• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১, ০৭:১৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১, ০৭:১৫ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি-৩৫

এক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের কাহিনি-০২

এক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের কাহিনি-০২

জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন অপকর্ম হয়তো বার বার দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসবে। কিন্তু মূলত আমরা এবার আলোচনায় নিয়ে আসবো এরশাদকে। এই এরশাদ পাকিস্তানি গুপ্তচর হিসেবে সেভাবে নিজেকে প্রকাশ করেননি বটে। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার কদর্য চরিত্র মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাপারে এমন কিছু রাখঢাক তিনি করেননি এবং সর্বক্ষেত্রেই নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করে গেছেন।

এই এরশাদের পাকিস্তানে অবস্থানকালীন ঘটনাও যথেষ্ট রহস্যজনক। মোটামুটিভাবে এটা সুবিদিত যে, যেসমস্ত বাঙালি অফিসার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তাদের বিচারের জন্যে যে ট্রাইব্যুনাল ইয়াহিয়া খান গঠন করেছিল, তার চেয়ারম্যানও ছিলেন এই কপট এরশাদ। তারপরেও জিয়াউর রহমান কেন এরশাদকেই বেছে নিয়েছিলেন তার উত্তরসূরি হিসেবে—এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসতে পারে। এরশাদের অসংখ্য নেতিবাচক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান পাকিস্তান ভাবাপন্ন এবং মুক্তিযুদ্ধকালের বিতর্কিত ভূমিকার অধিকারী এরশাদকে কেন যে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে বেছে নিলেন—এর উত্তর খুঁজতে গেলে জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের পাকিস্তানি সংযোগ স্পষ্টতর হয়ে যাবে।

যা হোক, জিয়া এবং একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সমরনায়ক জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যার পেছনে এরশাদের দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির মানুষের কাছে ক্রমশই ধরা পড়ে যাচ্ছিল। এ কথা সত্যি যে, এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের সামনে তখন তেমন কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। তাই এবার তিনি মনোনিবেশ করলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান প্রত্যাগতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কাজে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানসিকতার বহু প্রমাণ তিনি রেখেছিলেন। এমনকি একাত্তরে পাকিস্তানে অবস্থানকালে তিনি এমন কদর্য ইঙ্গিতও করেছিলেন, যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে রীতিমত অপমানজনক। তিনি বলেছিলেন যে, ভারতের সহযোগিতায় যারা পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে নিয়োজিত,  তারা ‘ইন্ডিয়ান রাজাকার’। এভাবে নানারকমের গুজব এবং মিথ্যা প্রচারণার ভেতর দিয়ে এরশাদের সতর্ক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বৃক্ষটি ডালপালা বিস্তার করেছিল ক্রমাগত। তার ভেতর দিয়েই, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে বিভক্তি ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তার পরিপূর্ণ সুযোগ জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সিংহভাগ সদস্যই গ্রহণ করেছে।

মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার যে ভূমিকাটি সেই মুহূর্তে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তার বিভিন্ন কার্যক্রম, ভূমিকা এবং শঠতায় তা মানুষের সামনে আসতে অধিকতর বিলম্বও ঘটেনি। জিয়াউর রহমান এরশাদের মাথায় হাত বুলিয়ে যে কাজটুকু সম্পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন, এরশাদ সাহেবও আরও চাতুর্যের সঙ্গে এর পরিপূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানি গুপ্তচর হিসেবে জিয়াউর রহমানকে টেক্কা দেয়ার জন্যে বাংলাদেশে ধর্মের কার্ডটি এমনভাবে ব্যবহার করলেন, যাতে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে চীন-পাকিস্তান স্বার্থের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যায়। তবে তিনি কিন্তু ক্ষমতার মসনদে সরাসরি উপবেশন করেননি। বরং পাকা খেলোয়াড়ের মতো সেই ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করারই চেষ্টা করছিলেন। জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার পর ওই শূন্যস্থানটি অবধারিতভাবেই তার মুঠোর মধ্যে আসবে, সে ছক তিনি আগেই কেটে রেখেছিলেন। তাছাড়া, তার একটা সুবিধাই হয়েছিল যে, জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় কম পক্ষে পাঁচজনই ছিল পাকিস্তানপন্থী রাজাকার। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটা দ্বিধাগ্রস্ত অংশ তাদের সঙ্গেই যোগ দিয়েছিলেন। কাজেই জেনারেল এরশাদকে প্রধান সেনাপতির পদটির জন্য শাহ আজিজের ঐকান্তিক প্রয়াস সহজ হয়ে গিয়েছিল। এরশাদ যেই মুহূর্তেই প্রধান সেনাপ্রতির পদটি গ্রহণ করলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই সেনাবাহিনীর পাকিস্তান প্রত্যাগতদের সাহস এবং শক্তি অনেকখানি বেড়ে গেল। তখন তাদের বাধা দেয়ার জন্যে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো উঁচু মাপের সিনিয়র অফিসার আর রইলেন না। অর্থাৎ দেখা গেল, একাত্তরের পর মাত্র দশ বছরের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতায় এলো এমন একটা চক্র, যাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কোনো যোগাযোগই ছিল না এবং তখন বাংলাদেশ মূলত পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলছিল।

এটা মনে করা যেতেই পারে যে, কোনো এক বিশেষ চক্র অতিশয় নিপুণভাবে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক অর্জনকে চাপা দিয়ে পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা এবং পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্যে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

বিশ্বব্যাপী সামরিক চক্রের একটা হিসাব থাকে। কখন, কী পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মিসমার করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, সেটা অদৃশ্য শক্তির নকশায় স্থিরীকৃত থাকে। কোন পরিস্থিতি তৈরি করে সামরিক শাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়, সেটা আন্তর্জাতিকভাবে সর্বত্রই অনুসৃত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ঠিক যেভাবে পাক সমর-নায়কেরা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন লুট করে ৯২ (ক) ধারা জারি করে পূর্ববাংলার গণমানুষের নির্বাচনি অধিকার হরণ করার উত্তরোত্তর প্রয়াস চালিয়েছিল এবং পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের আবির্ভাব ঘটেছিল, ঠিক একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক জান্তাও একই ক্রিয়াকেলিতে মত্ত হলো। জিয়াউর রহমানের আগমন-নির্গমন, এরশাদের আগমন এবং পাকিস্তানি এজেন্ডা বাস্তবায়ন—এসবই একই অঙ্কের ফল।

আগেই বলেছি, এরশাদ ছিলেন রাজনীতির সুদক্ষ নট। নাটকীয় ভঙ্গিতেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা নিধন করেছেন সব সময়। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে প্রতিপক্ষ নির্মূলে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এজন্য তিনি কোনো পক্ষাপক্ষ বিবেচনা করতেন না। পাকিস্তান এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে তিনি যেমন নির্লজ্জভাবে চীন-পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছেন, ঠিক তেমনই ভারতকে প্রবোধ দিতেও তিনি কোনোরকম দ্বিধাগ্রস্ত হননি। শাসন পরিচালনার প্রথম দিনেই তিনি যে চমকটি দেখিয়েছিলেন, তা হলো—দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান এবং তার জন্য তিনি সাইকেল চালিয়ে অফিস করার ভণ্ডামিও করেছিলেন। দুর্নীতির দায়ে তিনি বেশ কয়েকজনকে কারাগারে প্রেরণ করেন। আবার পরবর্তীকালে তাদেরকেই সরকারি উচ্চপদেও বসিয়েছেন। এমনকি তাদের কাউকে কাউকে মুক্তি দিয়ে উপঢৌকন হিসেবে মন্ত্রিত্বও দিয়েছিলেন। তার এই হিসেবে ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক কেউই বাদ ছিল না। তিনি যখন বিচারপতি সাত্তারের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম গুটিটি চালেন, তখন তিনি বিচারপতি সাত্তারের ওপরে ভর করেছিলেন এবং তিনি বলেই দিয়েছিলেন যে, তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। আর তাই তিনি সাত্তারের নেতৃত্ব মান্য করবেন। কিন্তু পাশাপাশি একথাও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত না করলে, তার ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা থেকেই যাবে। তাই তিনি নিজেকে প্রকাশ্যে জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসারী হিসেবে প্রচার করতে থাকলেন। শুধু তাই নয় নিজেকে জিয়া অনুসারী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য তিনি তার দপ্তরে জিয়াউর রহমানের ছবি পর্যন্ত ব্যবহার করলেন। এই জন্যে তিনি সামরিক বাহিনীতে জিয়ার অনুসারীদের সমর্থনও আদায় করার চেষ্টা করলেন। আর এমন একটি প্রশাসনিক আদল তৈরি করার চেষ্টা করলেন, যা থেকে মনে হয় তিনি জিয়া নির্দেশিত ছকেই একটা শাসনতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যেই ক্ষমতার রদবদল চান।

