• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মে ১৬, ২০২১, ০১:৪৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৬, ২০২১, ০১:৪৮ পিএম

গেম অন

বাংলাদেশে ক্রিকেট-কোচিংয়ের ভবিষ্যৎ কী?

বাংলাদেশে ক্রিকেট-কোচিংয়ের ভবিষ্যৎ কী?

ক্রিকেট পৃথিবী এখন অনেক বেশি উন্মুক্ত। নাগরিকত্বের দাবি ছাপিয়ে পেশাদারিত্বের উত্থান ঘটেছে অনেক আগেই। ঠিকঠাক টাকা পেলে যে কোন দেশ নিজেদের অধিগতবিদ্যা অন্য দেশকে ঢেলে দিচ্ছে। ডলার নাগরিকত্বের দাবি ছাপিয়ে পেশাদারিত্বকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। গোটা ক্রিকেট বিশ্বের চেহারাই এখন তাই। ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো এবং প্রতিষ্ঠিত দুই শক্তি ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াও নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞানজাত তথ্যের চালাচালি করছে! ডলারের কাছে সব বেষারেষি হাওয়া হয়ে যাচ্ছে! পরিবর্তিত ক্রিকেট দুনিয়ায় কে কোন দেশের নাগরিক আর কোন দেশকে কোচিং করাচ্ছেন সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই। ভাবনা-চিন্তা একটাই—ডলারের বিনিময়ে আপনি সেই দেশটাকে কতোটা সাফল্য দিতে পারছেন।

ঘরোয়া ক্রিকেট আড্ডায় অনেকে বলেন, ‘আমাদের ‍ক্রিকেট কোচিং অনেক বেশি বিদেশি নির্ভর হয়ে পড়ছে। স্থানীয় কোচদের মূল্যায়ন করা হয় না। আবার কাউকে কাউকে অতিমূল্যায়ন করা হয়!’ আসলে ক্রিকেট কোচিংও একটা সংস্কৃতি দাবি করে। দুই দশকেরও বেশি সময় টেস্ট ক্রিকেট খেললেও সেই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। পরনির্ভরশীলতা আমাদের ক্রিকেট কোচিংয়ের মূলমন্ত্র। এই মুক্ত দুনিয়ায় দাঁড়িয়েও বলতে হবে, এটা আমাদের আগামী দিনের ক্রিকেট স্বাস্থ্যের জন্য ভাল কোনো লক্ষণ নয়।

কথাটা শুনতে একটু কর্কশ-রুঢ় মনে হতে পারে। তারপরও বলতে হবে: আমাদের সাবেক ক্রিকেটাররাও আন্তর্জাতিক পেশাদার মানসিকতা নিয়ে কোচিংয়ে আসতে চান না। অথবা সেই পেশাদার কোচিং মানসিকতাই তাদের নেই! দায়টা ক্রিকেটারদের চেয়ে ক্রিকেট বোর্ডের কাঁধে বেশি বর্তাবে। কারণ, বোর্ড না পেরেছে তাদের কোচিং এ উদ্বুদ্ধ করতে, না নিয়েছেন কোচ তৈরির কোন উদ্যোগ। সাবেকরা অনেকে কোচিং কারাচ্ছেন, সেটা তাদের খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা আর ক্রিকেটীয় অনুভূতির উপর ভর করে। আবার গত শতাব্দিতে যারা কোচিংকে ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন, অন্যদেশ থেকে উন্নত প্রশিক্ষণের কোর্স করেছেন, তারা বোর্ডের কাছে ব্রাত্য! কারণ, এখানে ক্লাব বলুন আর বয়সভিত্তিক দলের কোচ নির্বাচনে বায়োডাটায় ইয়োলো মার্ক করা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আনুগত্য, আপনার যোগ্যতা নয়!

আধুনিক ক্রিকেট—সেটা আন্তর্জাতিক বা দেশজ যাই হোক না কেন—একজন কোচের কাছে অনেক কিছু দাবি করে। ক্রিকেটীয় জ্ঞান বা আরো পরিষ্কার করে যদি বলি ক্রিকেট বিজ্ঞান আপনাকে জানতেই হবে। পাশাপাশি মনোবিজ্ঞান, শারিরীক বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ আপনার জানা থাকতে হবে। কিন্তু সেই পাঠ নিতেই আমাদের কয়জন কোচ আগ্রহী? তাদের অজান্তে হলেও ভেতরে ভেতরে একটা ক্রিকেটীয় মৌলবাদী চিন্তা কাজ করে, ‘আমরা কি কম জানি!’ যে কারণে বোর্ডকর্তারাও খুব দ্রুত উপসংহারে পৌঁছে যান। আমাদের দেশে উন্নত মানের কোন ব্যাটিং, বোলিং এমন কি ফিল্ডিং কোচ নেই! আর ক্রিকেট আবেগের তীব্রস্রোতে ভাসতে থাকা এদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যারা ক্রিকেট শেখাচ্ছেন, সেই ছবিটা দেখলে বোঝা যায়, আমরা কোন জমানায় আছি। তারপরও তাদের ধন্যবাদ, তারা কিছু ক্রিকেটারকে তুলে আনছেন।

মিরপুরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একটা একাডেমি আছে। সেখানে কোচ তৈরির তেমন কোন পঠনপাঠন নেই। আসলে আগামী দিনে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের কোচ তুলে আনার কোন পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না! সেখানে যারা দায়িত্বে আছেন, তারাইবা সেটা পরিচালনার কতোটা যোগ্য সেই প্রশ্ন তুলেও কোন লাভ নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিশ্বের অনেক বোর্ডের চেয়ে ধনী, কিন্তু ক্রিকেট-চিন্তায় খুব দীন। যে কারণে উঠতি কোচদের ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা ভাবতে পারেন না। বোর্ড পরিচালকরা দলের সঙ্গে বিদেশ ঘুরে বেড়িয়ে যে জ্ঞানই অর্জন করুন না কেন, তা ক্রিকেটারদের খুব একটা কাজে দেয় না। আর সে কারণে জাতীয় দল বা একাডেমির কোচের জন্য বারবার ‘আর্ন্তজাতিক টেন্ডার’ দিতে হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে। কিন্তু যিনি যেভাবে, যে মাধ্যমেই আসুন না কেন, ফেরার সময় খুব একটা সুঃখস্মৃতি নিয়ে ফিরতে পারেন না। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য যা মোটেও স্বস্তিদায়ক কোন বিজ্ঞাপন নয়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেম ডেভেলপমেন্ট কিংবা ক্রিকেট অপারেশন্সে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা তো প্রত্যেকেই কোন না কোন সময় বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারাই নতুন চিন্তা, নতুন প্রযুক্তি আর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেশজ ক্রিকেট দিগন্তকে প্রসারিত করবেন। কিন্তু তারাও কোথায় যেন আপসকামী মানসকিতায় ঘুরপাক খাচ্ছেন! সংস্কারবাদী হওয়ার সাহস দেখাতে চান না কেউ-ই। তাদের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি সংস্কারবাদী কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন সাকিব-মাশরাফিরা। তবে সেটা গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমে। টেলিভিশনের টিআরপি অথবা আগামী দিনের বিনিয়োগ, যে কারণেই হোক, তবুও তারা বলছেন।

কথা শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশের সাউথ আফ্রিকান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোকে নিয়ে। কারণ, তার কোচিংয়ে বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতার ব্যালেন্সশিটে একটা ঘরে অনেক বেশি সংখ্যা জমে গেছে। সেই হেডটার নাম: ব্যর্থতা। শ্রীলংকার বিপক্ষে তিন ওয়ানডের হোম সিরিজ হতে যাচ্ছে তার জন্য টিকা থাকার এক লড়াইয়ের নাম। সিরিজ জিততে না পারলে আপাতত বাংলাদেশের কোচিং স্টাফের তালিকায় সবার উপরে থাকা নামটা ভ্যানিশ হয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না!

 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক