• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২১, ০৯:০১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২১, ০১:৩৬ পিএম

গেম অন

রাহুলের টেস্ট অভিষেক

রাহুলের টেস্ট অভিষেক

ক্রিকেট টেলিসম্প্রচার জমানায় ঢুকে পড়ার পরও টস নিয়ে কম কেলেঙ্কারি হয়নি। তারপরও ক্রিকেটে কোনো বল মাঠে গড়ানোর আগে দর্শক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে টস। আর টেলিভিশনের সৌজন্যে ক্রিকেটালোকে দর্শকরা টসের পর দেখতে পান দুই অধিনায়কের অভিব্যক্তি, অনুভূতি।

টসজয়ী অধিনায়কই পান সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার। আগে ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, তার সঙ্গেও মিশে থাকে সমর্থকদের আবেগ-উচ্ছ্বাস। সঙ্গে অবশ্যই থাকে সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিয়ে কাটাছেঁড়াও! কিন্তু কেউ বুঝতে চান না টস কী!

টস নিতান্তই ভাগ্য পরীক্ষা। টসের পর দুই অধিনায়কের মুখে যা শোনা যায় তা হলো- ‘ভাগ্য পরীক্ষায় জয়ী হলাম’। আর এই ভাগ্য পরীক্ষার ফলটা ঘোষণা করেন আধুনিক ক্রিকেটে ম্যাচ রেফারি। ফল ঘোষণার পর গ্লাসঘেরা রুমে পুরো ম্যাচে বিচারকের দায়িত্বটা ‍নিয়ে বসে পড়েন। ম্যাচে সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটলেই শাস্তির বিধানের ধারা-উপধারার পাতা উল্টে শুরু হয় রিপোর্ট। তখনই বোঝা যায়; সারা ম্যাচে যিনি গ্লাসঘেরা রুমে কয়েদির মতো বসে থাকেন, তিনি কতটা ক্ষমতাবান!

টেস্ট ক্রিকেটে সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে প্রথম বাংলাদেশির আবির্ভাব হলো চট্টগ্রামে। ভবিষ্যতে ক্রিকেট কুইজের প্রশ্ন হতেই পারে, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম আইসিসির ম্যাচ রেফারি কে? উত্তরের জন্য ক্লু দেওয়া থাকতে পারে। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটে একাধিক ‘ঐতিহাসিক প্রথম’ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। ক্রিকেট ইতিহাসমনস্ক নন, অথচ প্রচণ্ড ক্রিকেটপ্রেমীরা এ বিষয়ে খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তেই পারেন। তাদের জন্য আরো খোলসা করে আভাস দেওয়া যেতে পারে। ‘ঐতিহাসিক প্রথম’-এর সঙ্গে জড়িত এ ক্রিকেটার বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ দলেও ছিলেন। এরপরও সংশয় কাটিয়ে উত্তর দেওয়ার জন্য বাটন টিপতে গিয়েও টিপছেন না, তাদের উদ্দেশে বলা হতে পারে ‘ওয়ানডে ক্রিকেটে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের মাচে তিনি খেলেছিলেন।’ এরপর হয়তো তারকাখ্যাতি থাকা সাবেক কোনো ক্রিকেটাররে নাম বলবেন এবং অ্যাঙ্করকে বলতে হবে- ‘দুঃখিত, আপনার উত্তর সঠিক হলো না!’ তাহলে সঠিক উত্তরটা কী?

হ্যাঁ, তিনি সাবেক ক্রিকেটার। বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছেন। পাকিস্তানকে হারানো সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ খেলেছেন নর্দাম্পটনে গেল শতাব্দীর শেষ বিশ্বকাপে। ক্রিকেট ইতিহাসের কিংবদন্তি অজি ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি যার মাঝে ম্যাচ উইনিং স্পেল করার সামর্থ্য দেখেছিলেন। ভারতের চেন্নাইয়ে এমআর এফ পেস ফাউন্ডেশনে যাকে লিলি নিজেই তালিম দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরে তিনি বনে গেলেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান! অধিনায়ক চাইলে তাকে দিয়ে একজন বোলারের কোটা পূরণ করতে পারেন! পেস বোলার হতে চাওয়া এক ক্রিকেটারের বিস্ময়কর রূপান্তর! যে কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বড় তারকা হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েও তারকা হতে পারেননি তিনি।

না পারার অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যাখ্যাও করা যাবে। ক্রিকেটজীবনে তিনি নিজেও হয়তো অনেক ভেবেছেন। ব্যাংকার ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে নিজেও হয়তো অনেক হিসেবে-নিকেশ করেছেন, আরো কী পেতে পারতেন ক্রিকেটার হিসেবে।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ব্যালান্স শিট তিনি তার মতো করে মেলাবেন। তবে ক্রিকেট প্রেসবক্স থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আর পরবর্তী সময়ে টেলিভিশন টক শোতে অ্যাঙ্করের উল্টো সিটে দেখা লোকটাকে সব সময় মনে হয়েছে, চিরকালীন মধ্যবিত্ত মানসিকতার প্রতিফলন। মেধা আছে, পরিশ্রম করার ইচ্ছা আছে, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ওক্ষার একটা সীমা রেখা নিজে টেনে বসে থাকেন! “যা পেয়েছি কম কী, ঠিকই তো চলছে! অন্যরা তুলনামূলক কম যোগত্যা নিয়েও বিএমডব্লিউ হাঁকাছেন, ঠিক আছে। আমি তো একটা টয়োটা চালাছি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডে স্নাতক করা ভদ্রলোক হয়তো চাকরি করার মানসিক প্রস্তুতিই নিয়েছিলেন। ও রকম মানসিকতা নিয়ে কী তারকা হওয়া যায়? তারকা হওয়ার জন্য আরও অনেক শর্ত পূরণ করতে হয় আমাদের ক্রিকেটে। ক্রিকেটীয় মানে আপনার প্রতিভা যত ভালোই হোক, তা বিকিয়ে নাম কিনতে হলে আরও কিছু লাগে। পারফরম্যান্স, আগ্রাসী মেজাজ, মাঝেমধ্যে বিস্ফোরক মন্তব্য অথবা বিতর্ক থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা, নিজের স্বচ্ছ ইমেজ রেখে করেছেন ধারাবাহিক পারফর্ম। এ রকম সব শর্ত তিনি পূরণ করতে পেরেছেন, এমন দাবি নিজেও করবেন না।

সেই তিনি আবার ঢুকে পড়লেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরো একটি প্রথমের তালিকায়। যেখান থেকে চাইলেও পরবর্তী সময়ে কেউ ‍মুছে ফেলতে পারবেন না তার নাম। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টে রেফারি হয়ে নাম ঢুকে পড়ল তারও। ক্যারিয়ারে টেস্ট ক্যাপ পাননি। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট তাকে উপেক্ষা করতে পারল না!

তবে হ্যাঁ, এর কোনো ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা খোঁজার দরকার নেই। ভাগ্যে হাত দিতেই হবে। তিনি ডেস্টিনিজ চাইল্ড। ভাগ্যের সন্তান। ভাগ্য ছাড়া কি তিনি নিজেও কী ভাবতে পেরেছিলেন, ক্রিকেট তাকে এভাবে আবার খানিকটা ফিরিয়ে দেবে! বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচে নিজের দেশে তিনি আইসিসির ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পাবেন? নিশ্চিতভাবে বলা যায় ভাবতে পারেননি।

কিন্তু করোনাকাল গোটা পৃথিবীকেই ওলটপালট করে দিচ্ছে। মাস দুয়েক আগে যে লোকটাকে সপরিবার হাসপাতাল আর ঘরবন্দী করে দিয়েছিল করোনা, সেই করোনাই তাকে নিজের দেশের মাটিতে দেশের টেস্ট ম্যাচে আইসিসির ম্যাচ রেফারি বানিয়ে দিল! ক্রিকেট ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলতে পারেন; ‘ঈশ্বর শুধু তুমিই জানতে, এমনটা হতে পারে।’

তবে হ্যাঁ, যার অধিনায়কত্বে তিনি বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছিলেন সে কিন্তু ম্যাচের আগের দিন মেলবোর্ন থেকে বললেন, ‘আমি জানতাম।’ তিনি জানতেই পারেন। আইসিসিতে প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে কাজ করছেন তিনি। চট্টগ্রাম টেস্টের আগের দিন তার জন্মদিনে আইসিসির অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তা তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। নিজে ব্যস্ত সময় পার করেছেন মিটিংয়ে। তার মধ্যেও কলব্যাক করেছেন। চট্টগ্রাম টেস্ট নিয়ে কথা বলেছেন। অগ্রিম শুভকামনা জানিয়েছেন এই টেস্টে ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পাওয়া তার এক সময়ের টিমমেটকে।

তবে মেলবোর্নের বাসিন্দা বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানকে তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা-অভিনন্দন কিছুই জানায়নি বিসিবি। তাতে কোনো আক্ষেপও নেই তার। নিষ্ঠাবান এক ক্রিকেট সাধকের মতোই তিনি শুধু বললেন, “আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা না জানালেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোনো কিছু এসে যায় না। আমারও কোনো আক্ষেপ হয় না। বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে গেলে সেটাই হবে বড় পাওয়া। রাহুল আইসিসির ম্যাচ রেফারি হিসেবে টেস্ট ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের এটা বড় পাওয়া।”

হ্যাঁ, নিয়ামুর রশীদ রাহুলের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন তার বিশ্বকাপ অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। টেলিফোনে বুলবুলের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ক্রিকেট অনেক কিছুই অজান্তে দিয়ে যায়। আবার কেড়ে নেয়। অভিনন্দন নিয়ামুর রশীদ রাহুল। টেস্ট ক্যাপ আপনার মাথায় ওঠেনি। টেস্ট ক্রিকেটের স্মারক আপনার ঘরে নেই। অতীত সুখের স্মৃতি হিসেবে আগামী দিনের জন্য চট্টগ্রাম টেস্টের টস করার কয়েনটা আপনি চেয়ে নিতেই পারেন। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মুদ্রার দুপিঠ অনেকেই দেখেন। কিন্তু কজন মনে রাখেন?

লেখক- জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।