল অনুষ্ঠানটি করার জন্য। যখন সীমান্ত থেকে আকাশবাণীতে আসতাম, আমার পায়ে থাকত জঙ্গল শু এবং আমার একটাই কাপড় ছিল। ওই অবস্থায় আমি সীমান্ত থেকে চলে আসতাম। বিনে পয়সায় ট্রেনে করে চলে আসতাম শিয়ালদায়। সেখান থেকে হেঁটে আকাশবাণীতে যেতাম। সেখানে একটা করে ‘কথিকা’র জন্য আমাকে ১০ টাকা করে দেওয়া হতো। আমি দুটি কথিকা একসঙ্গে করে নিয়ে যেতাম এবং দুটির জন্য ২০ টাকা পেতাম, আবার সীমান্তে ফিরে যেতাম। এই ছিল আমার সময়কার আকাশবাণীর সঙ্গে সম্পর্ক। এবং এর ভেতর দিয়েই উপেন তরফদার আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে উপেন তরফদারের সঙ্গে আমার বিভিন্ন সময় কথাবার্তা হয়েছে। উপেনদা আমার বাড়িতেও এসেছেন। আমিও উপেনদার সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। প্রণবেশ সেনের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত গল্প হয়েছে। আমাদের সবার গল্পের একটা জায়গা ছিল। আকাশবাণীর ছাদে আমরা গল্প, আড্ডা করতাম। দেব দুলাল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরের মধ্যে একজন হয়ে গিয়েছিলেন। উনি যখন ঢাকায় এলেন, সরাসরি আমার অফিসে চলে এসেছিলেন। তখন আমি যুগান্তরের সম্পাদক। যা হোক, একটা সময় তিনি তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাঁর দৃষ্টিকে অন্ধকার গ্রাস করে। আসলে তাঁর মতো একটা স্বর্ণকণ্ঠ বোধহয় আমরা দ্বিতীয়টি পাইনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। যাহোক, এই হলো উপেন তরফদার, দেব দুলাল, প্রণবেশ সেন, সরল গুহের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ভিত। আরেকজন ছিলেন দ্বিপেশচন্দ্র ভৌমিক। তিনি ছিলেন বার্তা সম্পাদক। তিনিও আসতেন, আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিগুলো, যুদ্ধকালীন তথ্য যা যা আমার কাছে থাকত, যেখানে যে তথ্য পেতাম, সেগুলোকে নিয়ে অনেক কথা হতো আমাদের। উপেনদার সঙ্গে যখনই কলকাতায় গিয়েছি, দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, তখনই তাঁর বন্ধুত্বের উষ্ণতা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। আমরা গল্প করতাম সেই ’৭১ নিয়ে, কোথায় কী করছেন সেগুলো নিয়ে, তাঁর দূরদর্শনে তিনি যখন উচ্চপদে একটা দায়িত্ব পেলেন তা নিয়ে।

উপেন তরফদার আমার সেই জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন। আমার মনে আছে, আমি যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজনকে সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছিলাম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, এই তিনজনার বাইরেও একজন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। যিনি লিখেছিলেন:

‘তেলের শিশি ভাঙল বলে

 খুকুর পরে রাগ করো

 তোমরা যে সব বুড়ো খোকা

 ভারত ভেঙে ভাগ করো!

 তার বেলা?’  

এই অন্নদাশঙ্কর রায়কে আমরা আজীবন সম্মাননা দিয়েছিলাম। সেখানেই উপেন তরফদারকে, দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল। সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল প্রণবেশ সেনকেও। আজ মনে করে আনন্দিতবোধ করি, অন্তত আমার উদ্যোগেই এই মহতী কাজটি করতে পেরেছিল। জীবদ্দশায় অন্তত জীবনের এই দায়টি সম্পন্ন করতে পেরেছি।

যাহোক, তিনি একবার বলেছিলেন, বিশেষ করে আমাকে নিয়ে একখানা বই লিখবেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়, তাঁর সঙ্গে আমার বিভিন্ন সময় ঘটা নানা ঘটনাবলি, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরের দিনগুলোর কত স্মৃতি—সবকিছু নিয়েই তাঁর একটা বই আকারে ছাপানোর কথা ছিল। তিনি চলে যাওয়ার পর এই কাজটির আর আশা রইল না। তিনি শুধু আমাকে আকাশবাণী কলকাতাসংক্রান্ত একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। আমার মনে পরে, তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারে একটা বিষয় উল্লেখ করেছিলেন সেটা হলো, তাঁর সঙ্গে আমার একটা বাজি হয়ে গিয়েছিল। বাজি ধরেছিলেন সরল গুহ, দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবেশ সেন। বাজিটি ছিল এই যে, আমি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারব কি পারব না, তা নিয়ে। উপেনদা বলেছিলেন, ‘তুমি কোনোদিনও পাড়বে না। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমরাই দেখা করতে পারি না।’ আমি বলেছিলাম, ‘আমি দেখা করব এবং তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হব।’ পরে আমি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম সৌভাগ্যক্রমে। একদিন শিয়ালদা স্টেশন থেকে টেলিফোন করে তাঁকে বলেছিলাম, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক, বাংলাদেশ থেকে এসেছি, সেই হিসাবে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’ উনি বলেছিলেন, ‘আমি তো সহজে দেখা করি না।’ আমি বলেছিলাম, ‘আমার সঙ্গে আপনার দেখা করতেই হবে। কারণ, আমি এর পরে যখন যুদ্ধে চলে যাব, তখন আমি যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরতেও পারি, না-ও পারি। কাজেই আমার এই শেষ সাধ আপনার সঙ্গে দেখা করা। কারণ আমি রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি, আমি আপনাকে দেখতে চাই।’ এ কথায় তিনি খুব বিচলিত এবং মোহিত হয়েছিলেন বোধহয়। তিনি আমাকে ঠিকানা দিলেন এবং তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন। আমি বললাম, ‘আমার কাছে তো যাওয়ার জন্য কোনো টাকা নেই।’ উনি বললেন, ‘তোমার গাড়ি ভাড়া আমি দিয়ে দেব। তুমি চলে এসো।’ এভাবে আমি যখন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম এবং কথাটি আকাশবাণীর সবাইকে বললাম, সেখানে আমার মর্যাদা শতগুণ বেড়ে গেল। পরবর্তী সময়ে সুবিধা ছিল এই সত্যজিৎ রায় যতদিন বেঁচে ছিলেন প্রতিবছর আমি একবার করে তাঁর বাড়িতে যেতাম, তাঁর সঙ্গে গল্প করতে যেতাম। তিনি আমাকে প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। তাঁর জন্য আমি প্রতিবার এক কার্টন করে সিগারেট নিয়ে যেতাম। তিনি অনেক খুশি হতেন।

যা হোক, এ ব্যাপারে উপেনদা আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি অসাধ্য সাধন করেছ আবেদ ভাই!’ শুধু তা-ই নয়, সত্যজিৎ রায় আমাকে একবার তাঁর একটি সিনেমা, সিনেমা হলে গিয়ে দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সিনেমাটির নাম ছিল ‘সীমাবদ্ধ’। সেই সময় এই বিষয়টি আকাশবাণীতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল এবং আমাকে একটা বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসাবে দেখা হতো। এমনকি আকাশবাণীর গেটে যে দায়িত্বে থাকত, সেও আমাকে দেখে চিনত যে আমি সেই ব্যক্তি, যিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন। আর আমি মনে করি, আমার সৌভাগ্যটির দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল এই উপেন তরফদারের জন্যই। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু উপেনদা যিনি নিজেকে দাবি করতেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক হিসাবে। তাঁর ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ নামক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্কের কথা বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম আমার স্মৃতিতে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। নির্যাতিত-নিপীড়িত বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে একদিন আমি আবিষ্কার করলাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে ওপার বাংলার সংগ্রামী ভাই-বোনদের সঙ্গে আমি একজন সৈনিক হয়ে লড়াই করছি।’

আজ তাঁর প্রয়াণের এক বছর পার হলো। আমি তাঁর জন্য আমার সকল প্রার্থনা উজাড় করে দিলাম।

 

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রেস ইসস্টিটিউট  অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এবং সম্পাদক দৈনিক জাগরণ