তার অভিসন্ধি টের পাওয়া গিয়েছিল সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার থেকে। এই সাক্ষাৎকারটি প্রদানের ব্যবস্থাটিও তিনি অতি সুকৌশলে সম্পন্ন করেছিলেন। আর সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকা উচিত। তার এই অভিমত তিনি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমেও নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা লক্ষ করি, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তারের জয় লাভের পর রাষ্ট্রযন্ত্রের গতিপথ উল্টো দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করলো। প্রেসিডেন্ট সাত্তার বললেন, দেশের প্রশাসনে সেনাবাহিনীর কোনো বক্তব্য থাকবে না। সেনাবাহিনীর কাজ হচ্ছে দেশকে রক্ষা করা; রাজনীতি করা নয়। পক্ষান্তরে, এরশাদ বললেন, সেনা বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে চলার মানসিকতা প্রশাসনকে পরিত্যাগ করতে হবে এবং সামরিক অভ্যুথানকে এড়ানোর জন্যে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার অংশীদার করতে হবে। কেবল তাতেই ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট হত্যার মতো ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। অর্থাৎ এরশাদ সাহেব প্রকারান্তরে প্রেসিডেন্ট হত্যার ঘটনাগুলোকে জুজুর ভয় হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে পর পর দুজন প্রেসিডেন্টের হত্যার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে এবং তার সঙ্গে এরশাদের সংশ্লিষ্টতা থাকার ব্যাপারটিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তিনি বিভিন্ন সময়ে এমন ইঙ্গিতও দিয়ে যাচ্ছিলেন যে, সেনাবাহিনীকে খুশি না রাখতে পারলে বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট হত্যার মতো দুঃখজনক ঘটনা বার বার ঘটতে পারে। এক পর্যায়ে এরশাদ সাহেব প্রেসিডেন্ট সাত্তারকে বাধ্য করলেন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের। এই জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী এবং মন্ত্রীসভার যেকোনো সিদ্ধান্ত বদলে দেয়ার ক্ষমতাও এই পরিষদের ছিল। এরপরে কিছুটা সময় এরশাদ এবং প্রেসিডেন্ট সাত্তারের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই চললো। তারপর এরশাদ সাহেব নতুন এক অভিযানে নেমে পড়লেন। শুরু হলো প্রেসিডেন্টের সেই ক্ষমতাধর পদটি করায়ত্ত করার ষড়যন্ত্র। নটরাজ তার নতুন নাটকের রিহার্সেল শুরু করে দিলেন, যা মঞ্চস্থ হলো ১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ।

আমরা আমাদের পরবর্তী কিস্তিতে ওই নাটকেরই  দৃশ্যাবলি উপস্থাপন করবো। 
   
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