প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম সচিবালয়ে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে যে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও ন্যক্কারজনক। তাকে সচিবালয়ে একজন উপসচিবের পিএসের রুমে অবৈধভাবে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আটকে রেখে, নির্যাতন করে এরপর ‘রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির’ অভিযোগ এনে পুলিশে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারপর থানায় তার বিরুদ্ধে ‘৬২ পাতার নথি’ চুরির অভিযোগে ব্রিটিশ আমলের বর্তমানে প্রায় অপ্রচলিত এক আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মামলাটি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
সচিবালয়ে একটা রুমে আটকে রেখে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন নারী কর্মকর্তা কর্তৃক তার গলা চেপে ধরার ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার ওপর মানসিক নির্যাতনের যে প্রমাণগুলো বিভিন্ন মাধ্যমের সূত্রে দেশবাসীর প্রায় সবাই অবগত। রূঢ় আচরণের পাশাপাশি তার মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, কারও সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। সাংবাদিকেরা এ ঘটনার খবর পেয়ে সচিবালয়ের ভিড় করলেও তাদের কোনো তথ্য দেয়নি মন্ত্রণালয়ের লোকজন। তার ওপর পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী চলা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ধকল সামলাতে না পেরে তিনি একাধিকবার বমি করেন, অসুস্থ অবস্থায় মেঝেতেও পড়ে যান। অসুস্থ রোজিনা ইসলাম, তবু দেশের স্বাস্থ্য খাতের দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকজন তাকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। বরং সময়ে-সময়ে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়েছে। এবং একপর্যায়ে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। পুলিশ প্রথমে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললেও হাসপাতালে না নিয়ে থানায় নিয়ে যায়।
এই সময়ে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা রোজিনা ইসলামের গায়ের হাত তুলেন, সচিবালয়ে দায়িত্বে থাকা একজন পুলিশ সদস্য তাকে নির্যাতন করেন। এই শারীরিক নির্যাতনের বাইরেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী মানসিক নির্যাতনের জড়িত ছিলেন। রোজিনা ইসলামের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ রোজিনার হাতে-গলায় একাধিক খামচির দাগ। একজন নারী কর্মকর্তা তার গলা চেপে ধরার পাশাপাশি বুকে হাঁটু দিয়েও চেপে ধরেন। রোজিনার বোন সাবিনা ইয়াসমিনের অভিযোগ, তাকে নির্যাতন করা একাধিক লোক নিউজ ও লেখালেখির জন্যে ‘মাটির মধ্যে পুঁতে’ ফেলারও হুমকি দেয়। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তার দাবি পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা হয়নি, আটকে রাখা হয়েছিল মাত্র আধা ঘণ্টা। মন্ত্রীর আরও দাবি রোজিনা ইসলামকে মন্ত্রণালয়ের কেউ নির্যাতন করেনি, উল্টো তিনিই মন্ত্রণালয়ের লোকজনকে খামচি দিয়েছেন। যদিও সাংবাদিকেরা এসব বক্তব্যকে মিথ্যা বলে প্রতিবাদ জানালে তিনি ‘ওখানে ছিলেন না’ বলে তার অসত্য অভিযোগ আড়ালের চেষ্টা করেন। উল্লেখের ব্যাপার হচ্ছে, মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্যাতনকে আড়াল করতে অসত্য বক্তব্যের আশ্রয় নিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার পর তিনি উপস্থিত না থাকার কথাটাই বলছেন।
রোজিনা ইসলামকে নিগ্রহের কী কারণ—এটা বের করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, লুটপাটের প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে তিনি তাদের চক্ষুশূল। তাকে একটা রুমের মধ্যে আটকে রেখে যখন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছিল, তখন তার নিউজ ও লেখালেখির কারণে তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলার হুমকিও দিয়েছে তারা। তার গলা চেপে ধরা, বুকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরার যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টারই প্রমাণ বহন করে। আক্রোশে এতখানি উন্মত্ত ছিল তারা যে লেখালেখির কারণে প্রাণ হারানোর উপক্রম হয়েছিল তার।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম এখন তার পত্রিকার স্বাস্থ্য খাত কাভার করলেও নানা ক্ষেত্রে সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন। তার অনেক প্রতিবেদন সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে, সরকারও অনেক ক্ষেত্রে শুধরানোর সুযোগ পেয়েছে। ২০১৪ সালে যে পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করেছিল সরকার, সেটা এই রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে দেওয়া তৃতীয় পর্বের সম্মাননায় ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি—এমন প্রতিবেদন এসেছে তার হাত ধরে। তার এই প্রতিবেদনগুলো যে মিথ্যা ছিল না, তা প্রমাণিত হয়েছিল। ওই ঘটনাও সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। সম্মাননা ক্রেস্টের কাঠেও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারের সাত কোটি টাকা আত্মসাতের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও বেরিয়েছিল তার কাছ থেকে।
গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে রাশিয়া-চীনের সঙ্গে টিকার চুক্তির নথি সরানোর যে অভিযোগ করেছেন, তা অসত্য বলে প্রমাণ হয় গত মাসের ২৫ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। যেখানে রোজিনা লিখেছিলেন, ‘‘রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি এখনো করেনি বাংলাদেশ। শুধু রাশিয়া টিকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিলে তা গোপন রাখা হবে, এমন একটি গোপনীয়তার চুক্তিতে সই করা হয়েছে।’’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আগে গত মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, “রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের জন্য চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যৌথ উৎপাদনের বিষয়ে চুক্তিটা হয়েছে।”
স্বাস্থ্যমন্ত্রী না হয় টিকাসংক্রান্ত নথি চুরির অভিযোগের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, কিন্তু তার অধীনস্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভের কারণ রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদন যেখানে তিনি ধারাবাহিকভাবে মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে যাচ্ছিলেন। স্বাস্থ্যে ১৮০০ জনকে নিয়োগ নিয়ে রোজিনা ইসলাম করেন ‘এখন এক কোটি দেব, পরে আরও পাবেন’ শিরোনামের প্রতিবেদন। এ নিয়ে চিঠি চালাচালিও করেছে তারা যেখানে সচিবকে চিঠি দিয়ে জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ নিয়োগ কমিটির দুই সদস্যের।
করোনাকালে ৩৫০ কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন রোজিনা। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০ মাস ধরে অক্সিজেন সরবরাহ সামগ্রী ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্র ৩০০ ভেন্টিলেটর অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন। করোনা পরীক্ষার কিটের ঘাটতি নিয়ে দুই ধরনের তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক যে অফিসেই যান না এমন সাহসী প্রতিবেদনও করেছেন তিনি। মোদ্দাকথা, এক রোজিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাতের ঘুম প্রায় হারামই করে ফেলেছিলেন। যদিও ওই সব প্রতিবেদনকে সরকার বৃহৎ পরিসরে পাত্তা দেয়নি, যাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এমন ব্যবস্থাও নেয়নি; তবু অসাধু আমলাদের অসততাকে সামনে উপস্থাপন করে গেছেন। এসবের কারণেই তারা তার প্রতি ছিল ক্ষুব্ধ।
রোজিনা ইসলাম তার কাজ করে গেছেন, কাজ করে যাবেন বলেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এখনো। তার প্রতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিগ্রহ সত্ত্বেও তিনি তার লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়ার কথা বলেননি। মন্ত্রণালয়ের মামলায় কারাগারে যাওয়ার আগে চিৎকার করে বলেছেন, ‘‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর করা প্রতিবেদনের জন্যই আমার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে।’’
রোজিনা ইসলামের প্রতি সরকারের এই আচরণ অগ্রহণযোগ্য ও ন্যক্কারজনক। এটা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার অপচেষ্টা। আমরা এর নিন্দা জানাই। এই মামলা, নির্যাতন ও হয়রানির মাধ্যমে সরকারের কোনো ধরনের লাভ আছে বলে মনে হয় না, বরং ক্ষতিই বেশি। এতে করে এই সরকারের ওপর মানুষ আরও বেশি করে আস্থাহীন হয়ে পড়বে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি স্রেফ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরই নয় এটা সর্বব্যাপ্ত এবং সরকারই এই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করবে।
প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম এই সময়ের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল নাম। তার প্রতিবেদনগুলো অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই তারা তাকে সচিবালয়ের একটা রুমে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি মাটিতে পুঁতে ফেলার হুমকি দিয়েছে। অনিয়মতান্ত্রিক ও অবৈধভাবে আটকে রেখে এরপর পুলিশে দিয়েছে। মামলার পর কারাগারে গেছেন রোজিনা। এই ধাপগুলো শেষে পরের দিন তাকে করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে যেভাবে শত-শত পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় আদালতে নেওয়া হয়েছে তাতে করে মনে হচ্ছে ভীত আমলাতন্ত্র ও তার অনুসারীরা তাকে রীতিমতো ভয় পাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অসত্য বক্তব্য, অসত্য অভিযোগের পর এটা প্রমাণ হচ্ছে তারা সম্মিলিতভাবে আদতে রোজিনাকে এবং রোজিনার কলমের শক্তিকেই ভয় পাচ্ছে। রোজিনাকে আটক-অভিযোগ ও মামলা প্রক্রিয়ায় তারা যদি সৎ প্রক্রিয়া অনুসরণ করত তাহলে নিশ্চয়ই এভাবে এতখানি ভয় পেত না।
রোজিনার কলমের শক্তি টের পেয়েছে অসাধু, অসততায় নিমজ্জিত একদল লোক। এটাই কলমের শক্তি। কলমের এই শক্তির জয় হোক!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক