• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২২, ২০২১, ০৪:১০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২২, ২০২১, ০৪:৪৪ পিএম

টিকার দোলাচল

টিকার দোলাচল

বেশ কিছুদিন ধরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই । নিজের অবয়ব দেখে আর আঁতকে উঠতে চাই না। আঁতকে উঠি দুই হাতের বাহু দেখে। সেখানে স্পষ্ট এখনো ছোটবেলায় নেওয়া টিকার সিলমোহর। টিকা নিতে গিয়ে কেঁদে ওঠার দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। কলোনীর নিচতলার স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে মায়ের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরছি । সেই কান্নার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে কিন্নরীর কান্না। কিছু টিকা ও মুখে খেয়েছে।  কিন্তু মুখে খেতে গিয়েও মেয়েটি আমার ভয়ে কেঁদেছে। আর হাতের বাহুতে টিকা নেবার সময়তো সেই হাসপাতাল কাঁপানো চিৎকার। মেয়ের সঙ্গে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি আমিও। আয়নায় দুই হাতের বাহু দেখি আর ভাবি করোনার টিকা কি পুরনো এই সিলমোহরের ওপরই দেয়া হবে?

আজকাল তো নাভির উপরে বা শরীরের অন্যান্য অংশেও দেয়া যায়। কানাডায় আমার দুই অগ্রজ করোনার টিকা নিয়েছেন, জানলাম বাহুর সেই মাংসপেশিতেই নাকি নিতে হয় । নিশ্চিত হলাম যেমন, যে পুরোন ব্যথাটাই সইতে হবে, তেমনি পড়ে গেলাম অনিশ্চয়তার মাঝে।

অদৃশ্য জীবাণু কভিড-১৯ নাম পাওয়ার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়ে যায় একে প্রতিরোধের লড়াই। একের পর এক ওষুধ কোম্পানী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান দাবী করতে থাকে প্রতিষেধক আবিষ্কারের। অদৃশ্য জীবাণুর চরিত্র উন্মোচন হতে থাকে। করোনার তাণ্ডবে স্থবির হয়ে পড়া বিশ্ব আশায় বুক বাঁধে। নব্য সাধারণ জীবনে ফিরতে উন্মুখ হয়ে ওঠা পৃথিবী প্রহর গুনতে থাকে প্রতিষেধকের। বিশ্ব বাণিজ্যে বিনিয়োগ থমকে যায়। সকলেই অপেক্ষা করতে থাকে, প্রতিষেধকের ঢাল এলেই বিশ্ব বাণিজ্য স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব। তাই আমদানী রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পণ্যের স্বাভাবিক বিপণন কাঠামো ভেঙে পড়ার প্রভাব পড়ে সকল দেশের স্বাভাবিক জীবন যাপনে । ক্ষুদ্র, মাঝারি , বৃহৎ শিল্প বন্ধ ও সংকীর্ণ হতে থাকে। কাজ হারায় মানুষ । দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা বাড়তে থাকে। শিক্ষার বৈষম্য বাড়ে। সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীর পক্ষে অনলাইন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি। করোনাকাল সমাজের বৈষম্য বাড়িয়েছে এর একটি বড় কারণ, কভিড-১৯ কে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক আস্ফালন। খাদ্যপণ্য উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের পাশাপাশি এই বাণিজ্যিক আস্ফালনের সঙ্গী হয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের পণ্য চাহিদা বেড়ে যায়। যোগান ও চাহিদার কৃত্রিম ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকৃত সংকটের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়, তাই করছে বেনিয়ারা । প্রতিষেধকও সেই ব্যবসার একটি পণ্য হয়ে ওঠে।

প্রতিষেধক রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অস্ত্রে রূপ নেয়। আধিপত্য বিস্তারকারী দেশগুলোর মধ্যে মনস্তাত্বিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, কারা নেবে প্রতিষেধক উৎপাদন ও বিপণনের দখল। প্রতিষেধকের স্বীকৃতি দেয়া-নেয়া নিয়েও রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। প্রতিষেধক কোন দেশ এবং শ্রেণীর উপর নীরিক্ষা করা হবে, এনিয়েও বচসা চলছে। এর মধ্যেও মানুষ ক্ষণ গুনে গেছে কখন মিলবে প্রতিষেধক টিকা? রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে নানা রকম কথা রটেছে। প্রথমে কারা প্রতিষেধক পাবেন, কথা হয়েছে সেই সৌভাগ্যবানদের নিয়ে। কোন কোন দেশে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের অগ্রাধিকার দেবার কথা বলা হয় । কোথাও প্রবীণদের, কোথাও সামরিক-বেসামরিক পদস্থদের প্রতিষেধক আগে দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। সামাজিক মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা তথ্য পরিবেশিত হতে থাকে। সত্য মিথ্যা মিলিয়েই। এতে এক সময় প্রতিষেধকের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা মানুষেরা সংশয়ে পড়ে যায়।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভীতির জন্যেই এই সংশয়। কানাডা, আমেরিকার স্বজন, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সেখানে টিকা দেয়া হচ্ছে মার্ডানা, ফাইজারের। তবে এই দুই টিকা যারা নিয়েছেন এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মতামত হলো কারিগরীভাবে দুটো টিকা সংরক্ষণ ও গ্রহণ স্পর্শকাতর। তাপমাত্রা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। ফলে কোথাও কমবেশি হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবার শঙ্কা তো থাকছেই। এছাড়া কোন ভ্যাকসিনই শতভাগ প্রমাণিত নয়। এই দোলাচালের মধ্যেই খড়কুটোর মতো আবিষ্কৃত ও বাজারজাত  হওয়া প্রতিষেধক আঁকড়ে ধরছে মানুষ। প্রতিষেধক নিয়ে সংশয়, রাজনীতি ও বাণিজ্যের বাইরে নয় বাংলাদেশও। সরাসরি কেনা হবে, না তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে কেনা হবে, এনিয়ে তর্ক হয়েছে।

এখন ভারত থেকে উপহার যোগ হয়ে টিকা আসায় চলছে রাজনীতি। টিকার জন্যে হাপিত্যেস করা মানুষেরাও এখন টিকা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো স্বাভাবিক নতুনত্বে ফিরতে একটা ভরসা বা উছিলায় তো প্রয়োজন। মনকে প্রবোধ দেয়া দরকার। তাই পৃথিবীকে নতুন শুরুর জন্যে এই বাহুতে নয়া সীলমোহর নিতেই হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কোরাস কণ্ঠে রাষ্ট্রগুলোও বলছে, যাপনে আর্থিক বৈষম্য বাড়লেও, টিকা নিয়ে বৈষম্য থাকবে না। প্রতিশ্রুতি মিথ্যে হবে কিনা জানি না, জীবন টিকিয়ে রাখতে এই দোলাচলের মাঝেই হয়তো সুঁইয়ের খোঁচাটি নিতে হবে। তাতে কি এমন ক্ষতি হবে? দোলনারও এমন দোলাচলে দুলতে হয়!

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট