
মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসেছেন, এবং দুই দিনের সরকারি সফর শেষে তিনি ফিরেও গেছেন। তার সফরকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের মধ্যে বিভক্তি ছিল। এই বিভক্তির কারণ অভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য অভিন্ন ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী— এমন অভিযোগ অসাম্প্রদায়িক ভাবধারার অনেকের। আবার একই অভিযোগ এখানকার সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট লোকদেরও— বিশেষত হেফাজতে ইসলাম নামের ধর্মভিত্তিক একটি সংগঠনের। তারা নিজেরা সাম্প্রদায়িক হয়েও অন্য ধর্মের আরেক সাম্প্রদায়িক নেতার আগমনের বিরোধিতা করেছে। এ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
সংবাদটা এতটুকুই হলে বোধহয় স্বস্তি মিলত। এতখানি সংবাদে পুরো বিষয় সীমাবদ্ধ থাকেনি। মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। গণমাধ্যমের হিসাবে এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত প্রাণও গেছে অন্তত ১৪ জনের। তবে সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজত বলছে, এসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৭ জন। এই সময়ে সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে, হরতালও করেছে হেফাজত। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধেছে। হেফাজতের অনুসারীরা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় আগুন দিয়েছে, ভাঙচুর করেছে। ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’ পুড়িয়ে দিয়েছে হেফাজতের দুস্কৃতিকারীরা, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতেও আগুন দিয়েছে তারা, সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও দপ্তরে আগুন দিয়েছে ও ভাঙচুর করেছে, ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দেশের।
এই ঘটনাগুলো ঘটেছে গত তিন দিনে। হেফাজতের তাণ্ডবে অসহায় ছিল সাধারণ মানুষ। আক্রান্তজনদের ছাড়া এর পুরোটা আসলে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ওপর অঘোষিত হলেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকায়। মোদির সফরের আগের দিন ফেসবুক ব্যবহার সীমিত করে দেওয়া হয়, ইন্টারনেটের গতি সীমিত করে দেওয়া হয় অনেক জায়গায়। ধারণা করি, তা না হলে এই নাশকতা দেশের কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধ না থেকে গ্রামেগঞ্জেও ছড়িয়ে যেত। তবু যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেটাও অনেক, প্রাণের অপচয়ের যে সংখ্যা সেটাও বিশাল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের মূল অভিযোগ মোদি ‘উগ্র সাম্প্রদায়িক, ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী’। এজন্যে তারা নরেন্দ্র মোদির সফর ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠেছিল। সফরসূচি চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই হেফাজত এই সফরকে ঠেকিয়ে দেবে বলে হুমকি দিয়ে আসছিল। কিন্তু অদ্ভুত কারণে সরকার সে হুমকিকে আরও অনেক সাধারণ হুমকির মতো গ্রহণ করেছিল। এ মাসের ১৫ তারিখে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে শানে রিসালাত সম্মেলনে হেফাজতের আমির মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক মোদির সফর ঠেকিয়ে দেওয়ার প্রকাশ্য ও সরাসরি হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। দিরাইয়ের ওই সমাবেশের পর পাশের উপজেলার এক হিন্দু যুবকের মামুনুল হকের বিরুদ্ধে এবং মোদির আগমনের পক্ষে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে ৮৮টির মতো ঘরবাড়ি সাম্প্রদায়িক হামলায় আক্রান্ত হয়েছিল। মন্দির ভাঙচুর হয়েছিল, লুটপাট হয়েছিল। অথচ অবাক করা বিষয় হচ্ছে, সরকার মামুনুল ও বাবুনগরীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। উপরন্তু এই সাম্প্রদায়িক হামলাকে হালকা করতে ফেসবুকে স্ট্যাটাসদাতা হিন্দু যুবকের সাবেক রাজনৈতিক পরিচয় সামনে এনে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে। অথচ এখানে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়া মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণই ছিল জরুরি।
শাল্লার এই সাম্প্রদায়িক হামলা ছিল মূলত হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক নাশকতার ড্রেস রিহার্সাল। এতে করে তারা আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে মোদির সফরের আগের দিন থেকে শুরু করে রোববার পর্যন্ত সারাদেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে, যেখানে প্রাণহানি ঘটেছে অন্তত ১৪ জনের। এছাড়াও আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই হামলা সত্ত্বেও হেফাজতের বিরুদ্ধে এখনও পরিষ্কারভাবে কিছু বলছে না আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার। তাণ্ডবের সময়ে পুলিশ অনেক জায়গায় বিশেষত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিল কার্যত অসহায়। সিলেটসহ অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ পুলিশের সহায়তা নিয়ে মাঠে নেমেছে। মিছিল-মিটিংয়ে পুলিশের সহায়তা নিয়ে আওয়ামী লীগকে মাঠে নামতে হয় এখন, ভাবা যায়! দলটির অতীত যেখানে আন্দোলনের সোনালি সাফল্যে ভাস্বর, সেখানে এমন সাংগঠনিক অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হেফাজতে ইসলাম বলছে ‘উগ্র সাম্প্রদায়িক’; তারাও একইভাবে ‘উগ্র সাম্প্রদায়িক’। পার্থক্য শুধু মোদির সাম্প্রদায়িকতা তার দেশে হিন্দুধর্মভিত্তিক আর হেফাজতের সাম্প্রদায়িকতা আমাদের দেশে ইসলামধর্মভিত্তিক। আমাদের দেশের হেফাজতে ইসলাম ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা চায়, তবে বাংলাদেশে তারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে মানতে নারাজ। মোদির সফরের বিরোধিতা তাই হেফাজতের জন্যে মূলত আদর্শিক পরস্পরবিরোধিতা। এই পরস্পরবিরোধিতা সত্ত্বেও তারা উচ্চকিত এখানে।
ভারতে নরেন্দ্র মোদি সাম্প্রদায়িক এক চরিত্র হলে তিনি দেশটির নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তার অতীত সাম্প্রদায়িকতায় বিষাক্ত হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা জন্মশতবর্ষে আগমনের উদ্দেশ্য একাত্তরের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা। এখানে সম্পর্কটা আদর্শের সঙ্গে আদর্শের নয়, এখানে সম্পর্কটা দলের সঙ্গে দলের নয়, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিজেপির নয়; এই সম্পর্ক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রের। সরকার রাষ্ট্রের পরিচালক হিসেবে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপন ও পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত। আপত্তি সত্ত্বেও তাই মোদি এখানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি স্বভাবতই বিজেপির প্রতিনিধি নন, সোয়া শ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের প্রতিনিধি। তাই তাই তার সফরের বিরোধিতা আমরা ব্যক্তি মোদির জন্যে করতেই পারি, কিন্তু কোনোভাবেই সেই বন্ধুরাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারি না। ব্যক্তির দুর্বলতা, সমস্যার কারণে সেই ব্যক্তির প্রতি আমাদের আপত্তিতে নৈতিকতার দিক থেকে নাগরিক হিসেবে স্রেফ প্রতিবাদই করতে পারি। কিন্তু প্রতিরোধের জন্যে রাস্তায় নামতে পারি না। রাস্তায় নামলে সেটা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির বিরোধিতা করা হয়; রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ জানানো হয়ে যায়।
প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল সকল মহলের পক্ষ থেকে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতাকে সরল বিশ্বাসে প্রাথমিকভাবে সমর্থন করাই যায়। কিন্তু এই সফরের বিরোধিতার নামে প্রতিরোধের চেষ্টা, এবং প্রতিরোধ করতে গিয়ে নাশকতা, ভাঙচুর কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এখানে প্রতিবাদকারী নয় প্রতিরোধকারীর উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। হেফাজতে ইসলাম নামের উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মোদির আগমনের নামে যা করেছে সেগুলো তাই স্রেফ নাশকতা। ধর্ম এখানে বর্ম, সাইনবোর্ড ও বিজ্ঞাপন; এর বেশি কিছু নয়।
মোদি এসেছেন, চলেও গেছেন। কিন্তু তার আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম সারাদেশে যে তাণ্ডব চালিয়েছে এটা স্রেফ মোদিবিরোধিতাই নয়, এটা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানের শোডাউন বিশেষ। এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পুড়েছে আমাদের অসাম্প্রদায়িকতার চিহ্নগুলো, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা-সম্পদ, এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ধাক্কা খেয়েছে আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দীর্ঘ স্বপ্ন। মোদি এখানে স্রেফ উপলক্ষ, উদ্দেশ্য অন্য। আর তা হলো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর বর্ণিল আয়োজনের গায়ে কালি লেপ্টে দেওয়া। প্রাথমিক অবস্থায় এরা সফল হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে সরকার-প্রশাসন-আওয়ামী লীগ; এবং পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে তাদের ব্যর্থতার মাশুল গুনছে পুরো দেশ।
এই যে ব্যর্থতা এখান থেকে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের পথে না হেঁটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের এই ধরনের অপরাজনীতি বন্ধ করতে হবে, সংবিধানে ফিরিয়ে আনতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে, বাদ দিতে হবে রাষ্ট্রধর্মের ধারণাটাও। তা না হলে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আমাদেরকে পেছনে টেনে ধরবে। তখন সামনে এগুনোর পথ আর খোলা থাকবে না আমাদের।
হেফাজতে ইসলাম যে শোডাউন ও নাশকতা করেছে সেগুলো মাথায় রেখে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করা চলবে না। হেফাজতের প্রতি অদৃশ্য ও গোপন অনুরাগ ঝেড়ে ফেলে সামনে এগুতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা অনেক ধর্মপ্রাণ, ধর্মপ্রচারে বঙ্গবন্ধু সরকার-হাসিনা সরকার কী করেছে এই ধরনের প্রচারণায় না গিয়ে দেশের স্বার্থে অসাম্প্রদায়িকতার চিন্তাচেতনাকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের যে সকল নেতাকর্মী বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ের চাইতে তাদের ধর্মীয় পরিচয়টাকে প্রাধান্য দেন তাদেরকে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। একাত্তরের চেতনা স্রেফ দলীয় আর মুখের স্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিশ্বাসের মধ্যেও নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে মুক্তি নেই আমাদের।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক