• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৩০, ২০২১, ১২:০৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৩০, ২০২১, ১২:০৭ পিএম

তারুণ্যকে অন্ধকারে ঠেলে উন্নয়ন হবে কি?

তারুণ্যকে অন্ধকারে ঠেলে উন্নয়ন হবে কি?

আমরা এমনই এক দুর্ভাগা জাতি, যখন জাতিগত নৈতিকতার মানোন্নয়ন, চরিত্রগত দৃঢ়তা ও আত্মশুদ্ধির প্রতি মনোযোগী হওয়াটা খুব বেশি জরুরি ছিল, ঠিক সেই ক্রান্তিকালে আমরা শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা, পাঠাভ্যাস তৈরি, সাহিত্য চর্চার প্রসার ও অন্যান্য মানবিক কর্মসূচীর প্রতি বিন্দুমাত্র কোনো প্রচেষ্টা না রেখে টিকটক নামের অ্যাপে অসভ্য অশ্লীল ভিডিও তৈরি, ইউটিউবে অর্থহীন, প্রজ্ঞাহীন, বিকৃত তথ্যসমৃদ্ধ নোংরা কন্টেন্ট বানানো ও প্রচার এবং দেশজুড়ে মাদকের বহুল প্রসারের পথ প্রশস্ত করে তুলেছি তরুণ প্রজন্মকে বিনোদন দেওয়ার অভিপ্রায়ে।

আমাদের শৈশবে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। আলোকিত মানুষ চাই- এই শ্লোগানে আমাকে আর আমার বন্ধুদের তিনি আকর্ষিত করেছিলেন, নানা ধরণের ও বিষয়বৈচিত্রের বই পড়ায় আগ্রহী ও মনোযোগী বানিয়ে ছেড়েছিলেন, দেশবিদেশের চিত্রকলা, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের দিকে মন ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, পরিবার থেকেও আমরা বই পড়তে, সিনেমা দেখতে শিখেছিলাম। কিন্তু সায়ীদ স্যারের নিরলস প্রচেষ্টা আমাদের ভালো বই পড়া এবং তার ভিতর থেকে জীবনরস ও জ্ঞানরস সংগ্রহ করে তা নিয়ে ভাবতে ও আলোচনা করতে শিখিয়েছিল।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এখনও আছে। আরো বড় সুউচ্চ ভবন হয়েছে, আমাদের সময়ের সেই শ্যাওলা ধরা সবুজ দোতলা আর নেই। বড় বড় কর্মসূচী আছে, পাঠাগার আছে। কিন্তু কি যেন নেই! কী সেটা? সম্ভবত তারুণ্যের যে উন্মাদনা এককালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে ঘিরে ছিল, সেটি এখন দারুণ রকম মিসিং।

সবাই বলে, আমাদের যুগে ইন্টারনেট ছিল না, ফেসবুক-টুইটার ছিল না বলে লোকে বইটই পড়ত। এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না, কারণ অনলাইন তাদের সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে।

চরম ভুল আর মিথ্যে একটি কথা। কারণ, এই অনলাইনের ব্যাপক প্রসারের যুগেও প্রচুর তরুণ তরুণী বই পড়ছে, বরং বলা যায় অনলাইনেই নানা অ্যাপে তারা সুলভে সহজলভ্য বই পাবার সুযোগ নিচ্ছে ভালো ভাবেই এবং পড়ছে। শুধু তাই নয়, অনলাইন জ্ঞানপিপাসু ছেলেমেয়েদের আরো সুবিধা করে দিয়েছে তথ্য ও জ্ঞানের ভাণ্ডারকে কাছে পাওয়ার। কিন্তু চিন্তার বিষয়টি হলো, এদেশে এই তরুণ তরুণীরা সংখ্যায় ভীষণ রকম কম। প্রায় হাতে গোনা।

অথচ সারা পৃথিবীতে বইয়ের আবেদন আগের মতই আছে। উন্নত দেশগুলোতে বইয়ের দোকানে উপচে পড়া ভিড় থাকে। নতুন নতুন বই প্রকাশ হয়। পুরোনো বইয়ের নতুন সংস্করণ হয়। অনুবাদ হয়। সাহিত্য, গবেষণা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ধর্ম, নৃবিজ্ঞান, দর্শন, নারীবাদ, রাজনীতি, সমাজনীতি- যার যা ভালো লাগে, সব ধরণের বইয়ের অবাধ সরবরাহ। পাঠক আসছে, কিনছে। এর বাইরে পাঠাগার আছে। পাঠাগারগুলো এখন আধুনিক। পাঠাগারে বসেই অনলাইনে সার্চ করছে পাঠক, বই খুঁজে পাচ্ছে মুহুর্তে। তথ্য কপি করে নিতে পারছে। আরো কত কি!

বিশ্বে সিনেমা, সঙ্গীত, চিত্রকলাসহ প্রতিটি শিল্পের শাখা জমজমাট হয়ে উঠছে। তাহলে কেন আমরা, এই বাঙালিরা, শুধু অনলাইনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছি, আর এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করছি নিজের হাতে, যে প্রজন্ম শিল্প-সাহিত্যবিমুখ? কেন একটি প্রজন্ম অনলাইনের অসীম সাগর সেঁচে মূল্যবান তথ্য, উপাত্ত, জ্ঞানের ভান্ডার, সুস্থ আনন্দ, বিনোদন রেখে কেবল তুলে আনছে এর নিকৃষ্ট বর্জ্যটুকু, নোংরা নেশার হটলাইনে যুক্ত হচ্ছে আর ঢুঁ দিচ্ছে জঙ্গীবাদী গ্রুপগুলোতে? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত এত সুস্থ সুন্দর প্লাটফর্ম রেখে এই প্রজন্মের বহু তরুণ তরুণী কেন শুধু অশ্লীলতা আর বিকৃতির স্বার্থে অনলাইনকে ব্যবহার করছে?

হয়তো বহু কারণ বলতে পারবো আমরা। সুন্দর একটি শিক্ষাক্রমের অভাব হয়তো আসবে শুরুতেই। স্কুলের পরিবেশ, শিক্ষাসূচী, শিক্ষকদের অশিক্ষা কুশিক্ষা, মৌলবাদী মনোভাব, কুসংস্কার ইত্যাদিও যুক্ত হবে। এরপর পরিবারের ভূমিকা। প্রযুক্তি এসেছে হাতে হাতে, মানুষ শিক্ষিত হয়নি তার আগে। বাবা মা জানে না কিভাবে সন্তানকে সুস্থ সুন্দর করে গড়ে তুলতে হয়। অশিক্ষিত বাবা-মা চাইছে সন্তান বড় হয়ে কাড়িকাড়ি টাকা আয় করুক। সেভাবেই বাচ্চাদের তৈরি করছে। এদিকে সন্তানের মনোজগৎ যে এক অন্ধকার ক্লেদাক্ত গলির মতো ঘিঞ্জি আর অসুস্থ, সেটি দেখবার মতো শিক্ষা তাদের নেই, সময় নেই, ইচ্ছাও নেই।

ছোটকালে আমি একা একা লাইব্রেরিতে যেতাম। বৃহস্পতিবার বিকেলে। সারাবিকেল বই পড়ে বিকেল শেষ হলে দুটো বই বড়লদাবা করে ফিরতাম ঘরে। উইকএন্ডের খোরাক সে দুটো। ভালো কাজ করলে আব্বু মা পুরস্কার দিত বই। জন্মদিনে বই। ঈদে বই। এমনকি বোনের বিয়ের উপহারের বড় অংশ ছিল বই। আর এখন?

এখন আমার ভাগ্নির জন্মদিনে উপহার পায় দামী পোশাক, জুতো কিংবা টাকা। বিয়েতে ডিনার সেট, গহনা, শাড়ি। এই তো আমরা। অথচ পৃথিবী জুড়ে বই পড়া থেমে যায়নি। বই উপহারের চল উঠে যায়নি। শুধু আমরা, বাঙালিরাই বইকে লাটে উঠিয়ে দিয়েছি, আমাদের লোভ আর অসীম চাহিদার কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছে সুস্থ জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতির ধারা।

নেটফ্লিক্স সহজলভ্য। আরো বহুকিছু আছে। হৈচৈ, বায়োস্কোপ, আড্ডা টাইমস, প্রাইম ভিডিও, এমনকি বিনামূল্যের ইউটিউবে কত কত ভালো সিনেমা সঙ্গীত আরো কত কিছু। কিন্তু এদেশের রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম মফস্বলে জনপ্রিয়তা কার? হিরো আলমের। ভালো সিনেমা বাজার পায় না। হলে রাখে না। বন্ধ হয়ে যায়। আর হিরো আলম একের পর এক অশ্লীল সিনেমা ও কন্টেন্ট তৈরি করতে থাকেন। টিকটকের দর্শক কারা? বিপুল পরিমাণ দর্শক পায় বলেই তো টিকটকে অশ্লীলতার এই জোয়ার থামে না, বরং দিন দিন আরো বাড়ে। এদেশের টিকটকারের নাম "রিদয় বাবো"- যারা নারী পাচার ও ধর্ষণ করে। যারা অপরাধী তারাই আজকাল টিকটকের বাজারে সরব। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ীদের অশ্লীল ওয়াজ। নারীবিদ্বেষী, আধুনিক সমাজ বিদ্বেষী, প্রগতি-বিদ্বেষী জ্ঞানবিজ্ঞান-বিদ্বেষী মৌলবাদী চক্রের হাতে আমরা কি তুচ্ছ আর অসহায় হয়ে উঠছি দিনদিন! কি দুর্ভাগ্য আমাদের!

এদিকে শহরে মাঠ নেই যে দুদণ্ড বসবে কেউ দিনশেষে। আড্ডা দেবে। তরুণদের সংগঠিত করবার কেউ নেই। তাদেরকে আলোর পথ দেখাবার কেউ নেই। ঘরে বাবা মা আছে, যারা নিজেরাই টিকটক দেখে আর সন্তানের হাতে তুলে দেয় মোবাইল ফোন যাতে সন্তান তাকে বিরক্ত না করে। শিশু বা কিশোর সন্তান কী দেখছে, কী করছে, তা দেখবার কেউ নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে সে পড়ছে মাদক চক্রের খপ্পরে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা একটা প্রজন্মকে ইয়াবা দিয়ে শেষ করে দিলো, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এলএসডি। একটা তরতাজা তরুণ নিজের গলায় নিজেই দা’য়ের কোপ বসিয়ে মরে গেল নেশায় পড়ে। পুরো দেশ আর জাতি আজ এমন এক নেশার খপ্পরে পড়ে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ঘুরছে। হাতের কাছে দা পেলে বসিয়ে দেবে গলায়। এই নেশা টাকার, পুঁজির, লোভের, অসীম চাহিদার। এই লোভের কোনো সৌন্দর্য নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনি একটি বইয়ের ছবি পোস্ট করবেন। একদল সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়বে- ‘‘আপনার টেবিলটা সুন্দর, আপনার পর্দাটা সুন্দর, আপনার বই ধরে রাখা হাতে যে অলঙ্কারটা আছে, সেটি সুন্দর।’’

এই হলো আমাদের অবস্থা। আমরা সারাক্ষণ পণ্য আর পুঁজির নেশায় ছুটছি। সব চাই আমাদের। শুধু সুস্থ নান্দিনিকতাটুকু ছাড়া। অনেক অনেক শো অফ চাই। কারণ বাদ্য যার বেশি বাজে, সেই আজকাল লাভবান হয়। তাই আমাদের সন্তানকে চকচকে পোশাক পরিয়ে দামি ইস্কুলে পাঠাতে হয়। সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাতে হয়। কিন্তু সন্তান ঘর থেকে বেরিয়ে কী করছে, ঘরেই বা কী গুড় খাচ্ছে, তা দেখার সময় আমাদের নেই। স্কুলও জানে না কিভাবে একটা জেন্ডার সেন্সিটিভ, সুস্থ সুন্দর প্রজন্ম গড়তে হয়। তারাও শুধু শেখাচ্ছে কিভাবে বিরাট কোনো চাকরি পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রও ঘুরছে পুঁজির উন্নতির নেশায়। যত জিডিপি তত নাকি উন্নয়ন। উন্নয়নের এই সংজ্ঞা কারা করেছে? কোন সে অন্ধ মূর্খের দল? যে সমাজে তরুণদের চোখে স্বপ্ন নেই, দেশপ্রেম নেই, মানবপ্রেম নেই, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি নেই, সুন্দরের প্রতি আগ্রহ নেই, সুস্বাস্থ্য নেই, মনে আনন্দ নেই- সেই রাষ্ট্র উন্নয়নের মিছিলে জায়গা পেল কিভাবে? কোন সে সূচকে? আমার তা জানা নেই। কিন্তু জানতে হবে। প্রশ্ন তুলতে হবে। উত্তরও দিতে হবে রাষ্ট্র ‍যারা চালাচ্ছেন, তাদেরকে। একটি অসুস্থ, দিকভ্রান্ত প্রজন্ম গড়ে পথে ছেড়ে দেয়ার দায় মাথায় নিয়ে তাদের উপায় খুঁজতে হবে মুক্তির, এবং তা আজই, এক্ষুনি। আর সময় নেই হেলায় হারাবার। আমাদের ক্ষতি হয়ে গেছে অনেক। কতটা, তা আমাদের সমাজের অসুস্থ শরীর থেকে বেরিয়ে আসা ক্লেদাক্ত ঘা’য়েদের নানা কীর্তির সংবাদেই পড়তে পারছি আমরা। এই ঘা দ্রুত ছড়িয়ে যাবে, ছড়াবে সমাজদেহের সর্বত্র, আর পরিত্রাণের কোনো উপায় বেঁচে থাকবে না।   

লেখক: সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর