• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২১, ০৫:১৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৩, ২০২১, ০৫:১৯ পিএম

করোনার ধাক্কা সামলাতে গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষায়

করোনার ধাক্কা সামলাতে গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষায়

২০২০ সাল থেকে সারাবিশ্বে মানব জাতির সঙ্গে করোনা ভাইরাসের লড়াই চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি এখন সংকটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতির এত গভীর সংকট আর দেখা যায়নি। করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সংকট অর্থনীতির সব খাতকে কম বেশি আঘাত করছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ খাতটি হচ্ছে শিক্ষা খাত। এ খাতের ক্ষতি অপূরণীয়। অন্যান্য খাত হয়তো পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে কিন্তু শিক্ষার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা আর পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে না। কেননা শিখন প্রক্রিয়া সময়রে সাথে সম্পর্কিত।

ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশ ৩ কোটি ৬৮ লাখ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাশ ও নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনের প্রায় অর্ধেক বছর হারাচ্ছে। এ পরিমাণ শিক্ষাজীবন অপচয়ের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে একজন শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে প্রায় ১৩ শতাংশ। দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির ক্ষতি হবে জিডিপির প্রায় ৩৩ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে ১১৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে। আর পরিস্থিতি উন্নতির দিকে গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হবে ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বনিক বার্তা, ৫.৬.২০২১)। শিক্ষা খাতের বড় ক্ষতি কিভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তা বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে।

গত ৩ জুন করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশের  ৫০তম  বাজেট এমন সময়ে উপস্থাপিত হল যখন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি উদযাপন করছি। প্রস্তাবিত বাজেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ আকারের বাজেট যার আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬ শত  ৮১ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ১৭.৩৮ শতাংশ । এবার বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭১ হাজার ৯ শত ৫৩ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ছিল ৬৬ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রস্তাবিত শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে ৫ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। শতাংশের হিসেবে বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অঙ্কের হিসবে দেখা যায়, বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু জিডিপি এবং মোট বাজেটের আকারে প্রবৃদ্ধি কমেছে। গত অর্থবছরে শিক্ষা খাতে  বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২.০৯ শতাংশ এবং বাজেটের ১৭.৯০ শতাংশ এবং তা নেমে যথাক্রমে ২.০৭ শতাংশ এবং ১৭.৩৮ শতাংশ হয়েছে। গত কয়েক বছরে শিক্ষা খাত বাজেট জিডিপির হিস্যায় প্রায় একই রয়েছে এবং প্রস্তাবিত বাজেট চলতি বাজেটের চেয়ে ০.০২ শতাংশ কম।

সূত্র: অর্থ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়

২০১৮ সালের বিশ্বব্যাংকের হিসেবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ তালিকায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবার তলানীতে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২.১১, যেখানে ভূটানে ৬.৬ শতাংশ, নেপালে ৫.২ শতাংশ, আফগানিস্তানে ৪.১ শতাংশ, মালদ্বীপে ৪.১ শতাংশ, ভারতে ৩.০ শতাংশ, পকিস্তানে ২.৯ শতাংশ এবং শ্রীলংঙ্কায় ২.৮ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের গবেষকরা বলেন, যদি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না থাকে তাহলে একটি কর্মক্ষম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়।

শিক্ষা এবং অর্থনীতি একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পূর্ণভাবে যুক্ত। বিধস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে হলে শিক্ষার গুরুত্বকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে বরাবরই গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন রেডিও এবং টেলিভিশনে এক নির্বাচনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।” তিনি আরও বলেন, জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন (সমকাল, ১৭ আগস্ট ২০২০)।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বঙ্গবন্ধুর সেই চাওয়া পূরণ হয় নি। তবে বছরের পর বছর শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দ রাখার ফলাফলও আমরা দেখেছি, বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৩৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২ তম। আমাদের উপরে নেপাল, শ্রীলংঙ্কা, ভূটান, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান। বিশ্বে শিক্ষায় যারা উন্নত হয়েছে তারা জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের মাধ্যমেই।

করোনাকালে বাংলাদেশে গবেষণা ক্ষেত্রের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়েছে। এটি মনে রাখতে হবে যে, গবেষণা ব্যতীত কোন ধরনের কল্যাণমূলক পরিকল্পনা নেয়া যায় না। সারা বিশ্বে “গবেষণা ও উন্নয়ন” নামে আলাদা খাত আছে। দেখা গেছে এই খাতে যারা বেশি ব্যয় করে, তারা তত বেশি উন্নত। নেপাল এই তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশের বাজেটে এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

বৈশ্বিক উন্নয়ন রূপরেখা-২০৩০ বা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠের (এসডিজি) আওতায় শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর গতি স্বাভাবিকভাবে শ্লথ হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ এখন জনমিতির যে সুবিধাজনক (Demographic Divident) অবস্থান (অর্থাৎ জনসংখার প্রায় ৬৮ শতাংশ তরুণ) উপভোগ করছে তা কাজে লাগানোর জন্য তারুণ্যের সঠিক ব্যবহার জরুরী। একই সাথে তরুণ সমাজকে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য উপযোগী করার উপরও গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখনই। বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র তথা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে শিক্ষা খাতে আদর্শ বরাদ্দ এবং তা যথাযথ বাস্তবায়নে সঠিক নির্দেশনা সম্বলিত বাজেট প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী। তা হলে আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে যোগ্যতা অর্জন সম্ভব হবে এবং তাতে বাংলাদেশের মর্যাদা এবং অবস্থান আরও সুসংহত হবে।  

 

লেখক: অধ্যাপক,অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।