• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২১, ০২:৪৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৪, ২০২১, ০৩:০৩ পিএম

গেম অন

চিঠি ফাঁস ও সাকিবের ইচ্ছা প্রকাশ

চিঠি ফাঁস ও সাকিবের ইচ্ছা প্রকাশ

একটি ই-মেইল, যার প্রাপক বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সিইও। আর প্রেরকের নাম সাকিব আল হাসান। সেটি এখন ‘চিঠি’ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিশ লাইনে লেখা এই ই-মেইলে ‘টেস্ট’ নামক কোনো শব্দ কোথাও নেই। অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেট মহলে সেই টেস্ট নিয়ে কী ঝড়ই না বয়ে যাচ্ছে!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে বয়ে চলা এই ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ-আইপিএল। যেখানে খেলার জন্য অনুমতি চেয়ে ই-মেইল করেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই তাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর অনুমতি মানে অনাপত্তিপত্র। সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডই দিয়েছে। তারপর আবার সেটা পুনর্বিবেচনা করা হবে বলা হচ্ছে কেন!

উত্তরটা খুব সহজ। দিন কয়েক আগে একটা ডিজিটাল মাধ্যমে দেওয়া সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকার। যেখানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি টেস্ট খেলতে চাই না! আকরাম ভাই আমার চিঠির পুরোটা পড়েননি!’ আকরাম খান—বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেক সাবেক অধিনায়ক। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক। এবং ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান। যে কমিটির আরেক সদস্যের নাম খালেদ মাহমুদ সুজন। তিনিও সাবেক অধিনায়ক এবং বিসিবির পরিচালক।

সাকিব আল হাসান ভারতে অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে আইপিএল খেলতে চান। সেই চিঠি আকরাম খান পড়েননি! এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। তবে তার চেয়ে বিস্ময়কর এবং অবিশ্বাস্য মনে হয়, আকরাম খানের বয়ানিতে যখন গণমাধ্যমে আসে সাকিব টেস্ট খেলতে চান না! কারণ, টেস্ট কথাটাই যেখানে লেখা নেই, সেখানে খেলতে চান না মন্তব্যটা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আকরাম খানের বিতর্কে জড়ানো, অপেশাদারত্বের সুর বেজে ওঠে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্দর মহল থেকে!

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের হাই পারফরম্যান্স ইউনিট নিয়ে সাকিবের মন্তব্যে আরও একজন ক্ষুব্ধ। তিনিও বাংলাদেশ দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক—নাঈমুর রহমান দুর্জয়। তিনি শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক নন, দেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নন, জাতীয় সংসদের সদস্য। সহজ ভাষায় জনপ্রতিনিধি। নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে রাজনীতির শিকার তিনিও হয়েছেন। সেই সময় অবশ্য নাঈমুর রহমান ‘ধৈর্য’কেই জবাব দেওয়ার সেরা অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এবার মিডিয়ার লুজ বলটা তিনি ছেড়ে দিলেই পারতেন।

সাকিবের বিশ লাইনে লেখা এক ই-মেইল নিয়ে এত বিষ উগড়ে পড়বে কেন? তার এক সাক্ষাৎকারে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানো, সব মিলিয়ে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশে ক্রিকেট সংস্কৃতি বলে এখন তেমন কিছু নেই। অবশ্য আগেও যে ছিল তা-ই বা বলছি কীভাবে? পেশাদারত্ব? সেটা একটা কাগুজে শব্দ হয়ে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। পেশাদারত্বের চর্চার জন্য যে জমিনটুকু দরকার, সেটা যত্নসহকারে তৈরি করার চেষ্টা কেউ করেননি।

সাকিব ইস্যুতে যত তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া দিলেন বোর্ডের জনাদুয়েক পরিচালক, মাশরাফির বক্তব্যের পর তারা কোনো কথা বলেননি! তাহলে এটা কি ‘পাওয়ার প্লে’? মাশরাফি শুধু একজন ক্রিকেটার নন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্যও। তিনিও একগাদা অভিযোগ উগড়ে দিয়েছেন বোর্ডের বিরুদ্ধে। কিংবা বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তাহলে কি আগামীতে বিসিবিতে কর্তৃত্বের সংঘাতের দেখা দিতে পারে? তবে বোর্ডে যিনি সবচেয়ে বেশি কথা বলেন, সেই বোর্ড সভাপতি অবশ্য সাকিব ও মাশরাফি ইস্যুতে নিশ্চুপ আছেন। যা আপাতত ভালো লক্ষণ। নিউজিল্যান্ডে যখন বাংলাদেশ টিম হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন বাইশ গজের বাইরের বিষয় নিয়ে মিডিয়া সরগরম করে ক্রিকেটীয় লাভ খুব একটা নেই। নিউজল্যিান্ড সফরে ওয়ানডে সিরিজের পর টি-টোয়েন্টি খেলবেন না তামিম ইকবাল। তিনি এখন পর্যন্ত কোনো ই-মেইল বিসিবির সিইওকে দিয়েছেন বলে জানা যায়নি। তবে গণমাধ্যমের খবর তামিম ব্যক্তিগত কারণে দেশে ফিরবেন।

বাংলাদেশ ক্রিকেট কীভাবে চলবে? ব্যক্তিগত ওয়েতে নাকি মিরপুরের শহীদ জুয়েল অ্যাভিনিউ থেকে?  হ্যাঁ, শহীদ জুয়েল অ্যাভিনিউ। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তাটাকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্রিকেটার জুয়েলের নামে নামকরণের প্রস্তাব বিসিবির ভেতর থেকেই এক পরিচালক করেছিলেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সেটা বাস্তাবয়ন হলে, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ক্রিকেটারদের অবদানেরও একটা স্বীকৃতি মিলত।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সাকিব আল হাসান যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেছেন। ক্রিকেট উত্তর জীবনের পরিকল্পনায় তার বিসিবির সভাপতি হওয়ার ইচ্ছাও আছে। সেটাও তিনি জানিয়েছেন। বছর দেড়েক আগে ক্রিকেটারদের দাবি-টাবি নিয়েও অনেক কথা বলেছিলেন তিনি। এবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যদি একজন ক্রিকেট শহীদের নামে মিরপুরে একটা অ্যাভিনিউর দাবিকে তিনি জোরালোভাবে তোলেন, তাহলে জনমানসে একটা বার্তা পৌঁছাবে, দেশের ক্রিকেট ইতিহাসটাও শুধু টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে নয়, তারও আগে থেকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান শুধু বড় ব্র্যান্ড নয়। বাকি বিশ্বের কাছে তিনি দেশের বড় ক্রিকেটীয় মুখ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে ভিত তৈরি হয়েছে শহীদ জুয়েলের মতো অনেকের আত্মত্যাগ, রক্ত, ঘাম আর পরিশ্রমে। সেই দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে সাকিব আল হাসান যদি আগামীতে বিসিবির সভাপতি হতে চান, তাতে দোষের কী আছে! তবে সভাপতি হলে দেশের ক্রিকেটীয় বাইশ গজে পেশাদারত্ব-স্বচ্ছতা-জবাবদিহি—এই তিন স্টাম্পকে আগলে রাখতে স্ট্যান্স নেবেন, সেই প্রতিশ্রুতিটা দিলে ভালো হতো।

সাকিবের লেখা ই-মেইল নিয়ে লেখাটা শুরু, সেটা দিয়েই শেষ করি। বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে বিতর্কিত ই-মেইল ফাঁস হয়েছিল যে র্বোড থেকে, সাকিবের আইপিএলে খেলার অনাপত্তিপত্র সেই বোর্ডেই গেছে। সেদিন ওই ই-মেইলের কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি ছিলেন, সেই ক্রিকেটার এখন সেই বোর্ডেরই সভাপতি। এবং সেটা তার ক্রিকেট ছাড়ার কয়েক বছর পরই। আর সেই ক্রিকেটারের নাম সৌরভ গাঙ্গুলী। আসলে ক্রিকেট কখন কাকে কী দেবে এবং কী কেড়ে নেবে, আগাম বলা কঠিন।

তবে সাকিবকে ধন্যবাদ। নিজের ক্রিকেট-পরর্বতী সময়ের পরিকল্পনায়, দেশজ ক্রিকেট প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে বসার ইচ্ছা তিনি প্রকাশ করেছেন।

 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক